সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু সেই চিরঞ্জীব এর কথা। সেই গুপ্তিপাড়ার চিরঞ্জীব। সেই চিরঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সাংবাদিকতার নেশা পেয়ে বসে যে ছেলেটা শুধু সারাটা জীবন এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে বেড়ালো রাস্তায় রাস্তায়। কোনো সময় কলকাতার রাস্তায় প্রতিদিনের অফিসে, কোনো সময় স্কাই নিউজ নিজের তৈরি চ্যানেলের বুম হাতে নিয়ে, আবার কোনো সময় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতার পাঠশালায় যোগ দিয়ে নিজের মনের আর পেটের খিদে মেটানোর চেষ্টা করা। আবার কোনো সময় চুঁচুড়া ডিএম অফিসে ভোটের সময় কাজ করে কিছুটা এই পেশায় টিকে থাকার আর ঝুলে থাকার চেষ্টা করা। কোনো সময় ইটিভির হুগলীর অফিসে এসে হাসি মুখে কাঠফাটা দুপুরে দাঁড়িয়ে পরে বলা দাদা আসবো আমি তোমার ঘরে একটা ভালো খবর পেয়ে দিতে এলাম তোমায়। আবার ওর নিজের সেই গুপ্তিপাড়ার সেই সুন্দর আম জাম গাছে ঘেরা সুন্দর ছোট্টো বাড়িতে মিডিয়া সেন্টার তৈরি করে মিডিয়া নামক এক অজানা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা করা। যেটা দিনদিন খুব কঠিন হয়ে পড়ছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি নিজেও।
ওর বিয়েতে আমি সেই ওদের সুন্দর ওর গ্রামের গুপ্তিপাড়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা সবাই মিলে। আমি, মিন্টে, সৌরভ, সোমা আর বুটা বেশ মজা হয়েছিল সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে। সন্ধ্যা বেলায় তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরবো বলে খেয়ে নিতে হলো আমাদের সবাইকে। কিন্তু এই নানা ভাবে মিডিয়াতে ঘুরে তাতে ওর মনের খিদে মিটে গেলেও পেটের খিদে যে মেটে না কিছুতেই সেটা আমরা বেশিরভাগ মিডিয়া প্রেমে মত্ত মুগ্ধ লোকজন জানি কিন্তু। আমিও সেটা জানি বেশ ভালই। কিন্তু উপায় কি নিশির ডাক কি আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় কোনোভাবে। সে যাই হোক বহুদিন পরে ওর সেই ফোনের কথা শুনে মনটা খারাপ হলো আমার। দাদা আমি একটু মিডিয়ার মেইন স্ট্রিমে ফিরতে চাই আমি। তুমি তো জানো আমি কেমন আছি। একটু দেখো না তুমি যদি কিছু হয়। একটা কিছু করা যায় আমার জন্য। এমন ফোন আমি এখনও পাই অনেক। মনটা আমার কেমন বেদনায় ভরে যায় কারুর জন্য কিছুই না করতে পারার বেদনা। কি যে বলি ওকে সব জেনেও বললাম নিশ্চয়ই চেষ্টা করবো আমি।
আসলে কি জানেন তো এই বাংলা মিডিয়াতে এমন কিছু মানুষ আজও লড়ে এইভাবেই বেঁচে আছে টিকে আছে। নির্দিষ্ট কোনো আয় না থাকলেও তারা চেষ্টা করে বেঁচে থাকার কষ্ট করে হাসি মুখে কাউকে একটু খবর দিয়ে ছবি দিয়ে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। এই খবরের দুনিয়াতে ফিরতে টিকে থাকতে কিন্তু মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো আর সেই শূন্যে নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হয়ে বেঁচে থাকা। সেটা যে খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা না বুঝেই লড়ে যায় তারা নিরন্তর। ভাবে এই বোধহয় চিচিং ফাঁক করে সুড়ঙ্গের দরজা খুলে যাবে তাদের সামনে আর তাহলে তারা হেঁটে মাথা উঁচু করে সেই খবরের রাজ্যে প্রবেশ করবে আর দৌড়ে বেড়াবে আনন্দে দুহাত তুলে দিয়ে। কিন্তু না কোথায় সেই বন্ধ দরজা খোলে না যে কিছুতেই কোনো ভাবেই। বন্ধ দরজায় মাথা কুটে মরতে হয় যে।
কবে কোথায় যে চিরঞ্জীব এর সাথে আমার প্রথম আলাপ আজ সেটা আর মনে নেই আমার এতদিন পরে। হয়তো গুপ্তিপাড়াতে খবর করতে গিয়ে আলাপ হয়। কিংবা সেই ইটিভির হট্টমেলার মাঠে। হয়তো সেই গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র জিউর মন্দিরে সেই খবর করতে গিয়ে মহারাজের ছোটো অন্ধকার ঘরে। বা হয়তো গুপ্তিপাড়াতে রথের মেলায় ছবি করতে গিয়ে। বা হয়তো সেই ভান্ডার লুঠ এর দিন ভিড়ের মাঝে। এমন কোনো এক সময় ওর সাথে দেখা হয় আমার প্রায় ত্রিশ বছর হবে হয়তো। সেই ত্রিশ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে কিন্তু আমাদের সেই চিরঞ্জীব আজও সেই একই রয়ে গেছে। তাঁর আর কোনো পরিবর্তন হয় নি। সেই সদাহাস্যময় এক খবর পাগল যুবক। যে নিজের হাজার দুঃখ কষ্টকে বুকে চেপে পেটে খিদে চেপে ঘুরে বেড়ায় শহরের রাজপথে আর গ্রামের মেঠো রাস্তায় হাসি মুখে। সেই চিরঞ্জীব এর সাথে মাঝেই মাঝেই কথা হয় আমার। চিরঞ্জীব আমার ব্লগের সব লেখায় মন্তব্য করে শেয়ার করে ও। খুব ভালবাসে আমায় সেই কবে থেকে ও খুব সম্মান করে আমায়।
এইতো বছর কয়েক আগেই আমার মেয়ের সেই কলেজে ভর্তির সময় জেএনইউতে ভর্তির জন্য পরীক্ষার সিট পড়লো গুপ্তিপাড়াতে এক বেসরকারি কলেজে। আমি আসবো মেয়েকে নিয়ে গুপ্তিপাড়ায় জানতে পেরেই দেখা করতে চলে এলো চিরঞ্জীব ওর মেয়েকে নিয়ে। কি সুন্দর মিষ্টি হাসিখুশি মেয়ে ওর। খুব ভালো নাচে সে। ওদের দেখে ভালো লাগলো আমার সেদিন খুব। দুপুরে ওর বাড়িতে খেতে হবে এই নিমন্ত্রণ করে ফেললো ও হাসিমুখে। ও এমনই নিজের ঘরে যে অবস্থাই হোক না কেমন করে যেনো যে কেউ গেলে হাসি মুখে অতিথি সেবা করতে পিছপা হয়না কিছুতেই। এটাই ওর প্রধান কাজ অতিথির সেবা করা হাসিমুখে সাংবাদিক বলে কথা। পরে আসবো এই বলে রেহাই পেলাম আমি সেইদিন। হ্যাঁ এটাই হলো আমাদের আসল চিরঞ্জীব। যাকে এইভাবেই দেখে এসেছি আমরা এতদিন এতবছর। ওর মার হাসি মুখের কথা বাবা এসেছো খেয়ে তবে যাবে যা ভোলা যায়না।
যে আজও এত বছর পরেও ফিরতে চায় মিডিয়া নামক একটি অবয়বহীন গোলাকার বস্তুর কাছে। যে বস্তুকে ভালোবেসে মানুষের কাছে সম্মান আদায় করা যায়। যে বস্তুকে সামনে রেখে অনায়াসে পয়সা আদায় করে নেওয়া যায় কম কষ্ট করে দ্রুত। যে বস্তুকে সামনে রেখে শিরদাঁড়া সোজা করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। যে বস্তুকে সামনে রেখে নেতাদের আর মন্ত্রীদের সামনে চোখে চোখ রেখে অকুতোভয় হয়ে প্রশ্ন করা যায়। আবার যে বস্তুকে সামনে রেখে নেতার ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকে হাত কচলে দাঁড়িয়ে থাকা যায় একটু তাঁর দাক্ষিণ্য লাভের আশায়। যে বস্তুকে সামনে রেখে সমাজে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে উপস্থিত হয়ে ডিএম, এসপির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কেমন কেউকেটা ভাবা যায়। যে বস্তুকে সামনে রেখে খুব কম পড়াশোনা আর জ্ঞান নিয়েও মাতব্বরি করা যায়। যে বস্তুকে সামনে নিয়ে অনায়েসেই যে কোনো উপায়ে নিজের কাজকে হাসিল করে নেওয়া যায়। যে বস্তুকে সামনে রেখে আরও কত কি যে করে নেওয়া যায় তার কথা আর নাই বা লিখলাম। সত্যিই কি মহিমা এই গোলাকার মিডিয়া নামক বস্তুর সেটা আজ এই রাত দুপুরে এতদিন মিডিয়াতে কাজ করে আমি বুঝতে পারছি।
যদিও তার জন্যে হয়তো চিরঞ্জীব আমার কাছে ফোন করে বলেনি মিডিয়াতে ফিরতে চায় সে এইসবের কারণে। একটা নির্দিষ্টভাবে কাজ হলে কিছু আয় হয় তার যে আয় সংসারে সাহায্যে করবে নানা উপায়ে বেঁচে থাকার এটাই হলো আসল কথা। কিন্তু আজকাল যে মিডিয়া নামক গোলাকার অবয়বহীন বস্তুর সাথে লুকিয়ে আছে নানা ধরনের সব রকমারি ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার মাধ্যমে একজন সংবাদমাধ্যমের সাধারণ অতি সাধারণ প্রতিনিধি দ্রুত জীবনে এগিয়ে চলতে পারে হাউই এর মত। রকেটের গতিতে তার জীবনের উত্থান হয় কত অল্প সময়ের মধ্যে।
আমি দুর থেকে দেখি আর ভাবি সত্যিই তো জীবনের এই শেষ লগ্নে এসে যদি আবার একটু টোটো চালানো ছেড়ে দিয়ে আমিও যদি আবার এই মিডিয়াতে ফিরতে পারতাম তাহলে কি মজাই যে হতো কে জানে সত্যিই বলছি খুব আনন্দ হতো। চিরঞ্জীবকে আমি ফোনে এই কথা বলতে না পারলেও আমিও যে মনে মনে এই বুড়ো বয়সে, আবার সেই অবয়বহীন গোলাকার ওই মিডিয়া নামক বস্তুর ওই মেইন স্ট্রিম জগতের নক্ষত্রলোকের মাঝেই ফিরতে চাই। তার ওই মায়াময় আলো গায়ে মেখে ঘুরতে চাই গ্যালাক্সির পথ ধরে। যেখানে আবার আমি নেতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে অকুতোভয় হয়ে প্রশ্ন করতে পারবো। পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো এটা ঠিক কাজ হয়নি। আবার আগের মতোই খবরের দুনিয়ায় ভেসে যেতে পারব আমি। সেটা আর কেউ না জানুক আমি নিজে তো জানি।
চিরঞ্জীব ও আমি - অভিজিৎ বসু।
তেইশ সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন