'দিদি ঘুমোচ্ছে?' সর্বজয়ার কোলে মৃত দুর্গাকে দেখে এই প্রশ্ন করেছিল ছোট্ট অপু। তার সরল মন মৃত্যুর কঠিন বাস্তব সম্পর্কে কিছুই জানত না। সে বুঝতেই পারেনি দিদির কি হলো। ১৯৫৫ সালে দুর্গা মারা গেছিলেন সিনেমার পর্দায়। ছোট্ট অপু তার প্রিয় দিদিকে হারিয়ে একা হয়ে গেলো। কিন্তু সেই মৃত্যু তো শুধু হয়েছিল সাদা কালো পর্দায়, জীবনে নয়।
এরপর আবার এই দীর্ঘ এতগুলো বছর বাদে ২০২৪ সালে মারা গেলেন দুর্গা। আজ সত্যিই দিদিকে হারালেন সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আমাদের সবার প্রিয় ছোট্টো অপু। নিজের ছোট্ট 'অপু'কে ছেড়ে চলে গেলেন 'দুর্গা' উমা দাশগুপ্ত। দূরে অনেক দূরে। সেই নিশিন্দিপুরের মাঠ পেরিয়ে, সেই ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে, সেই জলা জঙ্গল আর কাশফুলের বন পেরিয়ে, সেই প্রথম রেলের কু ঝিক ঝিক আওয়াজকে পিছনে ফেলে, সেই আম , জাম, পিয়ারা গাছগাছালিকে পিছনে ফেলে দুর্গা আজ সত্যি সত্যিই চলে গেলেন তার প্রিয় ভাই অপুকে ছেড়ে। দূরে অনেক দূরে। যেখানে এই যে ভাই আর দিদির অমলিন জুটি। যে সম্পর্কের নিনড় বাঁধন এতদিন বাঁধা ছিল দুজনের সেই সাদা কালো ছবির মত নিজেদের জীবনেও। সেটা আজ ছিন্ন হলো খাতায় কলমে। একদম সত্যিই করেই।
হ্যাঁ, বয়স হয়েছিল। কিন্তু ভাইয়ের মন যে মানে না। "আরও কিছুদিন থাকলে ভালো হত", বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। ১৯৫০ সালে অপুর চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫১ সালে 'পথের পাঁচালী'র শুটিং শুরু হয়েছিল। অপু-দুর্গা হিসেবে সেই উমা দাশগুপ্ত ও সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু। ভাই-বোনের যে সম্পর্ক ক্যামেরার সামনে গড়ে উঠেছিল, তা অফস্ক্রিনেও সমানভাবে ছিল। উমা দাশগুপ্তর মৃত্যুসংবাদ পেয়েই কেঁদে ফেলেন সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম, সেই মাঠ, সেই আম গাছ পিয়ারা গাছ আর নারকেল গাছের তলায় খেলনা বাটির সংসার পাতা অপু আর দুর্গার। ছয় বছরের ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে হাজার কষ্টের মাঝেও কেমন করে ভালোবাসার স্পর্শে ভাইকে নিয়েই বেঁচে থাকা। সেই গ্রামীন পাঠশালা, জীবনের এই সব পারিবারিক নিটোল সম্পর্কের এমন সাদা কালো ছবির অনন্য চরিত্র দুর্গা আজ মারা গেলেন। একা হয়ে গেলেন অপু।
পথের পাঁচালী হল প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলার গ্রামে দুই ভাইবোন অপু আর দুর্গার বেড়ে ওঠা নিয়েই বিখ্যাত এই উপন্যাস। এই উপন্যাসের ছোটোদের জন্য সংস্করণটির নাম আম আঁটির ভেঁপু। পরবর্তীকালে বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসটি অবলম্বনে পথের পাঁচালী (চলচ্চিত্র) নির্মাণ করেন যা পৃথিবী-বিখ্যাত হয়। কিন্তু এই বিখ্যাত সিনেমাও নাকি অর্থের অভাবে তৈরি করা যায়নি।
পথের পাঁচালির চরিত্রে সেই সর্বজয়া, হরিহর, ইন্দির ঠাকুরূন, অপু আর দুর্গা। কিন্তু আশ্চর্য হলো প্রথম এই গল্প লেখার সময় বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় কিন্তু দুর্গার চরিত্রের কথা ভাবেননি। বিহারের ভাগলপুরে থাকার সময়ে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেন। সেই সময় তিনি এক সেরেস্তায় ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে তিনি এই লেখার কাজে হাত দেন। তৈরি করতে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত লেখা।
সেই সময় তিনি নানা কাজে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন বিকেলে এক দেহাতি গ্রাম্য কিশোরীকে দেখতে পান বিভূতিভূষণ। মাথায় রুক্ষ চুল, হাওয়ায় উড়ছে সেই চুল। এক অদ্ভুত মুখের সারল্য। সেই দৃশ্য দেখেই তো তিনি দুর্গার চরিত্র নিয়ে ভাবেন আর কল্পনা করেন। আর তাঁকে প্রায় নতুন করে ফের এই বিখ্যাত উপন্যাসটি লেখা হয় আবার। ১৯২৮ সালে এই লেখার পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেন তিনি। প্রায় তিন বছর লাগে এই লেখার কাজ শেষ করতে। সেই সময় তিনি বড়বাসা তে ছিলেন। এরপর তো সবটাই ইতিহাস।
আসলে ইতিহাস বোধহয় এইভাবেই সৃষ্টি হয়। যে চরিত্র প্রথমে কল্পনায় ছিল না লেখকের। পরে সেই চরিত্রের সৃষ্টি, সেই চরিত্রের চিত্রন একটা নতুন সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিলো। দিদি আর ভাই এর অমলিন সম্পর্কের মেঠো পথে কত যে স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই মানুষটাই আজ চলে গেলেন। আমাদের সবার দুর্গা। যাকে ঘিরে এত কিছু কথা। সেই অপু আর দুর্গার চির চেনা জুটি আজ ভেঙে গেলো সত্যি সত্যিই।
ভেঙে গেল অপু- দুর্গার জুটি - অভিজিৎ বসু ।
উনিশ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য গুগুল ও ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন