এখন রাত কত কে জানে। হালকা তন্দ্রার মত ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে মালতীর।চারিদিকে ভারী ভারী মেসিনের আওয়াজে তন্দ্রা কেটে যায় মালতীর। জীবন কে ধরে রাখার, জীবনকে বেঁধে রাখার যন্ত্রগুলো যেনো প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে এই গভীর নিশুতি রাতে। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী কঠোর পরিশ্রমই না করছে তারা সবাই মিলে এক সাথে। এদিক ওদিক থেকে বেরিয়ে আসছে নানা ধরনের আওয়াজ, বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ। যে আওয়াজের মধ্য আইসিইউ তে সারি সারি শুয়ে আছে অনেক রোগীই জীবনকে বাজি রেখে ঘরে ফেরার আশায়।
জীবনের এই টানাপোড়েন নিয়েই চলছে তাদের সকলের যুদ্ধ। ঠিক যেনো যমে আর মানুষের সাথে যুদ্ধ। সংসারের যুদ্ধ সামলে এই বার যেনো জীবন যুদ্ধর মোকাবিলা করা। সত্যিই এইভাবে কোনো দিন বাড়ী ছেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে সেটা মালতী ভাবতেই পারে নি কোনো দিন। যে ঘর ছেড়ে কোনো দিন কোথাও যায়নি সে। সেই ঘর ছেড়ে আসতে হলো তাকে। শুধু শরীরের জন্য, ঘর ছেড়ে আসতে হলো তাকে।
আর এখন এই যন্ত্রের সাহায্যে নিয়ে জীবনকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হচ্ছে তাকে। দেখতে দেখতে কত দিন হয়ে গেল হাসপাতালে ভর্তি সে। শরীর আর মন কিছুতেই আর তাল মিলিয়ে চলতে চায় না মালতীর। কতদিন আর এই ভাবে বিগড়ে যাওয়া শরীরকে সুস্থ করতে লড়াই চালানো যায় কে জানে। তাও এই ছেলের একটু চেনা শোনা ছিল বলে রক্ষা, না হলে যে কি করে সম্ভব হতো টাকার সামাল দেওয়া যেত কে জানে। বড়ো চিন্তা হয় তার হাসপাতালে বেডে শুয়ে। পাশ ফেরার চেষ্টা করলেও পারে না সে পাশ ফিরতে মালতী। কেমন যেন একটা অবশ ভাব তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
ছেলেটা কেমন আছে কে জানে। কাজ ছেড়ে, চাকরি ছেড়ে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখলে বড়ো মায়া হয় আজকাল মালতীর। কিন্তু কি করবো ছোটো থেকেই তো ও এমন খ্যাপা স্বভাবের ছেলে তার। কিন্তু ওর মনটা বড়ো ভাল। অন্য কারুর দুঃখ কষ্ট দেখতে পারে না একদম আমার বাপি। খুব নরম স্বভাবের ছেলেটা। কেমন দুর থেকে চুপ করে দেখে আর চলে যায় আজকাল। কাছে আসে না কিছুতেই সে। কিছুই বলতে পারে না ও আমায়। আসলে বরাবর খুব মুখচোরা আর লাজুক স্বভাবের সে। ছোটো বেলায় কত বকা ঝকা করেছি, মেরেছি কিন্তু মা ন্যাওটা খুব ছোট থেকেই ও। একদম মার কথা ছাড়া এক পাও নড়ত না কোনো জায়গায়। কিন্তু বড়ো হয়ে চাকরি পেয়ে সেই ছেলেটাই কেমন বদলে গেলো ধীরে ধীরে। এটাই হয়তো হয় নিয়ম, নরম মাটি শক্ত হলে এমন হয় বোধ হয়।
কিন্তু আর ওই মানুষটা যাকে আমি ছাড়া কেউ দেখার নেই। খেতে দেবার নেই সেই মানুষটাও তো একদম চুপ করে গেছে আমার শরীর খারাপ শুনে, দেখে। কেমন যেন সব গোটা সংসারটাই তাসের ঘরের মতো দুলছে। যে কোনো মুহূর্তেই ভেঙে পড়বে ঘরটা যে কোনো সময়।
আচ্ছা আর যদি কোনো দিন আমি বাড়ী ফিরতে না পারি তাহলে কি হবে। চলবে কি করে সংসারটা। ঠাকুর দেবে কে প্রতি দিন, তিন বেলায়। ঘরে শঙ্খ বাজবে না যে। প্রদীপ জ্বলবে না যে। প্রাথর্না হবে না। ধুপ জ্বলবে না আর বাড়িতে। কী হবে তাহলে সব। বন্ধ হয়ে যাবে এই সব কিছুই।
এত দিন ধরে যে সব নিয়ম নীতি নিষ্ঠা নিয়ে পালন করলাম ঠাকুরের কাজ। সে সব এক লহমায় বন্ধ হয়ে যাবে আমি না থাকলে ঘরে। চোখ বুজে আসে মালতীর এসব কথা ভেবেই। কেমন যেনো শির শির অনভুতি হয় তার গোটা শরীরে।
রাতের পাহারা দেওয়া নার্সটা এসে দেখে গেলো সব কিছু ঠিক আছে কি না। যন্ত্র চলছে কি না জীবনকে রক্ষা করার যে যন্ত্র পাহারা দিচ্ছে সবাইকে ঘড়ি মেপে টিক টিক করে। আবার নিজের জায়গায় চলে গেলো সেই নার্সটা। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে আছে এই নার্সরা। সত্যিই তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত চেষ্টা।
কাল সন্ধ্যায় তো পাশের বেডের সেই বুড়োটা কেমন মরে গেলো টুক করে। যন্ত্রকে ফেল করিয়ে দিয়ে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো সে। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হলো একটা গোটা জীবনকে। যে জীবনের কত কিছু ছিল, প্রেম, ভালোবাসা, ঘর, সংসার, পূত্র , কন্যা, পরিবার, পরিজন। সব কেমন এক লহমায় সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে মুছে সাফ করে দেওয়া হলো। সত্যিই তো কি সুন্দর একটা গোটা জীবনের বিয়োগান্ত দৃশ্য ঘটে গেলো মালতীর চোখের সামনে। আর তারপর থেকেই মালতীর মন ভালো নেই। রাতে ঘুম আসছে না।
এটা দেখার পর থেকেই শরীরটা কেমন অবশ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে মালতীর। মনে হয় আর ঘরে ফেরা হবে না বোধ হয় তার। মালতী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠাণ্ডা ঘরের ছাদের ওপর। কদিন আগেও এই হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, রক্ত দেখলেই কেমন আনচান করতো তার বুকের ভেতরটা মালতীর। কিন্তু এখন সব কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে তার। বার বার হাসপাতালে এসে কেমন যেনো সব চেনা হয়ে গেছে। আর এখন আর আগের মত ভয় করে না তার।
সে জেনে গেছে ঘড়ির সময় মেপে বিকেল হলে কিছু চেনা মানুষের মুখ দেখতে পারবে সে ঘড়ি ধরে। বাস এই আর কি। সেই যে পাড়ার জোৎস্না দিদি, ঘটুর মা, গোবিন্দ, ঈশান, বিজয়ের বউ, কমলদার বউ, সামনের বাড়ির বৌদি সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে নাম গুলো ধীরে ধীরে।
সেদিন কাজ ফেরৎ এসে বৌমাকে হাসপাতালে দেখে সেদিন বড়ো কষ্ট হলো মালতীর। মেয়েটা বড়ো ভালো মেয়ে যে। কত কষ্ট করে সংসারকে আগলে রেখেছে চুপ করে একা। সব সামলে নিয়েছে ঝড় ঝাপটা, মেয়েটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে চলে ঠিক আমার মতই। আসলে না হলে কি আর আমার ওই পাগল ছেলের ঘর করা হতো, না মনে হয় সত্যিই মেয়েটা বড়োই ভালো যে।
দূরের লাল আলোটা বিপ বিপ করছে দ্রুত। কানে আসছে মালতীর। কে জানে কি বলতে চায় সেই লাল আলোর আভা। মালতীর বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে। আচ্ছা সেই যে আমার ভাই, ছোড়দা, এরা কি জানে আমি অসুস্থ্ হয়েছি, হাসপাতালে ভর্তি আছি। নিশ্চয়ই ছেলে খবর দিয়েছে ওদের। কই একদিন ও দেখতে এলোনা কেউ আমায়। বোনকে দেখতেই এলো না ওরা। হয়তো সময় সুযোগ হয়নি ওদের। হয়তো শরীর খারাপ তাই। নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দেয় সে আপন মনে।
সত্যিই সেই ভাই ফোঁটার দিন কত আনন্দ হতো সেই শ্রীরামপুরের পাঁচ নম্বর এদোপুকুর লেনের বাড়িতে। কত হৈ চৈ হতো। একে অপরের সাথে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা হতো শব্দই মিলে। ছোটো বেলায় তো এই ছোড়দা কত দিন আমাদের সংসার বাঁচাতে সাহায্য করেছে কারখানা বন্ধের সময়। বিয়ের পরে সেই যে বছর বন্যায় সব ভেসে গেলো সেই উনিশশো আটাত্তোর সালে। জল ঠেলে নিজে সাঁতার কেটে ভোর বেলায় রিযড়ায় এসে দেখে গেছিলো আমরা কেমন আছি, ভেসে যাইনি তো জলের তোড়ে সবাই ঠিক আছি তো।
আর আমার বড়দা কি ভালো বাসতো আমায়। দূরে থাকলেও পূজো এলেই জানতে চাইত শাড়ী নেবো না টাকা নেবো এই বছর। কী গভীর গোপন সম্পর্ক ছিল চার ভাই বোনের মধ্যে। কষ্টের সংসারে এই চার ভাই বোন তো পাশের বাড়ির সেই বিলুদের বাড়ির এক থালা ভাত কে ভাগ করে খেয়ে বেঁচেছিল সেই ছোটো বেলায় তারা। কি টান, কি ভাব ছিল চার জনের। তাহলে কি সব বড়ো বেলায় বদলে যায়। এই জড়িয়ে বেঁচে থাকা জীবন গুলো নিজে নিজেই আপন মনে বদলে যায়। বদলে যায় জীবনের আসল অর্থ গুলো। কে জানে। মালতী চুপ করে শুয়ে থাকে।
জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে হয়তো এই সব কথা বেশি করেই মনে পড়ে সব মানুষেরই। জীবনের শেষ হিসাব নিকাশ করতে চায় মানুষ গুলো। শাড়ি, জামা ছাড়া এই রোগীর পোশাকে কেমন যেনো অচেনা লাগে মালতীর নিজেকে একদম। সারা জীবন দৌড়ে যাওয়া মানুষটা কেমন যেনো থমকে দাঁড়িয়ে গেছে নিজেই। লাল আলোর বিপ বিপ শব্দটা কেমন যেন অচেনা লাগে তার। চারিদিকে ভারী পর্দার অন্তরালে শুয়ে বোঝা যায়না দিন রাতের ফারাক কোনটা। সে চুপ করে শুয়ে থাকে।
কেমন যেনো ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার। আবার আগের মত বাঁচতে ইচ্ছা করে তার। খুব বাঁচতে ইচ্ছা করে মালতীর। জীবনের এই মেশিনের সাহায্যে নিয়ে নয়, নিজের মনের জোরে। দু পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে তার। তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়া সংসারটাকে আবার আগের মত বুকে আগলে রাখতে ইচ্ছা করে।
বাবু বলে ছেলেকে চোখ পাকিয়ে বকতে ইচ্ছা করে আবার, সেই ছোটো বেলার মতোই। বৌমাকে ফোন করে বলতে ইচ্ছা করে গোটা সেদ্ধ বেশি করে দিও এই বার। পাড়ার লোকদের দিতে হয় আমায়। আমি বাবাকে পাঠিয়ে দেবো জায়গা দিয়ে। নাতনিকে শেষ বারের মত বুকে জড়িয়ে ধরে, লুকিয়ে টাকা দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে ভালো জামা কিনবি তুই পূজোয়। আর টাকা লাগলে বলবি আমায় চুপি চুপি দিয়ে দেবো আমি। আবার একবার মা তারার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে তার।সেই যে তারাপীঠ নিয়ে গেছিলো ছেলে।
সত্যিই তো জীবনের শেষ লগ্নে এসে এত কিছু করতে ইচ্ছা করছে মালতীর। ফেলে আসা অসক্ত জীবনকে উপভোগ করতে ইচ্ছা করছে তার আবার নতুন করে। বড়ো বুকের জড়িয়ে ভালো বাসতে ইচ্ছা করছে মালতীর তার ভেঙে পড়া সংসারটাকে আবার আগের মতই।
হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে আই সি ইউ -র। দূরের কোনো বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে কেউ একজন। দ্রুত বাড়ির লোককে খবর দিতে হবে, বলছে নার্স মহিলাটি ফিস ফিস করে অন্য নার্সকে। কেমন যেনো একটা অজানা ভয় ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে মালতীকে। ঝাপসা হয়ে আসে তার দু চোখ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। বড়ো ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে মালতীর। একটি বারের জন্য সেই টালির ঘরে ফিরে যেতে চায় সে। অন্তত একটি বার।
ফিরে এলো মা - অভিজিৎ বসু।
চব্বিশ জানুয়ারী দু হাজার তেইশ।
ছবি নিজের তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন