সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।

 প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এই অর্থ ছাত্র ছাত্রীদের কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়।

 
এই আনন্দমেলায় বিভিন্ন স্টলের বিভিন্ন ধরণের নাম দেওয়া হয়। বিকেল চারটে থেকে মেলা শুরু রাত আটটা পর্যন্ত। মহালয়ার দিনে এই বিশ্বভারতীর প্রাচীন ঐতিহ্য ও আদর্শ মেনেই এই মেলা হয়ে আসছে আজও প্রতিবছর। এই মেলার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। আনন্দবাজার ব্যাপারটা হলো রবীন্দ্রনাথের বিদেশীকে স্বদেশী করার একটা দৃষ্টান্ত। 

 অন্য যে কোনো মেলার সাথে এই মেলার কোনো মিল নেই একদম। প্রায় একশবছর আগের এই মেলার মধ্য একটাই বিষয় প্রতিভাত হয় সেটা হলো সৃষ্টির আনন্দ। আসলে নিজের হাতে তৈরি জিনিস সেটা বিক্রি করে যে আনন্দ সুখ মেলে সেটার স্বাদ আলাদা। জীবনকে উপভোগ করার আগ্রহ থাকলেই সেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় যে কোনো ভাবে যে কোনো উপায়ে। আনন্দমেলা যেনো সেই আনন্দ খোঁজের একটা জায়গা বা স্থান মাত্র। এই মেলায় বাইরের কেউ দোকান দিতে পারেন না। যারা এখানকার পড়ুয়া তারাই নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতে পারেন এটাই এই মেলার প্রধান নিয়ম।
 
গল্প কথা শোনা যায় একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এইমেলা থেকে নাকি মাত্র চার আনা দামের রুমাল এক টাকাতে কিনে নিয়ে ঘরে এসেছিলেন। আর একবার এমন মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখেন এক জায়গায় ছাত্ররা কাগজে ধুলো রেখে বলছে সীতাদেবীর ধুলো বলে চিৎকার করে বিক্রি করছে তারা সেটি। কবি সেই ধুলো দেখে ঘরে ফিরে এসে সীতাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোমার  শ্রী চরণ রেনু দেখে এলাম। এমন নানা মজার গল্প কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই আনন্দমেলার আনাচে কানাচেতে। গৌরপ্রাঙ্গনের ময়দানে।

কয়েক ঘণ্টার এই মেলা কিন্তু তার মজাই আলাদা। বিশ্বভারতীর জাপানী ভাষা বিভাগের স্টল এর নাম জাপনিকা যেখানে সব জাপানী ভাষা শিখতে আসা পড়ুয়ারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসেছে সেজে গুজে। জাপানী ভাষা বিভাগের ছাত্রী আভেরী বসু জানান, এই একটা দিন এর জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি। আভেরীর মত মেঘনা, রূপসা, আর সৌমী নিজেদের হাতে তৈরি জিনিস নিয়ে বসেছে মেলায়। আনন্দ করবী হলো বোটানি বিভাগের স্টল, ঠিক তেমন একটি স্টল হলো পত্রব্যঞ্জন যে স্টলে মিলছে ফুচকা আর চাট। জাপানের বিখ্যাত খাবার সুসির স্বাদ পাবার জন্য জাপোনিকা নামের স্টলে ভীড় উপচে পড়েছে সন্ধ্যা থেকেই।

 এমন সুন্দর সব নামের পঞ্চাশ থেকে ষাটটি স্টল হয়েছে এই মেলায় এই বছর। কোথাও রয়েছে খাইখাই, শেষের কবিতা, ঠাকুমার ঝুলি এমন নানা স্টলে নানা রকমারি খাবার আর সাজগোজের জিনিস। শুধু তাই নয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর জার্নালিজম ও মাসকম ডিপার্টমেন্ট এর ছেলে মেয়েরা বিক্রি করছে তাদের তৈরি পত্রিকা বিশ্বভারতী ক্রনিকাল। ইংরাজি ভাষার এই ট্যাবলয়েড পত্রিকায় দেখা গেলো আর জি কর এর জাস্টিস নিয়ে লেখা। এমনকি পাঠভবনের ছোট্ট স্কুল পড়ুয়া নিজের হাতে হার তৈরি করে মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে। যদি কিছু আয় হয় এই আশায়। এটাই যে আসল আনন্দের মেলা আর আনন্দের বাজার।

যে শতাব্দী প্রাচীন এই মেলার মধ্য দিয়ে আজও অমলিন হয়ে বেঁচে আছে নানা স্মৃতি, নানা গল্প আর ইতিহাস। যে ইতিহাসকে বুকে আগলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে হৈ হুল্লোড় করে এই আনন্দের মেলা আনন্দ বাজার। যে মেলায় শুধু আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া, ভীড়ের মাঝে ছুটে যাওয়া। রাত আটটা বাজতেই মেলার আলো নেভার পালা। ঢাকের বাদ্যি বাজছে। মেলা প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করছে ঢাকির দল। নেচে উঠেছে সবাই ঢাকের তালে। সানাই এর সুর এর লয়ে মন খারাপ সকলের।

 আবার যে এক বছরের প্রতীক্ষা। শেষ মুহূর্তেও চেটেপুটে আনন্দ উপভোগ করার তাই প্রাণপণ চেষ্টা সকলের। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নেচে ওঠা আনন্দে। গৌড়প্রাঙ্গণে তখন মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে এই বছরের মত মেলা শেষ। মাঠের সেই বিখ্যাত ঘণ্টার সামনে মন খারাপ নিয়ে কেমন বিষাদ মাখা মুখ এর ভীড় আর করুণ সকাতর চাওনি এর ওর দিকে। আবার একবছর পর  দেখা হবে। আবার মিলন হবে। আবার আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া যাবে। ধীর পায়ে মন খারাপ নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমিও। 

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার - অভিজিৎ বসু।
দোসরা অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...