দুর থেকে সেই মেলামাঠের অন্ধকার নাগরদোলায় হঠাৎ করেই কেমন আলো জ্বলে উঠলো। আর সেই থেমে থাকা নাগরদোলা কেমন করে যেনো ঘুরতে শুরু করলো ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে। মনটা আমার আনন্দে নেচে উঠল একদম ছোট্ট শিশুর মতই এই বুড়ো বয়সেও, এই পৌষের হিম মাখা কম শীতের সন্ধ্যায়। এই আলোকোজ্জ্বল নাগরদোলার সামনে ঠিক একবছর আগেই তো দেখা হয়েছিল আমার আর প্রসেনের সাথে দুজনের বহুদিন পরে, বহুবছর পরে। হাজার ভীড় আর ঠেলাঠেলির মাঝে বহুদিন পর দেখা হওয়া দুই কলেজের দুই বন্ধুর। বহুদিন পর এই মেলা মাঠেই খুঁজে পাওয়া একে অপরকে কলেজ জীবনের দুই বন্ধুর। আসলে এটাই তো মেলার আসল মাহাত্ম্য দুরকে কাছে এনে মিলিয়ে দেওয়া একে অপরের সাথে। মেলা যে এইভাবেই মিলিয়ে দেয় আমাদের সকলকে।
আমাদের কলেজ জীবনের সেই বেশ গুছিয়ে কথা বলা, হিসেব নিকেশ করে মেপে পা ফেলে চলা, কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে কাজ করা সেই হাসিমুখের প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত। সেই উত্তরপাড়ার সখেরবাজারের বিপিএমবি সরণীর বাসিন্দা প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত। সেই ওর গম্ভীর মুখের রাশভারী বাবা যিনি ইউকো ব্যাংকের ব্যাংক ম্যানেজার ছিলেন, সেই ওর হাসিখুশি মা যিনি ওদের বাড়িতে গেলেই আমায় সুন্দর ফুল ছাপ প্লেটে করে সাদা গরম লুচি খেতে দিতেন আর সাথে দিতেন নরম তুলতুলে বেগুন ভাজা, যে বেগুন ভাজার তেল সাদা প্লেটে গড়াগড়ি খেত কেমন হাসিমুখে ওদের সুন্দর গোছানো জীবনের মতই , আমি প্রসেনজিৎ এর বউকে বলেছি একদিন এমন গরম সাদা লুচি খেতে যাবো ওদের কলকাতার বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গেই হ্যাঁ বলেছে ওর বউ। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়া যে খুব কঠিন কাজ।
সেই সুন্দর ওদের বাড়ি, সুন্দর সেই ভারী পর্দা দেওয়া ড্রয়িং রুম, পর্দা ভেদ করে জানলার ফাঁক গলে হলুদ রোদ্দুরের লুটোপুটি, সেই একতলার ঘরের আড্ডা, সেই ওদের ছাদে সুন্দর ফুলের বাগান, সেই সুন্দর নতুন চেহারার ওপেন কিচেন যা সবে বাজারে এসেছে মাত্র, সেই আমরা দুজন নতুন ব্যবসা করবো বলে বি এস ট্রেডার্সের বোস আর সেনগুপ্ত ট্রেডার্সের প্যাড ছাপিয়ে ফেলা, সেই একসাথে বোলপুরে গ্রামে জমি কেনা হবে,শহুরে জীবন ছেড়ে থাকা হবে বলে নানা প্ল্যান করা আমাদের দুজনের। সেই নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলোচনা করে হাত ফসকে যাওয়া সস্তার গ্রামের জমি, এমন কত যে পরিকল্পনা করা হলো এই আমাদের দুজনের জীবনে তার কোনও ঠিক নেই আর।
প্রসেনজিত এর বউ আর আমরা তিনজন মিলে এই নাগরদোলাকে পিছনে রেখেই তো সেই এক বছর আগে ১৪৩০ সালে ছবি তুলেছিলাম সবাই মিলে। একটি বছর আগে এই পৌষ মেলার মাঠে। আসলে পৌষের মেলা তো এইভাবেই বোধহয় দুরকে কাছে টেনে নিয়ে এসে হাজির করে এই মেলার শিশির ভেজা কুয়াশামাখা মাঠে একে অপরের কাছে। এই মেলা তো তাই বহু মানুষের কাছেই হারিয়ে যাওয়া জীবনের স্মৃতি, সেই নানা হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ফিরে পেয়ে কাছ থেকে দেখার এক মিলন মেলা। যে মেলা আমাদের প্রাণে, মনে, আত্মায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই পৌষের হিম মাখা সন্ধ্যায় পুরোনো কৌলিন্য ছেড়ে আধুনিকা হয়ে শিফন শাড়ি পরে।
আর তাই হঠাৎ করেই টাইম ঘড়ির কাঁটাকে নিজের হাতে ঘুরিয়ে পিছনে টেনে এনে ফোন করে ফেললাম আমি প্রসেনকে। বললাম সেই এক বছর আগে তোদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল এই নাগর দোলার সামনে। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে ওর উচ্ছাসহীন গলার আওয়াজ শুনলাম আমি তাই নাকি। তোরা মেলায় আজ তো মেলা শুরুই হয়নি রে। আসলে এই শুরু, আর শুরুর আগের এই ফাঁকা মাঠে সেজে ওঠা মাঠে ঘুরে বেড়াতে আমার বেশ মজা লাগে।
মেলার মাঠের খুট খাট আওয়াজ, সস্তায় জিনিস কেনার নেশায় অন্ধকার মাঠে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ক্রেতার দল, সেই মাটিতে চট বিছিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার হার আর চুড়ি বিক্রি করা, সেই টাকা দিয়ে স্টল নিয়ে কাল থেকে বিক্রির আশায় তাড়াতাড়ি রান্না করে মেলা মাঠে কাপড় টাঙিয়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া, সেই মাঠের মাঝে এদিক ওদিক ভাপা পিঠের গন্ধগোকুল ছড়িয়ে পড়া, সেই আদিবাসী মহিলার একটি সুতির শাড়ি পরে বেতের বোনা ধামা কুলো নিয়ে চুপটি করে বসে থাকা গেটের সামনে, এর জন্যেই তো ছুটে আসা আমার এই মেলার উদ্বোধন এর আগেই ৬ ই পৌষ এর সন্ধ্যায়।
সেই মেলা মাঠের বাইরে বাবা মাকে সাহায্য করা রুটি তৈরি করা এক পরিবারের দুই শিশু একজন ক্লাস টু তে পড়ে বোন স্কুল যায়না এখনো। যেমন গরম রুটি তৈরি হলেই সেটাকে ভরে রাখছে অন্য এক পাত্রে পরম যত্নে পরম মমতায় দাদা আর বোন। এই জীবন দেখার নেশা যে আমায় তাড়িয়ে বেড়ায় সারাটা জীবন ধরেই। সেই জীবনকে দেখো জীবন হলো আসল শিক্ষক।
সেই বুদ বুদ ছাড়া জীবন এর খেলনা বেচা রামপুরহাটের মোক্তার, সেই নদীয়ার চাকদা থেকে আসা মেলা মাঠের বাইরে পুলিশ লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির আপন মনে ঢোল বাজানো। যে জানেই না রাতে সে শোবে কোথায়। আগের বছর নয় হাজার টাকা খরচ করে মেলার ভিতর স্টল নিলেও সেই টাকা ওঠেনি মেলায় বিক্রি করে আগের বছর। এইবার আর তাই সে রিস্ক নিতে পারেনি কিছুতেই। তাই মাঠের বাইরে অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর। যদিও পুলিশ বলে গেছে এইভাবে দাঁড়ানো যাবে না আর কাল থেকে, আর ঢোল বাজানো যাবে না আর কোনও মতেই। কি করবে সে নিজেও জানে না যে। ঘরে ফিরবে কি এইবারেও খালি হাতেই এই মেলা মাঠ থেকে। লাভ আর ক্ষতির হিসেব না মেলাতে পেরে। সত্যিই তো এই মেলার টানেই যে ছুটে আসা আমার।
রাত পোহালেই ৭ই পৌষ ভোর থেকে বৈতালিক এর পরেই শুরু হয়ে যাবে পৌষ মেলা ১৪৩১। আসলে কি জানেন তো এই মেলার শুরুর আগের সন্ধ্যায় আমিও কেমন যেন একটু ওয়ার্ম আপ করে নিলাম বাকি কদিনের জন্য। বুটাকে নিয়ে, সোমাকে নিয়ে। আর আমার এলোমেলো এলেবেলে জীবনকে নিয়ে।
যে জীবনের চারিধারে শুধুই কুয়াশার ঘনও সাদা আস্তরণ। সেই সাদা আস্তরণ পার হয়ে পৌষের সন্ধ্যায় আমরা তিনজন মিলে সেই আলোর খোঁজে অন্ধকার নাগরদোলার কাছে চলে এলাম হাঁটতে হাঁটতে। আর কেমন হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল আলো। ঘুরতে থাকলো থেমে থাকা নাগরদোলা আপনমনে, আপন ছন্দে, আপন খেয়ালে। আমরা তিনজনেই কেমন আনন্দে ছোট্টো শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে উঠলাম। আমাদের তিনজনের মেলা যে শুরু হয়ে গেলো উদ্বোধনের একদিন আগেই।
শুরু হলো পৌষ মেলা ১৪৩১ - অভিজিৎ বসু।
তেইশ ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি নিজস্ব মোবাইল ফোনে তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন