নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।
ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।
একে অপরকে বলে দেখ দেখ কি ভালোবাসে ওরা আমাদের। সত্যিই গাছেরা আপ্লুত হয় তাদের ভালোবাসায়। ঝড়ে পড়া পাতা গুলোর কষ্ট হয় না। গাছ থেকে আলাদা হলেও।তারপর পাতা তোলা সারা হলে, ঘরে ফেরার সময় হলে ধীরে ধীরে সবাই ফিরে আসে পাতা নিয়ে। বাড়ির উঠোনে বসে পাতা দিয়ে তৈরী করে খাবার থালা। যা নিয়ে শহরে এসে এই পাতার থালা বিক্রি করে জোটে অল্প কিছু টাকা। ঘরে এসে একটা একটা করে পাতাকে পরম যত্নে মমতায় একে অপরের সাথে জুড়ে দেয় ওরা। আলাদা হয়ে যাওয়া পাতার দল লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায় থাকে কখন তার ডাক আসবে একের পর অন্য জনের। কখন তার সময় আসবে।
আর এই পাতা জোড়ার খেলা খেলতে মুলুর খুব ভালো লাগে।গাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া পাতার দল জুড়ে যাওয়াকে উপভোগ করে একে অপরে। ঠিক যেভাবে তার সংসার ছেড়ে চলে গিয়েও আবার তার টানে ঘরে ফেরে মুলুর নাগর রসিক।রসিক বলে বুঝলি তোকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না আমি তাই চলে এলাম তুর ঘরে। রান্নার ঝাঁজে খুন্তি নাড়তে নাড়তে মুলুর ভিতরটা ভীষন উথাল পাতাল করে। ভাবে সত্যিই তো সে কি রসিক কে ছেড়ে থাকতে পারে।
আর দুর থেকে মার পাতা বোনা দেখে তার ছেলে। মাকে বলে মা চল আজ তোর সাথে শহরে যাবো।আর একটু দূরে ঘরের লাল ছাগলটা ছোটো শিশুর মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে পাতা বোনার কাজ দেখে আর চোখ বুজে দাড়িয়ে থাকে।এভাবে অভাবের সংসারে পাতা জুড়ে চলে সংসার রক্ষার লড়াই।কুড়িটা থালায় মেলে দশটি টাকা। এমন করে দশটি বান্ডিল হলে মেলে একশো টাকা। যার দাম তাদের জীবনে অনেক। কিন্তু সেই পাতার থালা তৈরি করে দেড় ঘণ্টা পায় হেঁটে তারা পৌঁছে যায় সদর শহর সিউড়ি। যাদের একটু ভালো অবস্থা তারা বাস করে নিয়ে যায় তাদের হাতে তৈরি জিনিষ। এভাবেই মুলুরা জীবনের লড়াই করে না হেরে। প্রকৃতির দান নিয়ে।
সদর শহর থেকে ফেরার সময় মুলুর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। আনন্দে ভরে ওঠে তার মন। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে বাস ধরে। বাসে জানলার পাশের সিটে বসে থাকে সে। জোরে ছুটে চলেছে বাসটি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। আড় চোখে ঘন ঘন বাসের কন্ডাক্টার তাকে দেখে। আর শীষ দেয় জোরে জোরে।
ঘরে তার জন্য অপেক্ষায় আছে রসিক। কখন আসবে তার মুলু। ঘরের উঠোনে বসে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে রসিক। সন্ধ্যা নামে চর ইচ্ছা রঘুবরপুর গ্রামে। ঝুপ করে রাত নামে গ্রামে।অন্ধকার রাস্তায় গল্পো করতে করতে মূলু, মালতীরা ঘরে ফেরে। আজ তাদের জীবনে একটু আলোর আভা। ছোট কুপি জ্বেলে টাকা গুলো দেখে রসিক। কটা টাকার গন্ধে পেটের ক্ষিধে উড়ে চলে যায় তার। টাকার খস খস শব্দ আর গন্ধে ভরে যায় গোটা ঘর। রসিক এক দৃষ্টিতে সুন্দরী মুলুকে দেখে, পরম মমতায় তাকে কাছে টেনে নেয়। বাধা দেয় না সেও। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চুমা দেয় ভর সন্ধ্যায় একে অপরকে। মুলুও বাধা দেয় না রসিক কে।দু হাত দিয়ে রসিক, মুলুর এলো মেলো চুল গুলোকে পরম মমতায় যত্নে মুখ থেকে সরিয়ে দেয়। ঘন জঙ্গলে দুর থেকে কোনো এক নাম না জানা পাখির আওয়াজ ভেসে আসে। তার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ খান খান হয়ে ছড়িয়ে যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
দুর থেকে পাতার খস খস শব্দ এগিয়ে আসে ঘরের কাছে। ঠিক যেভাবে হলুদ গোখরো রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চলে আপন মনে পাতা মাড়িয়ে। ঘন জঙ্গল লুকিয়ে দেখে তাদের দুর থেকে।গভীর রাতে গোপন অভিসারে হারিয়ে যায় মুলু আর রসিক।যার একমাত্র সাক্ষী থাকে শাল, সেগুন, পিয়াল এর বিশাল জঙ্গল । এই গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক আদম আর ইভের মত মুলু আর রসিক রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে হারিয়ে যায় কোথায় কে জানে।
কুড়ি থালা, দশ টাকা আর রসিক-মুলুর জীবন-
অভিজিৎ বসু ।
আট নভেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য দীপান্বিতা বসু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন