জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে।
সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। কেমন ওই এলোমেলো এলেবেলে হয়েই, ঠিক যেনো আমার মতই।
আসলে আজকাল আর উজ্জ্বল আলো, আলোর ঝাপটা, উপচে পড়া ভীড়, নানা মানুষের আনাগোনা, নানা জনের কলরব ,ভালো লাগে না আর। যেখানে শুধুই আমি, আর আমির খান খান আর ঝন ঝন নানা রঙের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দেয় সদর্পে আমি আছি, আমরা আছি, সবাই এ ওর গা ঘেঁষে উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছি এই ভিড়ের মাঝে ঠেলে ঠুলে কোন রকমে। একে অপরকে পাশ কাটিয়ে, কড়া ট্যাকল আর ড্রিবল করে বেঁচে আছি আমরা কেমন হাসি মুখে। আর তারপর মাঠের ওপর দৌড়ে বেড়ানো কড়া ট্যাকলে পড়ে যাওয়া ওই মানুষটার দিকে কেমন হাসি মুখে তাকিয়ে থাকা। যে হাসির মধ্য কৌতুক, রঙ্গ, অভিনয় ফুটে ওঠে বারবার।
আমার এই ভীড়ে ঠাসা জীবন জুড়ে মিডিয়ার নানা মানুষের আনাগোনা। তারা সব নানা উজ্জ্বল আর সমুজ্বল হয়ে ভেসে বেড়ায় আমার চারিপাশে, চারি ধারে ঠিক ওই গ্রহপুঞ্জের মতই। নানা ধরনের, নানা রকম এর,নানা মাপের, নানা ঘরানার সব মানুষজন এরা। কেউ বেশ সোজা, আবার কেউ বেশ বাঁকা। কেউ সহজ আর কেউ চালাক । কেউ বন্ধুর বেশে শত্রু হয়ে ঘুরে বেড়ানো ঠিক ওই ভীমরুল বা বোলতার মতই। কেউ আবার সত্যিই কারের বন্ধু সেজে হাসি মুখে ঘুরে বেড়ায় আমার চারপাশে ঠিক ওই হলুদ ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়ানো মৌমাছির মতই। হ্যাঁ, যেসব মৌমাছি আমায় হুল ফোটায় না। বরং দুর থেকে একলা একলা আমায় দেখে কাছে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বলতে চায় তারাও, এমন একলা ঘুরে বেড়াও কেনো। আমরা তো তোমার চারপাশে সব লুকিয়ে আছি। এই ভীড়ে ঠাসা রাস্তার আশেপাশে একটু গা ঢাকা দিয়ে।
আমি কেমন ওদের কথা শুনে বিবশ হয়ে যাই। কেমন অবশ হয়ে যায় আমার সারা শরীর। কেমন যেনো ইচ্ছা করে আবার ফিরে যেতে ওই ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় ধীর পায়ে। হাতছানি দেয় সেই সব পুরোনো দিনের স্মৃতি। যে স্মৃতির উত্তাপ, উজ্জ্বল ঝাপসা হয়ে যাওয়া কিছু ছবি। আর কিছু মানুষ আমার চারপাশে হেসে খেলে ঘুরে বেড়ায় কলকলিয়ে।
আর দুর থেকে আমি তাদের অবাক হয়ে দেখি। আমার এই একলা এক আকাশ ঘেরা জীবনে, একসময় যারা জড়িয়ে ছিল বহুদিন ধরে, বহুবছর ধরে,আজ তারাই কেমন যেনো অজানা অচেনা হয়ে আজ বেঁচে আছে দূরে অনেক দূরে ওই গ্যালাক্সির মত। আমি হাঁটতে থাকি জোছনা মাখা কোপাই এর তীর ধরে, খোয়াই এর জঙ্গলের পথ ধরে, সেই কঙ্কালীতলা হাট এর মেঠো রাস্তা ধরে, হেমন্তের ভোরে শিশির ভেজা পথ ধরে। একা , একদম একা আমি হেঁটে চলে যাই দূরে অনেক দূরে এই ভীড় ছেড়ে।
ভীড়ের মাঝে একা - অভিজিৎ বসু।
ত্রিশ অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন