সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক আদ্যন্ত নির্ভেজাল ভালো মানুষ আর ভালো পুলিশ অফিসার এর কথা। আমার এই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে যদিও বর্তমানে আমি এই পেশায় যুক্ত নয়, তবুও এমন হাসিখুশি ভালো মানুষ ভালো পুলিশ দেখিনি আমি। সে সাংবাদিকদের খবর দিয়ে সাহায্য করা এমন ভালো মনের পুলিশ অফিসার দেখিনি আমি। যিনি যে কোনো অবস্থায় যে কোনো খবরের কনফার্মেশন দিতে কোনো দ্বিধা করেননি কোনদিন অন্ততঃ আমায়। সে ভিন রাজ্যে থেকে কোনও বড়ো অপারেশন করতে গিয়ে ভালো কাজ করে সাফল্য অর্জন করে কলকাতায় ফেরার সময় হোক। কিম্বা নিজের হুগলী জেলায় এসপি থাকাকালীন অস্ত্র কারখানার হদিস পেয়ে হাজারও ব্যস্ততার মাঝে বাইট দেওয়া হোক। আসলে পুলিশ আর সাংবাদিকদের সম্পর্ক হলো সিম্বায়োসিস প্রক্রিয়ার মতই কাজ করে। দুজনেই একে অপরের পরিপূরক। আর সেই সম্পর্ক টিকে থাকে শুধুই খবর দেওয়া আর নেওয়ার মাধ্যমে। অন্য কিছুতে নয়।
সেই দিনটার কথা আমার আজও মনে আছে শ্রীরামপুর থানার আই সি তখন বিজয় হালদার। আমরা কোনো ভাবে খবর পেলাম যে বৈদ্যবাটিতে কোনো এক ভাড়া বাড়িতে প্রচুর অস্ত্র পাওয়া গেছে। পুলিশ পৌঁছে গেছে সেখানে। এসপি আসছেন। ব্যস দৌড় আর দৌড় আমি আর মিন্টে। দ্রুত আমরা মোটর সাইকেল নিয়ে পৌঁছে গেলাম স্পটে। দরজা বন্ধ করে তখন জোর কদমে পুলিশ বস্তা বস্তা বন্দুক আর নানা অস্ত্র ব্যাগে ভরছে থানায় নিয়ে যাবে বলে সেখানেই ডিসপ্লে হবে দেখানো হবে সাংবাদিকদের। আর এই খবর পেয়ে জেলায় আসছেন আই জি সাহেব স্বয়ং।
এদিকে এই খবর পেয়ে দ্রুত চুঁচুড়া থেকে এসে হাজির হুগলী জেলার এস পি অজয় কুমার। কিন্তু আমাদের ছবি হবে কি করে দরজা বন্ধ করে উদ্ধার এর কাজ চলছে যে ভিতরে। ভেতরে শ্রীরামপুর থানার পুলিশ। আমাদের দেখেই সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে একমুখ হাসি। কি খবর অভিজিৎ। আমি বললাম খবর তো আপনি দেবেন। ভেতরে একটু ছবি করতে দিন আমাদের। হ্যাঁ বা না বলে মৌন অবস্থায় যেনো সম্মতি জানিয়ে দিলেন তিনি। আর আমি আমার ক্যামেরাম্যান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লাম আর তারপর একদম থ হয়ে গেলাম আমরা। একি রাশি রাশি বন্দুক, কার্তুজ, আরও নানা অস্ত্র ব্যাগে বোঝাই করছে পুলিশ জোর কদমে। আর তার মাঝেই কেমন সুন্দর করে কি হয়েছে ইটিভির সেই লাল বুমে বাইট দিলেন আমায় তিনি অবিচল হয়ে। তারপর হেসে বললেন ঠিক আছে এইবার ছাড়ো আমায়। আইজি সাহেব আসছেন যেতে হবে। যতদূর সম্ভব এসেছিলেন কি চট্টোপাধ্যায় নামটা মনে পড়ছে না যোগেশ চট্টোপাধ্যায় কি, কে জানে।
আর এই সবের মাঝেই দ্রুত খবর এলো পোলবায় মিলেছে অস্ত্র কারখানার সন্ধান। জেলা জুড়ে হৈ চৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। একি অবস্থা আইন শৃঙ্খলার এই অবস্থা জেলা জুড়ে। বিরোধী রাজনীতির দল পথে নেমে পড়লো এই ঘটনায়। কিন্তু এতো বড় ঘটনার পরেও কেমন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করেছিলেন তিনি সেই কঠিন সময়ে। এত লুকিয়ে আড়াল করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাঁকে ফেস করতে হয়নি। সেই হুগলীর অস্ত্র রহস্য নিয়ে হৈ চৈ হলেও কেমন হেসে বেশ সুন্দর করে নিজেই সেই ঘটনাকে ফেস করলেন তিনি। অথচ তার জন্য তাকে বেশি কসরত করতে হলো না। এটাই হলো আসল কথা। এমন পুলিশের আজকাল দেখা পাওয়া ভার।
যার জন্যে একটি চ্যানেলকে বেছে খবর দিয়ে আর অন্য এক চ্যানেলকে খবর না দিয়ে পালাতে হলো না তাঁকে। এমন জনসংযোগ করেছিলেন তিনি সেই সময়। সেই পুলিশের অনুষ্ঠানে হলো বিখ্যাত কোন এক গায়িকা এলেন। নাম ভুলে গেছি আমি। চন্দননগরে অনুষ্ঠান হলো কুঠির মাঠে। আমরা সব গেলাম সাংবাদিকরা সেই অনুষ্ঠানে। বেশ আনন্দ উপভোগ করেছিলাম আমরা সবাই। এই যে মিশে যাওয়া সবাইকে কাছে টেনে নেওয়া এটা বেশ ভালো লাগতো আমার। দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকার পরে ব্যান্ডেল এর সৌরভ হাজরা এই অনুষ্ঠানে ধীরে ধীরে হাজির হলো অনেক কষ্ট করে নিজের পায়ে হেঁটে। ওকে এতদিন পর দেখেই ভালো ব্যবহার করলেন তিনি।
হুগলী জেলার এসপি থেকে বদলি হয়ে কলকাতা চলে গেলেন তিনি। মাঝে মাঝেই কোনো জরুরী খবর কনফার্ম করতে বা না পেলে এস এম এস করলেই সঙ্গে সঙ্গে জবাব কি আপডেট হয়েছে সেটা জানিয়ে দিয়ে। আমি যদিও ফিল্ডে নেই সেই সময়। এত দ্রুত গতিতে আপডেট দেওয়া আর তার জবাব দেওয়া কোনো পুলিশ অফিসার আমি অন্তত দেখিনি। সেই করোনার সময় উত্তরপাড়া থানার সামনে জিটি রোডের উপর ঘণ্টার পর ঘন্টা জ্যাম লেগে থাকলেই এসএমএস করে বলতাম আমি একটু রাস্তা ক্লিয়ার করলে বাড়ী ফিরতে পারবো আমরা। আর সেই সময় তিনি যতদূর সম্ভব এডিজি ট্র্যাফিক হবেন। আর তাঁকে বলার সঙ্গে আমাদের লাইনে গাড়ি একটু একটু করে সচল হতে শুরু করতো। এমন মিরাকেল যে কতবার হয়েছে তার ঠিক নেই। আর এমনই মানুষ হলেন আই পি এস অজয় কুমার।
কিছুদিন আগেই তিনি চন্দননগর কমিশনারেট এর কমিশনার হয়ে এলেন। সেই সব জেলার পুরোনো লোকদের রিপোর্টারদের চিনতে পেরে একভাবেই ব্যবহার করা তাঁর। পদ বেড়েছে বলে ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন দেখিনি আমি তাঁর কোনোদিন। একদিন চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজোয় ঠাকুর দেখতে গিয়ে এসমএস করলাম রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কোথায় আছেন আপনি। আমি এসেছি চন্দননগর। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোনে তাঁর উত্তর চলে এলো আসুন দেখা হবে।
সত্যিই আজ এই সব কথা ভাবতেও বেশ ভালই লাগে। বর্তমানে পুলিসের বিরূদ্ধে হাজারও অভিযোগ আর অনুযোগ। এই সব থাকলেও সেই সবের মাঝেও এমন কিছু মানুষ এই পুলিশে কাজ করেন যাঁরা আজও উদাহরণ হয়ে আছেন আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হয়তো তাঁর কর্মজীবনে সব সাদার মাঝে একটা কালো দাগ রয়ে গেছে। তবু সেই সব কিছুই বাদ দিলে তিনি ভালো পুলিশ হিসেবেই আমার কাছে থাকবেন।
এইতো দিন কয়েক আগেই মেয়ের পাসপোর্ট করতে গিয়ে সেই চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের অফিসে একটু বলে দেবার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হলাম। সঙ্গে সঙ্গেই সব ইনফরমেশন নিয়ে নিলেন আমার কাছ থেকে। আর কোনো হ্যাপা ছাড়া নিরুপদ্রবে আর নির্বিঘ্নে আমার মেয়ের পাসপোর্ট বেরিয়ে গেলো। তাঁকে জানালাম আপনি হেল্প করলেন ধন্যবাদ। সেটা গায়েই মাখলেন না একদম।
আসলে পৃথিবীতে এমন ভালো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। তার মাঝে এমন মানুষ মেলা ভার। তবু তো এতসব খারাপ এর মাঝে একটু ভালোর ছোঁয়া মিলে যায়। আর যা দেখে মনে হয় আবার যদি তাঁর সাথে দৌড়ে খবর সংগ্রহ করে কাজ করতে পারতাম তাহলে বেশ ভালই লাগত আমার। ভালো থাকবেন আপনি। আর কিছু ভুল লিখলে ক্ষমা করবেন আমায়।
ভালো পুলিশ অফিসার - অভিজিৎ বসু।
বারো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য গুগল ও ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন