সুদূর গঙ্গারামপুর থেকে সাংবাদিক হতে কলকাতা এসেছিল ক্যামেলিয়া কেমিস্ট্রি। যদিও তার পদবী সান্যাল বোধহয়। তাকে আমি কেমিস্ট্রি বলতাম। হ্যাঁ, কিন্তু সে নানা অফিসে ঘুরে ঘুরে সাংবাদিক হবার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে সাংবাদিক হবার পর জীবনে যে ঝড় ঝাপটা সামলে এগিয়ে যেতে হয় একজন দক্ষ সাংবাদিককে। সেই অনেক ঝড় ঝাপটা সে এই কম বয়সেই সামলে নিলো সে তার নিজের এই ছোট্ট জীবনেই।
যে ঝড় সামলে সে আজ সাংবাদিক না হলেও কেমন একটা ছন্দহীন, শব্দহীন, অনুভূতিহীন , আবেগহীন মানুষ হয়ে গেছে। হ্যাঁ, ওকে আমি এই নামেই ডাকি। এই নামেই সেভ করা আছে ওর নম্বর আমার মোবাইল ফোনে। যে যাদবপুর থেকে কেমিস্ট্রি বিষয় নিয়ে পড়ে চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে ইন্টার্নশিপ করতে এসেছিল একদিন। সাংবাদিক হিসেবে কলকাতা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হাজার ঝড় বৃষ্টি জল কাদা সামলে এখন সে একদম শান্ত সমুদ্রের মতই স্থির একটি মানুষ। সাংবাদিকতা পেশা নয়, অন্য পেশায় মনোনিবেশ করে দিব্যি বেঁচে আছে আজ সে।
জীবনের এই ওঠা আর নামাকে এই কম বয়সে সে খুব সামনে থেকে দেখে এটা বুঝেছে আজ এই পৃথিবীতে সে আজ বড়ো একা। একদম একা। জীবনের লড়াই নিজেকেই লড়ে নিতে হয়। জীবনের এই রসায়ন তাকে আজ কঠিন কঠোর পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এগিয়ে চলতে শিখিয়েছে বুকের মাঝে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রেখে সংগোপনে। আর তাই এই শহরে হাসি মুখে আবার ঘুরে দাঁড়াবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে সে একটু একটু করে।
আজ বহুদিন পর ওর ফোনটা পেলাম আমি। মাঝে ওর জীবনের পর পর দুটো ঘটনা যা আমি জানি। সেই ঘটনার অভিঘাত, ওকে বেসামাল করে দিয়েছে। মাকে নিয়ে কোনরকমে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে সে এখন আবার বর্তমানে। গঙ্গারামপুরের সেই সব দিনগুলো ওর মনে পড়ে যায়। সেই ওর বাবার কথা। সেই ওদের বাড়িতে নানা মানুষের আনাগোনার কথা। বিখ্যাত ব্যক্তির বিখ্যাত বাড়ির একমাত্র মেয়ে সে। আদুরে কন্যা হলেও গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছিল জেলা থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে সে। আর সেই সূত্রে রসায়ন নিয়ে পড়ার পর সাংবাদিকতা শিখতে চলে আসা চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে। ওখানেই দেখা হয়েছিল ওর সাথে আমার।
হাতে কলমে সাংবাদিকতা শিখে, কাছ থেকে ক্রাইম রিপোর্টার এর আর নানা রিপোর্টারদের সান্নিধ্যে পেয়ে, খবরের বৃত্তে ঘুরে বেড়ানো আর সেই সব স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোকে সামনে থেকে একটু দেখা। যদি সাংবাদিক হতে পারে আর সুযোগ পায় এই আশায়। কিন্তু আমি ওকে বারন করেছিলাম, বারবার বলেছিলাম এই রাস্তায় না হাঁটাই ভালো তোমার। তুমি অন্য পথ দেখো। অনেক পরে অবশেষে সে সেই অন্য পথকেই ও বেছে নিয়েছে। এখন তো মাকে নিয়ে ও আবার ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
টোটো চালকের কাছে ফোন এলো ক্যামেলিয়া কেমিস্ট্রির। এটা আমাকে বেশ মজা দেয় কিন্তু। বহুদিন পরে শুনলাম ওর গলা দাদা কেমন আছো তুমি। সেই ওদের মাস্টার এর মত পোদ্দার কোর্টের অফিসে সৌম্য সিনহার চশমা পরে বসে থাকা। সেই প্রবাল, কুশল, শুভ্রজিৎ আইচ, মধুবন্তী আর দেবমতীর ভরা সংসার। সেই তিন্নি, পত্রলেখা, অদিতির হাসি মুখে অফিস করা। সেই ব্রেকিং লেখা জয়ন্ত।
আর এইসবের মাঝেই একটু কড়া শাসন আর সেই ঘেরাটোপে থেকে কাজ করার চেষ্টা করা। কে একটু ভালো সুযোগ পাবে, কে কোন রিপোর্টার এর সাথে একটু রাস্তায় বের হতে পারবে তার প্রতিযোগিতায় অনেকেই কিন্তু নাজেহাল অবস্থা হলেও কেউ কিছুই বলতে পারতো না কাউকে। সকাল না বিকেল কোন সময় আসতে হবে সেই নিয়েও চলতো দড়ি টানাটানি। যাকগে এসব তো জীবনের শিক্ষার অঙ্গ। কারণ সেই সই করা সার্টিফিকেট এর যে বড়ো দাম এই শিক্ষানবীশ সাংবাদিকদের। যেটা আর ক্যামেলিয়া কেমিস্ট্রির কোনোদিন নেওয়া হয় নি মনে হয় আর তার শিক্ষানবীশ গুরুর কাছ থেকে।
সেই ক্যামেলিয়ার সাথে একদিন সেক্টর ফাইভ চত্বরে দেখা হয়েছিল আমার। সুন্দর হাসিখুশি জীবন নিয়ে মেয়েটি ভালই আছে বেশ। পুরুলিয়ার সেই বিখ্যাত ভাঙা গলার তাপসীও ছিল সেদিন ওর সাথে। দুজনের ভালো বন্ধুত্ব ছিল ওদের। কিন্তু তাপসী একটু এগিয়ে গিয়ে টিভি নাইন এর সিঁড়িতে পা রাখতেই বন্ধুত্ব উধাও। যদিও এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এটা নিয়ে লেখা বা হৈ চৈ করার কোনো দরকার নেই আর মন খারাপ এর দরকার নেই ক্যমেলিয়া। জীবন তো এমন ভাবেই চলে।
তোমার জীবনের সবথেকে কাছের বন্ধু যে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলো। তুমি অনেক লড়াই করেও তো আটকে রাখতে পারলে না তাকে। তুমি তো চেষ্টা করেছো আপ্রাণ শেষদিন পর্যন্ত। এটাই বোধহয় আসল কথা। জীবনের গভীর গোপন যন্ত্রণার আঁধার রাতের মাঝে লুকিয়ে থাকে এই একটুকরো চাঁদের আলো আর কিঞ্চিৎ ভালোবাসা। যাকে শুধু অনুভব করতে হয় চুপটি করে একা একা।
যাকগে আজ আর মন খারাপ এর কথা নয়। আজ আর পুরোনো ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকে শুধু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখা নয় পাতা উল্টে পাল্টে। আজ শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলার কথা। যেখানে তোমার পাশে তোমার মা আছেন, তোমার আত্মীয় স্বজন, পরিজন, কাছের বন্ধুরা আছেন। যাদের সঙ্গে নিয়ে আবার তুমি নিশ্চয় জীবনের নতুন রসায়ন দিয়ে, আবার ঘুরে দাঁড়াবে এই কঠিন কঠোর শক্ত পাথুরে জীবনে।
যেখানে আবার নিশ্চয়ই একদিন ফুল ফুটবে, নতুন ভোর এর আলো ফুটবে, আবার পাখি ডাকবে। আর তুমি সেই উজ্জল শ্যামলা মুখের হাসি নিয়ে এগিয়ে যাবে ল্যাবরেটরিতে কেমিস্ট্রির পরীক্ষার মত। যেখানে পজিটিভ অনুঘটক থাকবে, নেগেটিভ অনুঘটক থাকবে। আর তুমি সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে আবার নিশ্চয়ই একদিন ঘুরে দাঁড়াবে এই জীবনের পথে। ভালো থেকো ক্যামেলিয়া কেমিস্ট্রি।
ক্যামেলিয়া কেমিস্ট্রি - অভিজিৎ বসু।
পাঁচ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন