সাদা জীবনের কালো কথায় বহু ভালো কথা, বহু জীবনের কথা, লিখে ফেললাম আমি। যে সব কথা কারুর কাছে বড়ই সুখপাঠ্য হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন আমায়। আবার কারুর কাছে সুখের আবেশে মোড়ানো কোনো ভালো অভিজ্ঞতা নয় এই লেখা। যা হয়ত অনেকেই আমায় বলছেন কখনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ করে। কিংবা সরাসরি আমায় ফোন করে।
আসলে যাই হোক ভালো অভিজ্ঞতা বা খারাপ অভিজ্ঞতা এই অভিজ্ঞতা তো একদম আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যার জন্যে শুধু মাত্র আমিই সেই সব পুরোনো ঘটনার সাক্ষী। আর তাই তো রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে সেই সাক্ষী লিখতে বসে যায় আপনমনে বেখেয়ালে কিছুটা সেই জ্বর হওয়া রোগীর মত। শুধু মনে হয় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে আমার জীবনের সময়। তাই হয়তো দ্রুত গতিতে লিখে ফেলতে চাই কিছু মনের অব্যক্ত কথা। যে কথা অকথিত আছে আজও অনেকের কাছেই।
তেমন সব জীবনের পাওয়া আর না পাওয়ার কথা, মান আর অভিমানের অভিজ্ঞতার কথা। যা সঞ্চয় হয়ে আছে এই আমার ক্ষুদ্র সাংবাদিক জীবনের কুলুঙ্গিতে একদম চুপটি করে। ঘাপটি মেরে সে বসে আছে চোখ বুজে। যেমন করে সাপুড়ে তার ঝাঁপি থেকে সাপ বের করে তেমন ঝাঁপি খুলে বের করা। যাদেরকে নথিবদ্ধ করে রাখতেই আমার এই আঁকাবাঁকা লেখা।আঁকিবুঁকি অক্ষরে কিছু লেখা লেখা খেলা।
আজ ঠিক তেমনি একুশের শহীদ দিবসের মঞ্চের ভীড়ে একদম একা একা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একনিষ্ঠ সৈনিকের মনকথা বা মনোবেদনার কথা। যে কথায় মান, অভিমান, অপমান, স্বাভিমান সব কিছুই হয়তো তাকে পীড়া দেয় জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দেবার পর। তবু তো সেই যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েও, বিদ্ধ হয়েও বার বার ছুটে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া ওই ভিড়ের মাঝে। জনতার স্রোতে মিশে যাওয়া অভ্যাস বসত।
দুর থেকে সব কিছুকে তুচ্ছ করে দাঁড়িয়ে থাকা আর মনে মনে ভাবা জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় হারিয়ে ফেলে যে সময় শুধু এই রাজনৈতিক দলের সন্ন্যাস নিলেন তিনি। মনে মনে জীবনের প্রথম প্রেমের মতো জড়িয়ে ধরলেন সেই রাজনীতির কঠিন কঠোর কন্টকময় জীবনকে সব কিছু ভুলে। সেই সব কিছুর সমান মর্যাদা কি পেলেন তিনি এতদিনে। থ্রি টায়ার মঞ্চের একটা তলায় বসার ডাক পেলেও চিঠি পেলেও তো তিনি সেই ভীড় ঠেলে মিছিল করেই আজও সমান ভাবেই জনগণের সাথেই বৃষ্টির জলে ভিজে ডুব দিলেন সেই স্মৃতির রাস্তায় মিছিলের ভীড়ে। যে রাস্তা একদিন তাকে পথ দেখিয়েছিল। সেই পথের নানা ঘটনা আজ বড়ই মনে পড়ে যায় তার এই দুর মঞ্চের দিকে তাকিয়ে কেনো যে তখন এত রিস্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নানা ঘটনায় পুলিশের তাড়া খেয়েও আন্দোলন করতে পিছপা হননি তিনি কে জানে।
ধর্মের মত তাহলে রাজনীতিও কি আফিম মেশানো থাকে কে জানে সেটা তার জানা নেই। একবার নেশা ধরলে আর সেই নেশা ছাড়ার উপায় নেই কোনো। আসলে এই নেশার টানেই যে জীবনের যৌবন কাটিয়ে আজ বার্ধক্যের দোরগোড়ায়। হারিয়ে যাওয়া জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়ে এই ভাবেই যে নেশার ঘোরে ভালো করে প্রেম, ভালোবাসা, সংসার কিছুই করা হলো না তার। এই নিয়ে যে বউ এর কাছে তাকে মাঝে মাঝেই কথা শুনতে হয় টিপ্পনী শুনতে হয় সেটা সে ভালই বুঝতে পারে। কিন্তু উপায় কি রাজনীতির ময়দানের নেশা হলো আসলে ঠিক ওই ঘোড় দৌড়ের রেসের মাঠের নেশার মতই। যাকে একবার ধরে ছাড়া মুসকিল হয়। সেই নেশার টানেই তো সে কাটিয়ে দিলো এত গুলো বছর এই ময়দানের একজন সাধারণ খেলোয়ার হয়ে।
না, এক এক সময় তার আফসোস হলেও আবার হাসি মুখে সেই অভিব্যক্তিকে বিদায় জানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজের জগতে। যে কাজে মানুষের জীবনের উপকার হয় সেই কাজেই নেমে পড়ে সে আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই তো সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে যায় তার সিঙ্গুরের জমিতে দলের ঝান্ডা আটকাতে গিয়ে পুলিশ এর তাড়া খাওয়া। সেই হুগলীর বিখ্যাত পুলিশ অফিসার অসিত পাল এর কাছে। যিনি সাংবাদিকদের কাছে অ্যাসিড পাল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। পুলিশের তাড়া খেয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়া। গায়ের লাল জামা খুলে খালি গায়ে লুকিয়ে পুলিশকে বোকা বানিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া। সত্যিই তো নেশা ছিল বলেই বোধ এসব সম্ভব হয়েছে তার জীবনে। না হলে কি আর এই অসাধ্য কাজ করতে পারত সে।
সত্যিই তো এই সব ভাবলে বুকটা কেমন গর্বে ভরে যায়। কে আর শুনবে এই সব গল্প কথা। বলবে দুর এসব পাগলে বলে। আজকাল পুরোনোদের কোনো দাম নেই তারা সব ব্যাকডেটেড। আর সেই যে ঘটনা মৃতদেহ আটকে রেখে দলের নেতার হাতে তুলে দেওয়ার গল্প। সেদিনও তো দল তার কাছেই আত্ম সমর্পণ করেছিল সেদিন। উল্টে যাওয়া বাসের যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ নিয়ে চলে যাবে জোর করে।
কিন্তু সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন দিলীপ যে করে হোক বডি আটকাতে হবে। মুকুল যাচ্ছে। বাস দিদির কথা শুনেই আবার চেপে বসলো নেশা তার। ডিএমকে জোর গলায় আঙুল তুলে বলে দিলেন ডিএম সাহেব আপনি যাদব আমিও যাদব এক জঙ্গলে যেমন দুটো বাঘ থাকতে পারে না তেমন এক জেলায় দুই যাদব থাকতে পারে না। দাপুটে সেই যাদব ডিএম পিছপা হলেন এই আওয়াজ শুনে। মৃতদেহ আটকে রেখে সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মুকুল রায় এর কাছে নিজের স্ট্রাইকার এর খেলা খেলে পয়েন্ট তুলেছিলেন হুগলী জেলার এই যাদব নামের নেতা।
কিন্তু আজ এত দিন পরে সেই পয়েন্টের কোনো দাম তো দল দিলো না তাকে। বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হবার কোনো সুযোগ পেলো না সে। এমনকি সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন নিয়ে যে সব বই লেখা হলো যে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে প্রথম পতাকা উত্তোলন করে দিলো নিজের ক্ষমতা আর সাহসের জোরে। যে টাটার কর্মীদের ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করলো তার নামের উল্লেখ করা হলো না কোনো সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের বইতে। ভাবলে এই বুড়ো বয়সে একটু বুকের বাঁ দিকটা একটু চিনচিন করে এই আর কি। এই ফাঁকা সভার রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে সে কথাই ভাবছিল সে আনমনে।
একা একদম একা হলেও। কত যে মুখ এসে দাদা ভালো আছেন বলে প্রনাম জানালো তাকে। এটাই বা কম পাওয়া কি। সেই যে সময় জেলার এক এক করে দলের পার্টি অফিস গুলোতে তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতির একটি দল। যে সময় দলের সামনের সারির সব নেতারা ঘরে ঢুকে পড়েছে। ভয়ে কেউ ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়ে দায় এড়িয়ে গেছে। সেই সময়ে আবার সেই চেনা ফোন। দিলীপ একটু দেখ তুই। বাস আর কি ঝাঁপিয়ে পড়ে একে একে ফের সেই দলের কার্যালয়ের তালা খুলে নিজের দলের ঝান্ডা উড়িয়ে নিজের জাত ফের বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন নি এই যাদব নামের নেতা সেদিনও।
কিন্তু কালীঘাটের গঙ্গাপাড়ের এই দল বোধ হয় একটু ছুঁতমার্গ করে বাছ বিচার করেই চলে। না হলে কি আর এত পরীক্ষার পর সেই পুড়শুড়াতেই তাকে পরীক্ষা দিতে পাঠায় বিধানসভার টিকিট দিয়ে। যে আসনে নিশ্চিত হার জেনেও। এটাও বোধ হয় নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারো কি না পরখ করে দেখার জন্যই করা হলো। তাই নিশ্চিত আসন থেকে অনেক দূরের আসনে টিকিট দিয়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো নিজের দলের কিছু নেতা সব জেনেই। কিন্তু সেই হেরে যাওয়া পরীক্ষায় তাকে হারতেই হলো অবশেষে। যেটা আগে থাকতেই পিকের টীম এই সাজানো নাটক করে রেখেছিল বলে কান পাতলে শোনা যায় এমন কথা।
তাই এসব ভেবে আর কোনো অনুশোচনা নয়। শুধু সারাজীবন নেশার ঘোরে দৌড়ে যাওয়া একটা মানুষ বাকি জীবনটা এই ভাবেই দৌড়ে যেতে চায়। এই ফাঁকা একুশের মঞ্চের দিকে তাকিয়ে এই সব কথা ভেবে বুকটা মুচড়ে ওঠে তার ফের। আবার শক্ত হয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে, রাজনীতি তো শুধু উপরে উঠে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা নয়। নিজের জীবনের সবচেয়ে ভালো সুবিধা ভোগ করা নয়।শুধুই অর্থ রোজগার নয়। রাজনীতির এই পাঠশালায় শুধুই পদ পাওয়া, আর ক্ষমতা পাওয়া নয়। সাংসদ,বিধায়ক হয়ে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকে বসে থাকা নয়। এই ময়দানের নেশা আসলে হলো সাধারণ মানুষের কথা ভেবে কিছু কাজ করে যাওয়া। যা কাজের সুযোগ এসেছে তার সদ্ব্যবহার করা সঠিক ভাবে।
আর সেই কাজ দলের প্রতিষ্ঠা এনে দেয় নিজের প্রতিষ্ঠা নাই বা হলো কিছু। দলের বিপদের দিনে তো সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিল একদিন। এটা ভেবেই মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে ষাটোর্ধ্ব এই নেতা। ধীর পায়ে একাই একুশের মঞ্চ ছেড়ে ঘরের পথে ফিরে আসে সে। এই বল ভরসা নিয়ে আবার যদি কোনোদিন ডাক পড়ে খেলতে নামার। সেদিন আবার সে এই বুড়ো বয়সে এসেও সে বুঝিয়ে দেবে নতুন প্রজন্মের ঝাঁ চকচকে খেলোয়াড়দের এর থেকে সেও কম ভালো প্লেয়ার নয় সে।
রাজনীতির ময়দানের ঘাস মাটি তার সব চেনা। শুধু সে চাটুজ্জে, বাড়ুজ্জে, আর মুখুজ্জেদের ভীড়ে সে শুধু একটু যাদব হয়ে গেছে এই আর কি। এটাই তার বড় আফশোষ। না, হলে সেও হয়তো অন্য অনেক মাঠে খেলতে না পারা খেলোয়াড় এর মতই অতি সাধারণ মানের প্লেয়ার হলেও ভালো পুরস্কার পেতো দলের কাছে। এই ভাবে বউ এর কাছে কথা শুনতে হতো না।
ক্ষতি কি এই যেটুকু পাওয়া গেছে সেটা নিয়েই না হয় বাকি জীবন এইভাবে দৌড়ে কেটে যাবে তার। এভাবেই নিজের চেনা শহরে,চেনা মানুষদের কাছে কাটিয়ে দেবে সে বাকি জীবনটা। ধীর পায়ে একা একা ঘরে ফিরে আসে সে বৃষ্টিতে ভিজে। চোখের জল আর বৃষ্টির জলে ভেসে যায় তার দীর্ঘ রাজনীতির জীবনের পথ, ঘাট, প্রান্তর, গ্রামের মেঠো রাস্তা, চেনা শহরের গলি পথ সব কিছু। কলকাতার রাজপথ ছেড়ে সে আবার নিজের চেনা শহরে ফিরে আসে সে। একবুক আশা নিয়ে, আবার যদি কোনোদিন ডাক পড়ে খেলতে হবে তাহলে এই বুড়ো বয়সেও আবার ভেলকি দেখাবে সে।
চাটুজ্জে বনাম যাদব - অভিজিৎ বসু।
তেইশে জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন