পূজো শুরু হতে না হতেই সেরা পূজোর তকমা ছিনিয়ে নেওয়া সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে। দুর্গা পূজার চতুর্থীর সন্ধ্যায় একটি জনপ্রিয় বাংলা চ্যানেল হুগলী জেলার সেরা পুজোর পুরস্কার তুলে দিলো শ্রীরামপুরে এক বিখ্যাত পুজো মন্ডপকে। একদম ঠিক যেনো স্কুলে ভর্তি হতে ছোটো বেলায় বাবা মার হাত ধরে স্কুলে যাবার আগেই মাস্টার মশাই এর রাস্তায় বলে দেওয়া তুমি পাশ করে গেছো আর স্কুলে ভর্তি হতে যেতে হবে না তোমায়।
আসলে আমি একটু সব কিছুকেই কেমন বাঁকা চোখে দেখি আর কি। তাই সেজে গুজে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে পুরস্কার বিতরণ এর এই ছবি দেখে আমার সাদা জীবনের কালো কথায় সেই পুরোনো দিনের স্মৃতি কথা, পূজোর কথা, মণ্ডপে বড়দের কাছে পুরস্কার এর খবর আসার কথা সব কিছু মনে পড়ে গেলো যে এতদিন পরেও। যে পুরস্কার আর পূজো যেনো একটু অন্য রকমের ছিল।
এই যে বড়ো বড়ো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর তাদের সব ঝাঁ চকচকে বিশাল বিশাল মণ্ডপ, নানা ভাবনার দুর্গা প্রতিমা, আলোক সজ্জার রকমারি পূজো। তাকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের আনাগোনা। বহু মিডিয়ার কল্যাণে ক্যামেরার ঝলকানি আর ছবি ওঠা আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাইভ দেখানো এসব তো এই হাল আমলের কথা। বেশিদিন তো আর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি বাংলার এই পূজো মণ্ডপে। যে বেছে বেছে আগে থেকেই কোন পূজো আর কার পূজো কত পুরস্কার পাবে সেটা ঠিক করা থাকে। তালিকা ধরে পূজোর দশকর্মার ফর্দ লেখার মতই।
আর সেই পুজোকে পুরস্কার দেবার জন্য লাইন পরে যায় তৃতীয়া বা চতুর্থী নয় মহালয়ার পরদিন থেকেই। সত্যিই অসাধারন এই দৃশ্য। যে দৃশ্য দেখে আমার মনে পড়ে গেলো বহু পুরোনো দিনের কথা। সেই পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী পার করে অষ্টমীর সন্ধ্যায় কোনো মণ্ডপে মাইকে ঘোষণা হতো আমাদের মণ্ডপ এই বছর শ্রীরামপুর থানার বিচারে সেরা প্রতিমা হয়েছে। আর পরদিন কাগজ জুড়ে দেখা যেতো সেই বিখ্যাত এশিয়ান পেন্টস এর শারদ সম্মান এর বড়ো চেহারার বিজ্ঞাপন। যা দেখে আমরা বলাবলি করতাম ওই পূজো যদি দেখতে যেতে পারতাম সেই বিখ্যাত সব পূজো, তাহলে বোধহয় জীবন সার্থক হতো আমাদের।
আর সেই সন্ধ্যা বেলায় থানার বড়বাবু আর পুলিশ এর কর্তারা এসে দেখে যেতেন পাড়ার পূজো মণ্ডপ। পাড়ার বড়রা তাঁদের খাতির করতেন, বসতে বলতেন সাদা প্লেটে চা সিঙারা আসতো। তারপর তাঁরা হাসি মুখে চলে যেতো গাড়ি নিয়ে অন্য পুজোয়। আর সেই রেজাল্ট বের হতো অষ্টমী বা নবমীর সন্ধ্যায়। খবর আসতো আমাদের কাছে। মাইকে ঘোষণা হতো আমাদের মণ্ডপ পুরস্কার পেলো এই বছর। এটাই যে রীতি ছিল পুরস্কার এর। বিশ্বাস করুন সেই মাইকে ঘোষণা শুনে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করতো আমার। আমাদের পূজো পুরস্কার পেলো এটাই কেমন একটা অনুভূতি নিয়ে আসতো সেই নবমীর নিশির সন্ধ্যায়।
ধীরে ধীরে কত বদলে গেলো পূজো। মা দুর্গার মণ্ডপে মণ্ডপে দাপাদাপি বাড়ল থিম আর টাকার আর বিজ্ঞাপনের। দাপাদাপি বাড়ল রাজনীতির নেতাদের। বামেরা যদিও পূজো পাঠে বিশ্বাস করেন না তাই তারা এর থেকে দূরেই থাকতেন কিছুটা। কংগ্রেস আর পরে তৃণমূল কংগ্রেস পূজোর আনন্দে ভেসে গেলো। ভেসে গেলো বাংলা মিডিয়াও। ভেসে গেলো বাংলার আপামর জনসাধারণ। সেই পুরোনো দিনের ফেলে আসা পূজোর স্মৃতি যে এখন ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়ে বিশ্বজনীন। সেটা তো অবশ্যই গর্বের।
কিন্তু এই যে রাজনীতির লোকদের পূজো মণ্ডপে দাপাদাপি, লক্ষ মানুষের ভিড়, ভিআইপি পাশের জন্য মাথা খোঁড়াখুঁড়ি, টিভি চ্যানেলে সেই পূজোর ছবি ঘন্টায় ঘণ্টায় দেখিয়ে টিআরপি তোলার চেষ্টা করা আর যার পূজো সেই নেতার নজর কাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এসব বোধহয় হাল আমলেই শুরু হলো এই কিছু দিন ধরেই। আর তাই পূজোর প্রতিযোগিতার ভীড়ে সবার আগে এগিয়ে থাকতে চতুর্থীর দিন সন্ধ্যায় জেলার সেরা পূজোর তকমা লাগিয়ে দিয়ে একদম তাক লাগিয়ে দেওয়া অন্যদেরকে। দেখো কেউ পুরস্কার দেবার আগে আমরাই প্রথম পুরষ্কার বিতরণ করে জানিয়ে দিলাম এই পুজোই সেরা পুজো।
সত্যিই কত কিছুই না বদলে যায় ধীরে ধীরে। ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি, বৈভব সব কিছুর কাছে দশভূজা মা দুর্গার আরাধনা বোধহয় কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। পুরস্কার এর ঘেরা টোপে বন্দী হয়ে মা দুর্গা চুপ করে দেখেন সব কিছুই। কিন্তু কি আর বলবেন সন্তানদের। মা যে বড়ো ভালোবাসেন তার এই সন্তানদের। তাই পুরস্কার এর মেডেল, ঢাকের বাদ্যি, মণ্ডপে আলোর উজ্জ্বলতা, সব কিছু দেখে বোধহয় একটু মন খারাপ হয় মা উমার।
মাত্র তো আর এই কটা দিন তারপর তো এসব ছেড়ে আবার যে তাকে ঘরে ফিরে যেতে হবে মন খারাপ করেই। আবার যে এক বছরের প্রতীক্ষা। এর মাঝের এই চারটে দিনের স্মৃতি জড়িয়ে না হয় বছরের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবেন মা হাসি মুখে। সন্তানদের কথা ভেবে। না হয় একটু বদলেই গেলো এই পূজোর আয়োজন তাতে আর ক্ষতি কি।
দুর্গাপূজো ও পুরস্কার - অভিজিৎ বসু।
সাত অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন