সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দশমীর মন খারাপের সকাল

সৃষ্টি-স্থিতি বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি.... দশমীর সকালটা কেমন যেনো মন খারাপের সকাল। যে ভোর বেলায় মহালয়ার দিন মাকে আবাহনের গান শুনে ঘুম জড়ানো চোখে আনন্দ উপচে পড়েছিল আমাদের ধুলো জমে যাওয়া জীবনে। সেই সকালে চারিদিকে বদলে যাওয়া ছবি, বদলে যাওয়া ঢাকের বাদ্যি, বদলে যাওয়া আকাশ আর বাতাসের সুর। সত্যিই ফেসবুকের দেওয়ালের দৌলতে দশমীর শুভেচ্ছার বন্যা বয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের দেওয়ালে। যে দেওয়ালে আজ শুধুই মন খারাপের মিষ্টি বাসি গন্ধ, শিউলি তলায় বাসি ফুলের সুবাস, মন্দিরে ঘণ্টার ধীর গতির আওয়াজ শুনে কেমন যেনো চুপ করে পড়ে রইলাম আমি আমার বিছানায়। 


কেউ চলে যাবার জন্য যে এত মন খারাপ হয় সেটা বোধহয় এতদিন বুঝতে পারিনি আমি। দৌড়ে বেড়ানো আর ছুটে বেড়ানো জীবনে যখন স্থবিরতা বিরাজ করে তখন বোধহয় বোঝা যায় কেউ চলে যাবার কি দুঃখ। আমাদের ঘরের মেয়ে উমার আজ ঘরে ফেরার দিন। ঘটের সুতো কেটে আনন্দের সেই দিনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে ইতিমধ্যেই। সব কিছুই যেনো নিয়ম মেনেই হচ্ছে। তবু কেনো জানিনা পূজোর এই চারটে দিন, চেটেপুটে গিলে খেয়ে আনন্দ উপভোগ এর দিন, এলো মেলো জীবনে আলো মেখে ঘুরে বেড়ানো চারটে দিন যে বড়ো দ্রুত গতিতে ফুরিয়ে গেল। আর একটু থাকলে বোধ হয় বেশ ভালোই লাগতো।

আসলে সারা বছরের এই দিনাতিপাত। সারা বছরের এই সংসারের চিন্তায় আকুল ব্যাকুল হয়ে ছুটে বেড়ানো মানুষগুলোর কাছে এই পূজোর চারটে দিন যেনো অক্সিজেন। যে অক্সিজেন গ্রহণ করে সারা বছর আবার দৌড়ে সামিল হয়ে এগিয়ে চলা। দূরে কোথাও পূজো মণ্ডপে মন খারাপের ধীর লয়ের গান বাজছে। যে গান মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ দশমী।

 যে দিন সকাল থেকেই সেই ছোটো বেলায় মনে পড়ে যেতো মা দুর্গা চলে যাবেন। সেই বাঁশ দিয়ে ঠাকুর নামানো। সেই মা, মামীমা আর পাড়ার মণ্ডপে জেঠিমা আর কাকীমাদের সিঁদুর খেলা মন খারাপ নিয়েও। তারপর কেমন করে সবাই মিলে মাকে প্যান্ডেল থেকে বের করে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া। লাইন করে দুর্গা প্রতিমার দাঁড়িয়ে থাকা। ভীড় এর মধ্য চোখের কোলে চিকচিকে জল আর মার হাতের অস্ত্রে কেমন চিক চিক করা আলো ঠিকরে পড়ছে যেনো। সত্যিই মায়ের কি মন খারাপ হয়ে যায় এদিন। কে জানে সেটা যে আর জানা হয়নি।

এই মন খারাপের সকালে দৌড়ে যেতাম ফাঁকা অফিসে ডিউটি করতে। সারাদিন ডিউটি করে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরে আসতাম গভীর রাতে তখন দশমী পার করে একাদশীর ছায়া পড়েছে চারিদিকে। রাতে ফেরার পথে মাকে ফোন করতাম ট্রেন থেকে। মা বলতেন সাবধানে ঘরে ফের অনেক রাত হলো যে বাবু আজ তোর। আমি ট্রেনের জানলার ধারে বসে মার কথা শুনে চলে যেতাম নিজের ঘরে শ্রীরামপুরে। এইভাবেই কেটে যেতো পূজোর দিনগুলো।

আজ আর কোনো ডিউটি নেই আমার জীবনে। জীবনে ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই আজ। কেউ বলার নেই সাবধানে ঘরে ফের বাবু। মার সেই আলতা পড়া লাল টুকটুকে ছোটো পা দুটোকে খুব প্রনাম করতে ইচ্ছা হচ্ছে আজ আমার। জানি দশমীর মন খারাপের সকালে সেই লাল টুকটুকে পা দুটো যে কবেই হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। মা তুমি ভালো থেকো মা। তুমি যেখানেই থাকো দুর থেকে আমার প্রনাম গ্রহণ করো মা এই মন খারাপের সকালে। আর দুর থেকে তোমার বাবুকে বোলো সাবধানে জীবনে চলতে শেখ বাবু। না হলে যে বাঁচতে পারবি না তুই। কে দেখবে তোকে আজ যে আমি নেই তোর কাছে। 

চোখের জলে ভেসে গেলো আমার জীবন এই দশমীর সকালে। বহুদিন পর আমি সত্যিই এত সুন্দর করে কাঁদলাম আবার আমার হারিয়ে যাওয়া মার জন্য। ভাগ্যিস দশমীর মন খারাপের সকালটা এসেছিল। তাই বোধহয় জানতে পারলাম এত দিন পরেও এত কষ্ট, যন্ত্রণা, গভীর গোপন ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া মার জন্যে, এই বাতিল হয়ে যাওয়া জীবনে সেটা যে এতদিন বুঝতে পারিনি আমি মা। 

দশমীর মন খারাপের সকাল - অভিজিৎ বসু।
বারো অক্টোবর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...