সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধুই বড়োর কথা। হ্যাঁ , তাকে আমরা সবাই বড়ই বলতাম আর কি। কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা সমীহ করেই। আসলে কি জানেন তো ছোটদের কি আর বড়োর কথা লেখার সাহস দেখানো উচিৎ। তবু কি করবো আমার এই ছোটো, বড়ো, মেজো, সেজো সবার কথাই মনে পড়ে যায় আজকাল আমার মাঝে মাঝেই, এই বুড়ো বয়সে এসে।
সেই কবে যে পল্লীডাক প্রেসে সন্ধ্যাবেলায় দেখে ছিলাম তাকে, কত সাল মনে নেই আজ আর সেটা দু হাজার সাল হবে। বেশ সুন্দর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা একটা চেহারা। মুখে হালকা একটা দাড়ি। জামা গুঁজে পড়া। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা। মুখে অল্প স্মিত হাসি। কোনোদিন কোনো বিষয়ে রাগতে দেখিনি আমি তাকে। যেটা বোধহয় একটা মানুষের বড়ো গুণ তাঁর। হাসি মুখে পেছনে খবর করে দেখিয়ে দেওয়া দেখ কেমন লাগে ভাবটা বরাবর এমনই ছিল।
যাকগে এই বড়ো নামটা খুব সম্ভবত ফাল্গুনী দা দিয়েছিল সেই সময়। বড়ো কাগজে কাজ করা সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় কাজ করা রিপোর্টার মানেই তো বড়ো সেই আমাদের সবার থেকেই। বলতে বাধা নেই যে পল্লীডাক প্রেসে সেই বড়োর খাতির যত্ন একটু আলাদাই ছিল সেই সময়, অন্তত আমার তেমন মনে হয়েছে। একটু সমীহ করেই দেখতো সবাই তাকে। আর নবরত্ন সভায় শ্রেষ্ঠ রত্ন হিসেবে পরিচিত ছিল একমাত্র সেই। বড়ো বলেছে, বড়ো খবর করেছে, বড়োর কাগজে বেরিয়েছে এটাই ছিল মাপকাঠি অন্য সবার কাছে। আর সেটা নিয়েই আলোচনা সারাদিন।
আর আমি তখন নতুন কাছ থেকে সাংবাদিক নামক অন্য গ্রহের জীব দেখে একদম আমিও কেমন যেন প্রেমে পড়ে গেলাম আরকি। এই প্রেম ভালোবাসা একটু একটু করে পেকেও গেলো কি করে কে জানে। কাঁচা পেঁপে যেমন পেকে যায় ঠিক তেমনি করেই কাঁচা বয়স তো। আসলে কেউ কেউ বলবেন সেটা হলো বড়ো কাগজের বড়ো রিপোর্টার এর গন্ধ আছে বলেই প্রেমে পড়ে যাওয়া। আবার কেউ বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা এই নিয়মেই জীবন চলে। কিন্তু আমার তেমন কিছুই মনে হয়নি। নানা জনের মাঝে একটু আলাদা রকমের সম্পর্কের টুং টুং জলতরঙ্গের শব্দ আর কি।
সেই উত্তরপাড়ার শিবতলার অন্ধকার মাঠ, সেই রাস্তার পাশে পুরোনো একটা দোতলা বাড়ী, সেই দোতলার ঘরে লাকী দি আর বিশ্বনাথদের বাড়ী যাওয়া মাঝে মাঝেই। জোর করে আমাকে মিষ্টি খেতে দেওয়া। সেই উত্তরপাড়ার কাঁঠাল বাগান এর জেরক্স এর দোকানে বলে দেওয়া। পাঁচ টাকা লাভের আশায় জেরক্স এর কাগজ এর বান্ডিল দেওয়া সেই দোকানে। ক্যানিং স্ট্রীট থেকে কাগজ বয়ে আনা ব্যাগ করে। তারপর সন্ধ্যা বেলায় ঘুরে ঘুরে সেই কাগজ বিক্রি করা। সত্যিই কত কিছুই যে মনে পড়ে যায় আজকাল।
সেই আমার বিয়ের কাগজে উকিলের সামনে সই করতে হাজির হয়ে যাওয়া সকাল বেলায় পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে। যে বিয়ে নিয়ে আমার বাড়ীর লোকের আপত্তি অশান্তি ছিল কত। আমার মার কত কান্না জমেছিল, সেই মা আজ আর নেই। সেই আমার বিয়ের সময় লাকী দি বা রাখী দি মনে নেই নামটা সঠিক সেজে গুজে আসা গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে তাদের নিয়ে আসা উত্তরপাড়া থেকে গোগল তখন কত ছোটো ছিল। সেই গোগল আজ কত বড়ো হয়ে গেছে হয়তো। সেই বুটার প্রথম জন্মদিনে শ্রীরামপুরে বটতলায় ইটিভির অফিসে হাজির হয়ে যাওয়া সবাই মিলে কেক কেটে কত আনন্দ করা। দুই পরিবারের সদস্যদের কত যে স্মৃতি ছড়িয়ে আছে।
এমন কত যে স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের পরিবারে সেটা আর বলে শেষ হবে না। আসলে জীবন তো এমনই। জড়িয়ে আর ছড়িয়ে বেঁচে থাকা। আর একসময় সবকিছুই কেমন আলগা হয়ে যাওয়া ধীরে ধীরে। যাকে নিয়ে এত কথা লেখার বাসনা হলো সেই বড়ো রিপোর্টার এর জন্মদিন দেখেই মনে হলো লিখে ফেলি দু চার লাইন। আমার টোটো চালকের কলমে।
হ্যাঁ, সেই নাটক ভালোবাসা, লিখতে ভালোবাসা, হুগলী জেলার একনম্বর আনন্দবাজার কাগজের বিখ্যাত সাংবাদিক গৌতম বন্দোপাধ্যায়। আমাদের সবার জেলার গৌতমদা। যাকে রাজনীতির যে কোনো নেতা, নেত্রী, পুলিশ, উকিল, প্রোমোটার, ডাক্তার, রিক্সাওলা সবাই যাকে বেশ সমীহ করেই চলে। আনন্দবাজার পত্রিকা বলে কথা।
সেই ফেসবুকের দেওয়ালে জন্মদিন এর ঘোষণা দেখে শুভেচ্ছা দেখে মনে হলো ছোটো সেই কুলবিচির কলমে টোটো চালকের কলমে ফাল্গুনীদার দেওয়া নাম আমায় কুলবিচি কিছু লিখে ফেলি এই আজকের দিনে। আজ আর আমি সাংবাদিক নয়। টোটো চালকের ভূমিকায় ভালোই অভিনয় করছি আমি। তবু সেদিন আমার মাকে রাতের বেলায় ভর্তি করে বাড়ী ফেরার পথে দেখা হলো উত্তরপাড়ার রাস্তায় গৌতমদার সাথে বহুদিন পর। দেখেই কেমন বললাম আমি মা ভালো নেই হাসপাতালে ভর্তি। মা চলেও গেলেন আমার হঠাৎ করেই। ভেবেছিলাম ফোন করে খবর নেবে না একদিন কিন্তু না ব্যস্ত হয়ে হয়তো ফোন করতে পারেনি আর আমায়।
সেই যেদিন ভোর বেলায় খবর পেলাম আমি প্রবীর দার কাছ থেকে অভিজিৎ, গৌতম বন্দোপাধ্যায় এর মা মারা গেছেন। মনে পড়ে গেলো সেই ভোরবেলার কথা, ছুটে গেলাম সেই শিবতলা শ্মশানে। দেখলাম কত লোকের ভীড়। সাদা কাপড় পড়ে অন্য এক ছবি গৌতম দার। তারপর ধীরে ধীরে বিশ্বনাথ বড়ো হয়ে গেলো, রিপোর্টার হয়ে গেলো একনম্বর চ্যানেলের। বদলে গেলো জীবন। বদলে গেলো জীবনের গতি প্রকৃতি। নদী পথের মতই ধীরে ধীরে। আলাদা খাতে বইতে শুরু করলো আমাদের জীবন।
আসলে আমার এই সাদা জীবনের কালো কথা তো এমন ভাবেই এগিয়ে চলে একটু একটু করে গুটি গুটি পায়ে। বড়ো কাগজ, বড়ো রিপোর্টারকে পাশে নিয়ে সবাই চলতে চায়। আর তাই মাঝে মাঝেই ফাল্গুনীদার মুখে শুনতাম একটাই কথা, বড়ো আর আমি বাকি তোরা সব এদিকে একদম ভিড়বি না কিন্তু যত সব ডেঙ ডোঙলার দল। একটু আলাদা থাকার চেষ্টা কিন্তু তাতে যে এক্সক্লুসিভ খবর খুব বিশেষ জুটে যেতো তার এমন নয়। তবু আরকি একটা আলাদা আলাদা থাকার চেষ্টা করা আর কি। মন্দ লাগতো না আমার এসব দেখে।
মাঝে মাঝেই আজকাল আমার ইচ্ছা হয় ফোন করে ফেলি আবার গৌতম দাকে। গল্প করি অনেক সময় ধরে। ছুটে যাই সেই পুরোনো দিনের স্মৃতি ঝলমল রাস্তা ধরে শিবতলার আলো আঁধারি মাঠে। কিন্তু না, জানি সেটা আর এখন সম্ভব নয়। মাঝে মাঝেই বলি এসো বোলপুরে চলে এসো। কথা হয় খুব কম। কে জানে সব কেমন আছে। লাকীদির সাথে কতদিন যে কথা হয়নি আমার। সেই দুজনে গৌতমদা আর লাকীদির একসাথে নাটক করতে যাওয়া। ফুল আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরা। সেই লাকীদির বাড়িতে গিয়ে বসে দোতলার সেই ঘরে বসে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা। বেশ ভালই ছিল দিনগুলো কিন্তু আমাদের।
যাকগে সেই বড়ো রিপোর্টার গৌতমদার জন্মদিন দেখেই তো এমন হাজারো কথা মনে পড়ে গেলো আজ আমার এই রাতের বেলায়। হয়তো আরও কিছু ছিল। যা লেখা পড়ে রইলো বাকি থেকে গেলো। তবু জীবনের এই নানা রং বেরংয়ের কথা জুড়েই তো জীবনের এই নকশী কাঁথার মাঠ। যে মাঠে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, ভালোবাসা দূরে ঠেলে দেওয়া, কাছে টেনে নিয়ে আশ্রয় দেওয়া আবার কখনও কখনও দূরে ঠেলে দেওয়া। এই ভাবেই তো বয়ে চলে আমাদের জীবন এলোমেলো এলেবেলে হয়েই। যে জীবনে বড়ো, মেজো, সেজো, ছোটো এমন কতজন যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার কোনো হিসেব নেই। আর তার মাঝেই এসবের মাঝেই সেই আমাদের সবার বড়ো, সেই গৌতম দা বড়ো হয়েই রয়ে যাবেন আমাদের সবার কাছে। শুভ জন্মদিন।ভালো থেকো তুমি।
আমাদের সবার বড়ো - অভিজিৎ বসু।
নয় ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন