তাপসীরা বোধহয় মরেও মরে যায় না কোনোদিন। আসলে তাপসী মালিক তো আর শুধু একটি নাম নয়। তাপসী মালিক হলো একটি আন্দোলনের, একটি প্রতিবাদের মুখ। যে মুখকে সামনে রেখে আজকের শাসক দল সেদিনের বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতির ময়দানে সোনার ফসল ঘরে তুলেছিল।
সিঙ্গুরের সেই বাজেমেলিয়া গ্রামের তাপসীর ঘটনা নিয়ে তো কত হৈ চৈ হুল্লোড় পড়ে গেছিল সারা দেশ জুড়ে এইভাবেই। আজকের মতই সাধারণ মানুষেরা পথে নেমেছিল বিচার চাই বলে। ধর্ষণ করে খুন আর তারপর তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে সেই দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বাড়ির কাছে ভোরবেলায় টাটা কারখানার জমিতে সেই পোড়া দেহের সন্ধান পায় পুলিশ। যে ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের কাছে বাধার মুখে পরে সাংবাদিকরা। সে সব গল্প কথা আমাদের সব জানা।
তারপর নিয়ম করে আঠারো ডিসেম্বর দু হাজার ছয় সালের ঘটনার পরে তাপসীর বাড়ী গিয়ে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা এটাও তো একদম রুটিন মেনে নিয়ম মেনেই করা হয় প্রতি বছর। সেদিনের সেই ছন্নছাড়া বিরোধী দল আজকের গুছিয়ে ফেলা একটা সরকারে আসীন। যে সরকার মা মাটি আর মানুষের সরকার। যে সরকার এর গায়ে মাটির সোঁদা গন্ধ জড়িয়ে আছে।যে সরকার পর পর তিন বার রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেছে। আসলে এতদিন পরে আবারও তাপসীর কথা ওঠায় এতগুলো কথা লিখে ফেললাম আমি।
সত্যিই তাপসী মালিককে এইবার সেই কাদম্বিনীর মত মরিয়া প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মরিয়াও মরেন নাই। আজ দুপুরে নবান্ন সভাঘরে মূখ্যমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে সাংবাদিক বৈঠকের মাঝে হঠাৎ তাঁর মুখে মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর মুখে তাপসী মালিকের নাম শুনে আমি একটু অবাক হলাম। এতদিন পরেও তাহলে তাপসী মালিককে ভুলতে পারেননি তিনি। তাই বোধ হয় আজ তিনি বলে ফেললেন সেই গ্রামের মেয়ে তাপসীর কথা। কিছুটা মনের মাঝে গভীর গোপন আবেগ আর বেদনা থেকেই।
সেই তোমার নাম, আমার নাম, তাপসী মালিক তোমার নাম আমরা ভুলছি না ভুলবো না স্লোগানে এক সময় সিঙ্গুরের আকাশ বাতাস মুখরিত হতো। সেই ছোটো টালির ঘরে মাথা নিচু করে ঢুকতে হতো তাবড় তাবড় রাজনীতির লোকদের আর সাংবাদিকদের। সত্যিই সে একটা দিন গেছে বটে। সিবিআই কর্তা এ কে সহায় খুব সম্ভবত অজয় কান্ত সহায় তিনি আতিপাতি করে সত্য অনুসন্ধানে সিঙ্গুরের মাটির রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারাদিন ধরে। আর আমরা মিডিয়ার কিছু আনপোড় লোকজন ধুলোর মাঝে সোনা উদ্ধার এর স্বপ্ন দেখে ঘুরে মরছি। গ্রামের লোকরা সেটা দেখে আশ্বস্ত বোধ করছেন নিশ্চয়ই আসল সত্য উদঘাটন হবে একদিন। জানা যাবে একদিন গ্রামের মেয়েকে কে মেরেছে আর কারা মেরেছে এইভাবে ধর্ষণ করে খুন করে তারপর পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই অপরাধীর সত্যিই বিচার চাই।
না, দিন গড়িয়ে গেছে। সময় গড়িয়ে গেছে। বছর গড়িয়ে গেছে। রাজ্যে সরকার বদল হয়েছে। মাটির মোরাম রাস্তায় হয়তো কালো পিচের পলেস্তারা পড়েছে। কিন্তু না আজও আমরা জানতে পারিনি তাপসী মালিকের মৃত্যু কি করে হলো। কারা করলো। কি জন্যে হলো তার মৃত্যু। সেই ধোঁয়াশা আজও অজানা হয়েই আছে আমাদের কাছে। সেই বিচার আজও হয়নি। সেকথা বলে আজ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে আফশোষ আর বিষাদ।
তাপসীর মাটির ঘর পাকা হয়েছে। দালানকোঠা হয়েছে। মাথা নিচু করে ঘাড় নামিয়ে আর সেই মাটির ঘরে ঢুকতে হয়না এখন। ওদের অবস্থা ফিরেছে অনেকটাই। কিন্তু না, তাপসীর মৃত্যুর কারণ, অপরাধী আজও ধরা পড়ে নি। বিচার হয়নি আজও সেই অপরাধের। যে অপরাধে জড়িত হয়ে অনেকে জেল খাটেন সেই সিঙ্গুরের সুহৃদ দত্ত সিপিএমের ডাকাবুকো নেতা মারাও গেছেন এতদিনে। দেবু মালিকও এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ছাড়াও পেয়ে গেছেন এতদিনে। কিন্তু আজও আর তার দোষ প্রমাণিত হয়নি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে আজও।
তাই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে সেই তাপসীর নাম শুনে আজ আমার এই সাদা জীবনের কালো কথায় কিছু কথা লিখতে মন চাইলো আমার। মনে হলো তাহলে এত আন্দোলন, এত প্রতিবাদ, এত সিআইডি তদন্ত, এত সিবিআই এর রিপোর্ট, লাই ডিটেক্টর এর সামনে বসা, এত তদন্ত সব কি তাহলে একদম ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা। কে জানে মাঝে মাঝে মনটা বড়ো জানতে চায় আমার এইসব কিছু। সাধারণ মানুষকে কিছু প্রশ্ন আর কিছু সত্য অন্বেষণ এর মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখে দিন বদলের স্বপ্ন দেখা কি তাহলে।
জানি না হয়তো তাপসীরা, তিলোত্তমারা, এই ভাবেই চলে যায়। শুধু তাঁদের জীবনের কিছু কথা থেকে যায়। যে কথার উত্তর মেলে না কিছুতেই। আমরা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই সেই উত্তর। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে যখন সোচ্চার গোটা দেশ। সেই সময় আবার তাপসীর এই আগমন আমার মনকে কিছুটা ভার করে দিলো। আমার মনকে বিধুর করে দিলো।
মুখ্যমন্ত্রীর মুখে তাপসী মালিকের কথা শুনে মনে হলো সত্যিই তো তাপসীর মা মলিনা মালিকও নিশ্চয়ই এই কথা শুনে মেয়ের কথা ভেবে একা একাই চোখের জল ফেলছেন আজ নিজের ঘরে বসে। আর নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মেয়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে আদর করে বলছেন যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস মা। আর দুর থেকে সেটা শুনে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে তাপসী মালিক তার মার দিকে। যে মাকে কতদিন কাছে পায়নি সে। কতদিন মায়ের ডাক শোনেনি। কতদিন মায়ের আদর খায়নি সে।
তাপসী মালিক অমর রহে - অভিজিৎ বসু।
নয় সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন