শিশু দিবসের দিন পার হয়ে রাত্রি হয়ে গেলো। মনে হলো এই বিশেষ দিনে আমাদের যে শিশু আজ আর কদিন বাদেই স্নাতক হয়ে যাবে, একদম ছোট থাকলেও আজ যে অনেকটাই বড়ো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে একটু একটু করে। যার পিঠে কদিন বাদেই ছাপ পড়বে জাপানিজ ভাষা নিয়ে পড়ে গ্রাজুয়েট হবার। অনেক কষ্ট করে অনেকের সাহায্য নিয়ে আর ভালবাসা নিয়ে যে পড়ছে কলেজে। সেই বুটার ছোটকালের ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো আমার কত কথা।
সেই শ্রীরামপুরে ওয়ালস হাসপাতালে ওর জন্ম হওয়া। সেই মাত্র তিনশো বারো টাকা বা পাঁচশো বারো টাকায় সরকারি হাসপাতালে ওর জন্ম হওয়া। তখন নার্সিং হোমের ব্যবস্থা করা হয়নি কোনো ভাবেই অর্থের অভাবেই। সেই ওর প্রথম পনেরো দিন ওর দিদার বাড়ী অঙ্কিত এ থাকা। আর সেই মেয়ে হবার খবর শুনে আমার একটু মন খারাপ হয়ে যাওয়া হাসপাতালে দাঁড়িয়ে একা একাই।
তারপর অঙ্কিত এ গরমে না থাকতে পারে নন্দী মাঠে ইটিভির অফিসে চলে আশা বুটার আর ওর মার। আর সারারাত আমার কোলে চেপে ঘুরে বেড়ানো কেমন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা। আর কাবা কাবা বলে ওই ছোট্ট মেয়েকে শান্ত রাখা সারারাত জেগে। সেই তো প্রথম প্রেমের শুরু একটি শিশুর সাথে একজন অনভিজ্ঞ পিতার বা বাবার। যে অনুভূতির শরিক হয়ে বেশ ভালোই লেগেছিল সেই দিন। যা এতদিন পরে বুঝতে পারি আমি।
সেই বোধহয় ওই কিছু না বুঝতে পারা শিশুর অবাক চোখে কেমন পিটপিট করে চাওনি দেখে আমার কেমন আকুল হয়ে যাওয়া। ওর কষ্ট দুঃখ আর আনন্দের শরিক হয়ে যাওয়া দ্রুত ভাবেই। একটা ছোট্ট নরম তুলতুলে জীবনের সঙ্গে একটা কঠিন কঠোর দৌড়ে বেড়ানো জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করা। যে অসম চেষ্টা আজও এই বয়সেও করে চলেছি আমি আর বুটা দুজন মিলে সব সময় যুদ্ধ আর শান্তির বাতাবরণে হাসি মুখে।
হয়তো কোনো সময় সেই চেষ্টা সফল হয় আবার কোনো সময় সেই চেষ্টা সফল হয় না। যা নিয়ে মনান্তর আর মতান্তর এর মাধ্যমে দুজনের সেই আগেকার নরম তুলতুলে গোলাপী আভার সম্পর্ক আজ অনেক কঠিন কঠোর আর ফালতু হয়ে গেছে হয়তো। আমিও কেমন বেবাক বোকা হয়ে গেছি, ফালতু হয়ে গেছি আজ সংসারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায়। তবু সেই শিশু দিবসের দিনে, রাতে এই ঘুম না আসা চোখে ভেসে ওঠে সেই ওর নানা কথা আর নানা ছবি।
ওর দু চোখের মিষ্টি চাওনি। ওর ওই ছোটো ক্ষুদে দাঁত বের করা হাসি, ওর দুষ্টু মুখের চাওনি আমাকে বিমোহিত করে এই এত বছর পরেও কেমন করে বুড়ো হয়েও। ওর কাছে এত গাল মন্দ শুনেও কেমন যেনো মনে মনে ওকে বড়ো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে আমার সবার কাছে ফালতু হয়ে গিয়েও। যে সময়ে মেয়ে বাবাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে সেই সময়ে ছবিটা উল্টো হয়ে গেছে যেনো আমার এই কপাল এর ফেরে। তবু সব কিছুই ভুলে যাই ওর সেই আকুল করা বু ডাক শুনে।
তবু আজ এই শিশু দিবসের দিনে ওই ছোটো মেয়ের ছবিকে দেখে কেমন যেনো থমকে যাই আমি। বড্ড মায়া পড়ে যায় আমার ওই ছবি দেখে। যার জন্য একদিন হাসপাতালের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল যে ছেলে হলো না আমার মেয়ে হলো কেনো। আজ মনে হয় সন্তান তো সন্তানই। সে যেই হোক আর তাই এতদিন পর মনে হয় সেদিনের ভাবনা আমার ভুল ছিল একদম। সেই নরম ছোট্ট মেয়ের কান্না, আমার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা যে কখন আমার এই কঠোর কঠিন মনকে জয় করে নিয়েছে আমি জানতেও পারিনি নিজে নিজেই।
আজ সেই ছোটো মেয়ে আমায় বাঁচিয়ে রাখে আমার এই কর্মহীন অবস্থায়। সেই ছোটো মেয়ে আজ বড়ো হয়ে আমায় চোখ পাকিয়ে বলে, ওই সব মহাভারত লিখে, ব্লগ লিখে আর কি হবে কে আর এসব পড়ে তোমার লেখা। আবার আমি যখন রাগ করে অভিমানে না খেয়ে শুয়ে পড়ি তখন সেই মেয়েই তো রাতের অন্ধকারে মাঝ রাতে এসে বলে চলো দুজন মিলে একসাথে খেয়ে নি দুটো ভাত। না খেয়ে শুয়ে পড়লে শরীর খারাপ হবে কিন্তু বু। আর আমি উঠে পড়ে ওর কথা শুনে রাগ অভিমান ত্যাগ করে খেয়ে নিই দুজন মিলে।
এটাই বোধ হয় আজকের এই শিশু দিবসে আমার বাড়তি পাওনা। যে শিশুকে আজ আমি আর ছাতা দিয়ে আগলে রাখতে পারি না বহুকাল। যাকে অন্যর ভরসায় আর সাহায্য নিয়ে পড়তে হয় আর বেঁচে থাকতে হয়। সেই আমার ছোট্ট বুটা আজ কেমন করে যে দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেলো কে জানে। যাকে আর নিজের পছন্দ মত অনেক কিছু জিনিস কিনে দিতে অপারগ পিতা আমি।
তবু শিশু দিবসের দিনে সেই আমার ছোট্ট শিশুর ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে যাওয়া, আর আমাকে আগলে রাখা কেমন যেন মোহিত করে দেয় এই শেষ বয়সে এসে। মনে হয় ছোটো শিশুর ওই ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে আছে যে কত কিছুই কে জানে। তাই শুধু এটাই বলবো যে, আমার বুটা বড়ো হলেও যেনো সেই ছোটই থেকে যায় আমার কাছে সারা জীবন।
যে আমায় চোখ পাকিয়ে বকবে, আবার ভালোবেসে রাতের অন্ধকারে ভাত খেতে ডাকবে। শিশু দিবসে এটাই চাইবো আমি ভগবানের কাছে। ওর সেই হাসি, ওর নির্নিমেষ দৃষ্টি, সারা জীবন সেই ছোট্ট মেয়ে হয়েই যেনো বুটা আমার কোলে কাবা কাবা গান শুনে অবাক চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে। আর আমি ওকে মোহিত হয়ে দেখি আর দেখি। আমার বুটা যেনো বড়ো না হয়। শিশু দিবসে এটাই আমার চাওয়া।
আমার বুটা ও শিশু দিবস - অভিজিৎ বসু।
চৌদ্দ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন