বুড়ি দুর্গা নামে প্রচলিত শ্রীরামপুরের গোস্বামীর বাড়ির পুজো এবার ৪১৯ বছরে পা দিলো। সালটা ১৫৯৫, শ্রীরামপুরের গোস্বামী বাড়ির পারিবারিক দুর্গাপুজোর সুচনা করেন রামগোবিন্দ গোস্বামী। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে এই দুর্গা পুজো। হুগলি জেলায় প্রাচীনতম কয়েকটি পুুজোর মধ্যে অন্যতম পূজো হলো শ্রীরামপুরের এই গোস্বামী বাড়ির দুর্গা পুজো। এই পরিবারের দুর্গাপুজো এবছর ৪১৯ বছরে পড়ল।
হুগলি জেলার শেওড়াফুলি অঞ্চলের জমিদার শ্রী মনোহর রায় নিজের জমিদারি থেকে এক বিশালায়তন জমি দান করেছিলেন। বংশানুক্রমে শ্রী রামগোবিন্দ গোস্বামীর পৌত্র শ্রী হরিনারায়ণ গোস্বামী শ্রীরামপুর অঞ্চলে প্রাপ্ত এই জমিটির ওপর এক সুবিশাল অট্টালিকা স্থাপন করেন। যা বর্তমানে গোস্বামী বাড়ি নামে পরিচিত। যদিও আজ এই বাড়ী ভগ্নপ্রায়। একটা সময় এই গোস্বামী বাড়ির পদবী ছিল চক্রবর্তী, কিন্তু মহাপ্রভু চৈতন্যদেব রাম গোবিন্দকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করার পর গোস্বামী পদবীতে পরিবর্তন হয়ে যায় এই পরিবার।
তাই গোস্বামী পরিবারের দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে। গোস্বামী বাড়ির ঠাকুর দালানে রথের দিনই কাঠামো পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় মায়ের মূর্তি তৈরির কাজ। কুলোর আকারের একচালা কাঠামোয় মায়ের মূর্তির সঙ্গে লক্ষী, গণেশ, কার্তিক ও সরস্বতীও অবস্থান করেন। যদিও একটা সময়ে এখানে কোনও ঠাকুর দালান ছিল না, ফাঁকা জায়গায় চাঁদোয়া খাটিয়ে করা হত মায়ের আরাধনা। আনুমানিক ১৮০০ সালে রাজীব গোস্বামীর হাত ধরেই তৈরি হয় এই বাড়ির বিশাল ও সুসজ্জিত ঠাকুর দালান। সেই ঠাকুর দালানে হয় পূজো নিয়ম নিষ্ঠা মেনে। আজও সেই থেকুর দালানে হয়ে আসছে এই পূজো।
মহালয়াতেই একপ্রকার শুরু হয়ে যায় এই পুজো, এই পূজো দেখতে চলে আসেন বাইরে থাকা আত্মীয়রা ও প্রতিবেশীরাও। ষষ্ঠীতে হয় দেবীর বোধন, সপ্তমীতে হয় কলা বৌ স্নান, এই বাড়িতে কলা বৌ স্নানের একটা রীতি রয়েছে, সেটা হলো শ্রীরামপুরের এই গোস্বামী বাড়িটি একেবারে গঙ্গার কাছে থাকলেও কলা বৌ-কে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় না। বাড়িতেই কলা বৌ-কে স্নান করানো হয়। যা অন্য সব পূজোর থেকে একটু আলাদাভাবে পালন করা হয়।
অষ্টমীর সন্ধিপুজো ও কুমারী পুজো দেখতে এই বাড়িতে বহু মানুষ ভিড় করেন আজও, নবমীতে ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে। দশমীতে এই বাড়ির নিয়ম একটু অভিনব, এই পরিবারের সব এয়ো স্ত্রী-রা মাছ ভাত খেয়ে উমা’কে বরণ করেন। দশমীতে এই বাড়ির সিঁদুর খেলা দেখার মতো। শ্রীরামপুরে গঙ্গায় সবার আগে এই বাড়ির উমাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর শহরের বাকি পুজোগুলির প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
শ্রীরামপুরের গোস্বামী বাড়ির এই বুড়ি দুর্গা আজও তার ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। রাজবাড়ীর পাশের এই গোস্বামী বাড়িতে পূজোর এই কটা দিন শহরের নানা মানুষের আনাগোনা। শহরের এই পুরোনো ইতিহাসের পাতায় জুড়ে যাওয়া বাড়িটি ও বাড়ির দুর্গাপুজো এক অন্য রূপে আজও হয়ে আসছে।
ইতিহাসের পাতায় জুড়ে যাওয়া এই শ্রীরামপুরের বুড়ী মা দুর্গার পূজো দেখতে তাই দূরদূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী ভীড় করেন এই গোস্বামী বাড়িতে। গঙ্গার ধারে অবস্থিত এই বাড়িটি পূজোর চারদিন জমজমাট হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে ঠাসা রাস্তার পাশে একদম আলাদা ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে এই বুড়িমার শতাব্দী প্রাচীন দুর্গা দালান, সেই পুরোনো স্মৃতি, পুরোনো চালচিত্র, ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের সুর। যা থিম পূজোর মাঝে একেবারেই অন্য রূপে ধরা দেয় আমাদের কাছে।
শ্রীরামপুরে গোস্বামী বাড়ির বুড়ি দুর্গা-
অভিজিৎ বসু, শ্রীরামপুর, হুগলী।
দশ অক্টোবর দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন