সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।
কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।
কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ সবাই বেশ সমীহ করবে, বন্ধুবান্ধবদের কাছে আলাদা খাতির পাবো, আত্মীয় স্বজনদের বাড়ী গেলে অন্য রকম একটা অনুভূতি লাভ করা যাবে, যে কোনো জায়গায় গেলে একটু বাড়তি খাতির আর সম্মান লাভ করা যাবে। এলাকায় কোনো ঝামেলা বা গণ্ডগোল হলে সেখানে পুলিশ স্পটে এলে হেসে ডেকে আমার সাথে কথা বলবে আর বলবে কি খবর ভালো আছেন তো আপনি। আর সেই দৃশ্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠবে আমার নিজের। সত্যিই অসাধারণ এই সাংবাদিক জীবনের নানা অনুভূতি যেনো জড়িয়ে ধরে সেই কচি মনে সেই সময়।
স্যার মানে কাজী দা যতদূর সম্ভব ভারতকথা পত্রিকায় কাজ করেছেন। সেখানেই শুনেছি স্যার বলতেন নানা মাপের নেতাদের বিরুদ্ধে খবর করার কথা। বেশ একটা কলার তুলে খবর করে লিখে সেই নেতার পর্দা ফাঁস করে দেওয়া। সেই সময় স্যার এর কাছে শুনতাম এমন সব কথা যা আমার মনে প্রভাব ফেলেছিল সেই সময় । স্যার আমায় বললেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বিজ্ঞান বিভাগের স্বাতী চট্টোপাধ্যায় এর সাথে দেখা করতে। স্যার এর কথা মত আকাশবাণী পৌঁছে গেলাম বিজ্ঞান বিভাগের সেই একতলার কোনের ঘরে।
স্বাতীদি তখন ঘাড় গুঁজে কাজ করে যাচ্ছেন একমনে। বলা যায় ফাইলে ডুবে আছেন তিনি। বললাম কাজী দা পাঠিয়েছেন আমায় কিছুটা ভয়ে ভয়ে। বললেন হ্যাঁ রে বল, ও পাঠিয়েছে বেশ ভালো তো। কি করছিস এখন, বললাম দিদি সবে পাশ করেছি সাংবাদিকতা আর গ্র্যাজুয়েশন করেছি আমি বিজ্ঞান নিয়ে। ঠিক আছে কিছু খবর হলে জানাবো। তোর নাম লিখে দিয়ে যা মনোজকে। সেই আকাশবাণীর দরজায় পা দেওয়া আমার স্যার এর কথা শুনেই সেই দিন। সালটা ১৯৯১ বা ১৯৯২ হবে বোধহয়। একদিন স্যারকে দেখলাম আকাশবাণীর করিডোরে। সেই রোগা চেহারা। কালো প্যান্ট পরে হাফ শার্ট জামা গুঁজে পড়া। মুখে হাসি। কি খবর ভালো তো। স্বাতীর সাথে দেখা হয়েছে, আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ স্যার।
তারপর তো ধীরে ধীরে জীবন কাটিয়ে গেছি নিজের মতো করেই। এদিক থেকে ওদিক ভাসতে ভাসতে ভেসে চলেছি একা একাই। গঙ্গার জলে কচুরিপানার মতই। কিন্তু এই যে পরেশ পাল, হাসিম আব্দুল হালিম, তাপস রায়, মদন মিত্র, সাধন পান্ডে, সুব্রত মুখার্জী সুভাষ চক্রবর্তী, গৌতম দেব এর কাছে পৌঁছে যাওয়া যায় এক নিমেষে, এক ফোনেই। মেয়র এর ঘরে পৌঁছে যাওয়া যায় বুক পকেটে একটা পেন আর নোটবুক নিয়ে হাসতে হাসতে অবলীলায় পকেটে হাত দিয়ে। আর সেই সেই ক্ষমতাবান নেতাদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার এই যে সুলুক সন্ধান সাংবাদিকতা সেই পাঠশালায় ভর্তি হয়ে গেলাম আমি।
স্যার এর এমন সাধারন একজন লো প্রোফাইলের জীবন কাটিয়েও কেমন নানা উচ্চ শ্রেনীর সাথে মিশে যাওয়াটা আমার বেশ ভালো লাগতো সেই সময়। আমায় প্রলুব্ধ করেছিল এই সহজ সরল অনাড়ম্বর সাংবাদিকতার জীবন। যে জীবনে তখনও স্যার মানে আমাদের সবার কাজীদা আনন্দবাজার এর কাগজে চাকরি করেন না তখনও। থিতু হননি জীবনে তিনিও সেই সময়। ভারতকথা, ওভারল্যান্ড, এই সব নানা কাগজে ঘুরে ঘুরে কাজ করছেন তিনি। সেই অনুপম অধিকারী, সেই দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায় বোধহয় টেলিগ্রাফ এর হাই পাওয়ার এর চশমা পড়া, সেই স্নেহাশীষ শুর, সেই আকাশবাণীর স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণশর্বরী দাশগুপ্ত, স্যার এর সব বন্ধু পরিচিত জন। আরও অনেকেই ছিলেন নাম মনে নেই আর।
কিন্তু রাস্তায় কোথাও দেখা হলেই কি খবর বলে জিজ্ঞাসা করতেন একগাল হেসে। যেদিন আনন্দ বাজার পত্রিকায় স্যার এর নাম ছাপা লেখা দেখলাম বেশ ভালো লাগলো আমার। কর্পোরেশন এর খবর করতেন তিনি। আরও সব নানা ভালো ভালো খবর করতেন তিনি। সেই আসানসোলের চুরুলিয়া থেকে এসে এই কলকাতা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বেশ কঠিন ও কঠোর সংগ্রাম করেই। সেটাই তো সাংবাদিকের জীবন।
সেদিন হঠাৎ করেই স্যার এর মোবাইল নম্বর পেলাম। ভালো লাগলো স্যার এর নম্বর পেয়ে। প্রেস ক্লাবে গেলে মাঝে মাঝেই দেখা হতো স্যার এর সাথে। সেই সম্ভাবনা আর নেই বর্তমানে। কলকাতা যাওয়া হয়না আর আমার বহুদিন। কিন্তু এর মধ্যে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি বেশ কিছুদিন আগেই। হঠাৎ একটি বাংলা কাগজে দেখলাম স্যার এর লেখা একটি কর্পোরেশন নিয়ে।
সেই তাঁর নাম দেখে আজ এত কিছু মনে পড়ে গেলো আমার। মনে হলো এই নাম দেখেই তো একদিন প্রলুব্ধ হয়েছিলাম আমিও। এই পেশায় এসেছিলাম সম্মান, আর জীবনে প্রতিষ্ঠা আর কিছুটা আর্থিক স্থিতি পেতে। সেটার কথা আজ নাই বা বললাম। কিন্তু স্যার এর কাগজে এই লেখা দেখে মনে হলো এই সাংবাদিকতার নেশা বোধহয় তাড়িয়ে ফেরে আমাদের সবাইকে দিন রাত সব সময়। অবসরে গেলেও মনে হয় আরও কিছুদিন লেগে থাকি এই কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকি। সে যে যত বড় আর ছোটো সংবাদ মাধ্যমেই কাজ করি না কেনো আমরা।
এই মিডিয়া জীবন ছেড়ে দিলেও বোধহয় সেই জীবনকে ছাড়া যায় না কিছুতেই। তাই আজ এতদিন পরেও দীর্ঘ চল্লিশ বছর এই পেশায় ছোটো বড়ো নানা জায়গায় কাজ করেও তিনি এখনও দৌড়ে বেড়ান, খবর খোঁজেন, লেখায় নাম বের হয় তাঁর। আর তিনি খুশী হন। আমার ব্লগ এ তাই আমার সেই সাদা জীবনের কালো কথায় স্যার কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকীর কথা লিখে ফেললাম। যাঁকে দেখে একদিন আমার মনে হয়েছিল সাংবাদিক হতে পারলে অনেক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠা যায় খুব সহজেই। যদিও সেটা হতে পারিনি আমি।
কিন্তু স্যারকে প্রনাম জানাই আমি। ভালো থাকবেন আপনি স্যার। আরও লিখে যান এইভাবেই। আপনাকে না দেখলে হয়তো এইটুকু কাজও করতে পারতাম না আমি। এই শিক্ষা পেতাম না যে সাংবাদিকতা করে হয়তো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠা যায়। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে,কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সেটাকে কাজে লাগাতে হয়না। শুধুই খবরের কাজে লাগাতে হয় নিজের সোর্সকে। এই শিক্ষা সেদিন আপনার থেকে পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আজও আমি মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি আজও। এই আশীর্বাদ করবেন আপনি সেটা মেনে যেনো বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতে পারি। আমার প্রনাম নেবেন স্যার আপনি।
আমার স্যার কাজীদা - অভিজিৎ বসু।
ঊনত্রিশ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন