দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওরা বেশ দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে দিন- রাত। মাঘের দুপুরে উত্তুরে শীতের হাওয়া গায়ে মেখে বেঁচে আছে ওরা বেশ ভালো ভাবেই খুশি মনে একে ওপরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই। বৈশাখের ঝড়া পাতার শব্দকে অনুভব না করেই ওরা বেশ ভালই টানাটানির সংসারে আর এই নানা ভাঙনের মাঝেও বৈপরিত্যে থেকেও কেমন যেন জড়িয়ে আছে একে অপরকে আঁকড়ে ধরেই হাসি মুখে। যে হাসির মধ্যেও লুকিয়ে আছে গভীর একটা দুর সমুদ্রের সীমারেখা। যে সীমারেখা পেরিয়ে আদিগন্ত ধূ ধূ মাঠ পেরিয়ে ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করা যায় না কিছুতেই কোনোও মতেই।
ওরা আসলে কেউই নয়, ওরা আসলে ব্যক্তি নয়, ওরা আসলে বস্তু নয়, ওরা আসলে দেওয়ালে ঝুলে থাকা কটি কাঠের নাম এর শুধুই মায়া আর ভালোবাসার উত্তাপ মাখা বাক্স মাত্র। যে ধুলো পড়া বাক্সের গায়ে আটকে আছে গোটা জলজ্যান্ত একটা রং, রস, গন্ধ মাখা সোনালী জীবন। যে জীবন দিয়ে তৈরি গোটা ভরা একটা সংসার, আর সেই সংসারের মায়াজাল বিছানো চৌকিতে খেলা করে স্মৃতির টুকরো টুকরো ছন্নছাড়া কিছু কোলাজ। যে স্মৃতিকে আগলে রেখেই বেঁচে থাকা আর ঝুলে থাকা আর আটকে থাকা আলো আঁধারির এই নিশ্চুপ দেওয়ালে। কেমন চুপটি করে নিশ্চুপ বোবা আর বধির হয়ে।
সত্যিই ফ্ল্যাট বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই নানা নামের বাক্সগুলো বেশ ভালই লাগে আমার। যখন বহুবছর আগে এই নতুন ঘরে পা দিলাম, নতুন করে আলো জ্বালিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম, নতুন করে সম্পর্কের সূচনা হলো একে অপরের সঙ্গে তখন তো এদেরকেও কেমন করে যেন দেওয়ালে ঠেসে দিলাম আমরাই সবাই মিলে জোর করে একপ্রকার। ঠিক যেনো ফাঁসি দেওয়ার মতই ঝুলিয়ে দেওয়া ওদের। ক্রুশ বিদ্ধ যীশুর মতই আটকে দেওয়া ওদের। শুধুই নিজেদের স্বার্থে আর নিজেদের আত্মপরিচয়কে জাহির করতে। সেই কলকলে সিঁড়ি, গমগম করা ঘর, নতুন রং মাখা আর হাসি মাখা মুখে এ ওর বাড়ীর দরজায় বেল দেওয়া, সেই এক তলার সাথে তিন তলার নতুন করে জুটি বাঁধা। আর সে নিয়ে কতই না হাসি ঠাট্টা মশকরা করা আমাদের। সত্যিই আজ যেনো সব কিছুই আটকে গেছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ধুলোপড়া কাঠের বাক্সের ভেতর।
সেই জি ফোর এর দীপ্তি দাস কবেই এই বাড়ী আর বাড়ীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন দূরে অনেক দূরে আমাদের সবাইকে ছেড়ে হাসিমুখে। সেই রোগা পটকা একটা কাঠিসাড় চেহারার মহিলা মুখের হাসি উবে গেছে কবেই তাঁর। যেদিন থেকে নিজের জমি অধিগ্রহণ করেছিল পাড়ার কেষ্ট বিষ্টু ক্ষমতশালী প্রোমোটার। সেই কেমন যেন চুপ করেও জীবন কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি ধীরে ধীরে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, সবার অগোচরে খবর নেওয়া হয় নি তাঁর আর। সেই তাঁর নামের বাক্স আজও ঝুলে আছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঠিক ফাঁসির মঞ্চে গান গাওয়া শহীদের মতই। আটকে আছে কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা, কত মায়া আর মমতার বন্ধন। যে বন্ধন ছেড়ে তিনিও হয়তো এই ঘর, এই দুয়ার ছেড়ে যেতে চাননি একদিন। সেই তাঁর নামের বাক্সে ঝুলে আছে সাদা খাম বন্ধ এক চিঠি। যে চিঠির মালিক আজ আর নেই। সত্যিই অসাধারণ এই বাক্সবন্দী জীবন আমাদের।
সেই তিনতলার কুন্ডুবাবু আর তাঁর ভালোবাসার সংসারে ঘুন ধরেছে কবেই। দেখা হলেই ডেকে কথা বলতেন তিনি সবার সাথেই হেসে একটু কেশে নিয়ে থেমে থেমে। ঘরে এসে কথা বলতে ভালোবাসতেন তাঁর স্ত্রী নিজে নিজেই একটু শহুরে কেতা না মেনে আর না জেনেই চলতেন তিনি একটু সহজ ভাবেই সবার সাথে। সেই নিয়েও তো কত জোর আলোচনা এই ফিতে মাপা ফ্ল্যাট বাড়ীর চৌহদ্দিতে। হঠাৎ করেই একদিন একা হয়ে গেলেন তিনি। চলে গেলেন কুন্ডু বাবুর স্ত্রী। আজ সেই তাঁর নামের ধুলো পড়া বাক্স দেখে মনে পড়ে গেলো অনেক কিছুই যে আমার। সেই তাঁর রিষড়ার জে কে স্টিল কারখানায় কাজ করা, কষ্ট করে সংসার চালানো এই সবকিছু করেই তো এই সংসারকে ভালবেসে বড়ো করা তাঁর। সেই তাঁর ভালবাসার সংসার আজ শুধুই ধুলো মাখা বাক্সে আটকা পড়ে গেছে যেনো দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাতের অন্ধকারে চুপটি করেই ঠিক ক্রুস বিদ্ধ যীশুর মতই।
জীবন বোধহয় এমনই, উড়ে বেড়ানো, দৌড়ে বেড়ানো ছুটে বেড়ানো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে বেড়ানো, দম্ভে, অহংকারে, উদ্বেলিত হয়ে ঘুরে বেড়ানো জীবন বোধহয় এমন করেই একদিন আটকা পড়ে যায় ওই ধুলোমাখা বাক্সের মধ্যে মুখ গুঁজে। যে বাক্সের ভেতর দরজা খুলে চিঠির সন্ধান করার লোক মেলে না আর। যে বাক্সের গায়ে ঝুলে থাকা তালা আর চাবিতে জং পড়ে যায় নিজে নিজেই। জং পড়ে যায় সম্পর্কের নিনড় বাঁধনেও কেমন করে আমরা ঠিক সেটা বুঝতেই পারি না আর।
শুধু রাতের অন্ধকারে আচমকা ফিসফিস করে বন্ধ বাক্সগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলে হেসে হেসে একে ওপরের গায়ে গা লাগিয়ে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, আঁকড়ে ধরে। প্রাণপণে বন্ধ দরজার শিকল ভেঙে বেরিয়ে পড়তে চায় ওরা কেমন করে। আবার আগের মতোই কলকল করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজেদের ঘরে ফিরতে চায় ওরা সংগোপনে। তাদের ভালোবাসার ঘরে। তাদের মায়া ভরা ধুলো পড়া সংসারে।
বাক্স বন্দী জীবন - অভিজিৎ বসু।
নয় ফেব্রুয়ারী, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন