সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সিপ্পুর কথা। ওর সাথে আমার আলাপ হয়েছে একদিন আগেই। কিন্তু মনে হলো ওর কথা একটু লেখা দরকার। এই আমার এলেবেলে এলোমেলো ভাবনাহীন জীবনে পথ চলতে চলতে নানা মানুষের সাথে দেখা হয় রাস্তায়। ঠিক তেমনি ভাবেই হঠাৎ করেই সিপ্পুর সাথে দেখা হলো আমার কঙ্কালীতলা মন্দিরে। মন্দির চত্বরে কদিন আগেই বসেছে হাট। সেই হাটে বসছে সিপ্পু। জামা কাপড় নিয়ে। বেচাকেনার আশায়। বসেছি আমিও।
দু হাজার ষোল সালের স্নাতক সে। বোলপুর কলেজ থেকে পাশ করেছে সে কলা বিভাগ নিয়ে পড়ে। দাদা সিভিক এর কাজ করে। কোপাই নদী পার করে দর্পশীলা গ্রামে ওর বাড়ী। একান্নবর্তী পরিবার ওদের। বাবা কাকারা একসাথে বাস করেন সবাই মিলে জোট বেঁধে, যা আজকাল খুব একটা গ্রামেও দেখা মেলে না কিছুতেই।
কাজের আকাল তাই টুকটাক ব্যবসা করে একটু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা আর কি। কারণ কিছু কাজ তো করতে হবে না হলে চলবে কি করে। কারণ একটাই সরকারি চাকরি যে দুরস্ত। তাই বোলপুর আহম্মদপুর রাস্তার ওপর কোপাই স্টেশন এর আগেই ধর্মতলায় ছোটো একটা দোকান দিয়েছে সে কিছুদিন হলো জামা কাপড়ের দোকান। আর তার সাথে কিছুদিন হলো এই কঙ্কালীতলা মন্দিরে গিয়ে হাটে বসা।
কিন্তু একটাই চিন্তা তাদের সবাইকে চেপে ধরেছে যে ওই রাস্তার পাশের অস্থায়ী দোকান গুলো সব কিছু যেনো ভেঙে ফেলা হবে সরকারি অর্ডারে। ফাঁকা রাস্তা থেকে অনেক দূরে দোকান করেও যে শান্তি নেই ওদের। ওই দোকানের পাশেই আছে ধর্মতলার সেই ব্যাগ তৈরির কারিগর বিশ্বজিৎ দাস এর দোকান। তাহলে কি করবে ওরা এই চিন্তায় ঘুম ছুটেছে ওদের। চারিদিকে যা সব ভাঙচুর হচ্ছে দোকানপাট। একে কাজ নেই, চাকরির আকাল, একটু কোনো রকমে দিন গুজরানের চেষ্টা করা, সেখানেও ভেঙে ফেলার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কি যে হবে কে জানে।
শনিবার হাটে বসে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আলাপ হলো সেই সিপ্পুর সাথে আমার। অনেক কথা হলো ওর সাথে। মেঘ বৃষ্টি ভেজা দুপুরে দাঁড়িয়ে দুজন অচেনা মানুষ হয়েও কেমন করে একে ওপরকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো একে ওপরকে। আসলে জীবন তো এমনই, বহুদিনের চেনা জানা মানুষ কেমন দুম করে অচেনা অজানা মানুষ হয়ে যায়। পথ চলতে চলতে পাশ কাটিয়ে চলে যায় মাথা নিচু করে আলগোছে না চেনার ভান করে পাশ কাটিয়ে। যেনো কত দুর দেশের পথিক আমরা একে ওপরে।
আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে আলাপ হওয়া এই সিপ্পু দুপুর বেলায় যখন অচেনা হয়েও আমার জন্য মা কঙ্কালীতলার ভোগের কুপন এনে দিয়ে বলে আজ সবাইকে ভোগ খেতে দেবে বিনা পয়সায় কোনো টাকা লাগবে না আমাদের। আমি কেমন আপ্লুত হয়ে যাই ওর এই কথা শুনে। জীবনের এই ওঠা আর নামা, জীবনের এই সব হাজার হাজার মানুষের উপচে পড়া ভীড় ঠেলে এমন কিছু মানুষকে দেখতে পেয়ে মনে হয় সত্যিই তো জীবন কি সুন্দর। এই স্বার্থসঙ্কুল জীবনে চলতে চলতে এমন মানুষকেও পথ চলতে পাওয়া যায় দু একটা। যেখানে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে বলে এই নিন আপনার কুপন এনেছি আমি। যান খেয়ে আসুন আপনি।
সত্যিই বলতে কি এই সব ঘটনা হয়তো খুব ছোট কিন্তু তার অনুভূতি অনেক বড়। জীবনের কঠিন কঠোর এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় হাঁটতে নেমে আচমকা এমন সিপ্পুকে পেয়ে আমি সত্যিই বেশ অভিভূত হয়ে যাই এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে। আসলে কি জানেন তো শহুরে জীবনের এই কেতা দুরস্ত মানুষের ভিড়ে মুখরিত সব রাস্তা ঘাট আলোকোজ্জ্বল এলাকা তার মাঝে এই মেঠো গ্রামীণ হাটে যেনো মেঠো সম্পর্কের স্বাদ পাওয়া গেলো কিছুটা। যার জন্য এত আবিল হয়ে গেলাম আমি নিজেও এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে।
প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির এই দুয়ের মধ্যে ফারাক অনেক। আমার জীবনে অপ্রাপ্তির ঘর বেশি ভরে গেছে প্রাপ্তির থেকে। তবু কেমন করে যেনো আজ এই ছোটো প্রাপ্তি আমায় অনেক বেশি সুখ দিলো, আনন্দ দিলো। আমার বন্ধু সমীর এর সেই বিখ্যাত লেখা লাইন লিখতে ইচ্ছা হয় আমার এই ঘটনার পর। এলেবেলে, এলোমেলো আমার এই ভাবনাহীন জীবনে এমন রঙিন সিপ্পু ওর মুখের উজ্জ্বল হাসি, ওর কথা আমায় সত্যিই খুব আনন্দ দিলো। আমায় নতুন করে মনে করিয়ে দিলো এই পৃথিবীর সব কিছুই খারাপ হয়ে যায়নি এখনও। কিছু তো ভালো আছে এখনও। না হলে আর দিন,রাত হচ্ছে কি করে নিয়ম মেনে।
জীবনের মানে তো শুধু প্ল্যান করে সিঁড়ি বেয়ে অন্যকে টপকে হাত নেড়ে টাটা করে ওপরে উঠে যাওয়া নয়। একটু হাত বাড়িয়ে দিয়ে অন্যকে সাহায্য করা। অন্যর খিদে পেটের ভাত জোগাড় করে দেবার চেষ্টা করা। যা আজকের দিনে সত্যিই খুব বিরল ঘটনা। মোটরবাইক নিয়ে বাড়ি চলে যাবার সময় ওর সাথে একটা ছবি তুললাম আমরা দুজন। এক ফ্রেমে বন্দি হলাম অজানা অচেনা দুজন মানুষ। যারা আসলে এই স্বার্থপর পৃথিবীরই বাসিন্দা। কিন্তু মনে হলো না আমার যে ওর সাথে আমার আলাপ মাত্র একদিনের কিছুক্ষণ আগের।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাটে তখন মেঘ বৃষ্টির খেলা। একতারা দোতারা বিক্রির দোকানে তখন সুরের মুর্ছনায় এদিক ওদিক হালকা আওয়াজ কানে আসছে। দরদাম করে আশি টাকার জিনিস পঞ্চাশ টাকায় নেবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন ক্রেতা। আর শুকনো মুখে কটা টাকা বেশি পাওয়ার আশায় ক্রেতাকে বুঝিয়ে চলেছে বিক্রেতা। এই দুইয়ের টানা পোড়েনের মাঝে মাথার ওপর অর্জুন গাছ থেকে টুপটাপ জল ঝড়ে পড়ছে মাথার ওপর। হাসি মেখে বৃষ্টিতে ভিজে ওই গাছগুলো যেনো বেশ খুশী হয়ে গেছে।
মাথায় গাছের জলের ফোঁটা পেয়ে আমি কেমন যেন মনে মনে খুশি হয়ে গেছি। গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখে ফের মনে ভয় ধরে। আবার যদি বৃষ্টি আসে কি হবে তাহলে। গাছের তলায় বসা যাবে না যে। একদিকে আশা নিয়ে বসে থাকা অপেক্ষা করা বেচা কেনার। অন্যদিকে সেই সব আশা পূরণ না হওয়ায় হতাশা বৃদ্ধি হওয়া।
এই দোলাচলে জীবনের দুদিকের টানা পোড়েনকে সঙ্গে নিয়েই তো বেঁচে থাকা। আর এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে সিপ্পু আর আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো এমন এক মেঘলা দিনে বৃষ্টি ভেজা দুপুরে মা কঙ্কালীকে সাক্ষী রেখে। জীবনের মেঠো আঁকাবাঁকা জলে ভেজা পথে এগিয়ে চলতে চলতে এমন কিছু অমলিন হাসির মানুষকে দেখে বড়ো ভালো লাগে। মনে হয় এই সব মানুষরা আর যাই হোক শহুরে স্বার্থপর মানুষ হবে না হয়তো।
জীবনের এই সব মানুষদের কথা বলতে বড়ো ইচ্ছা করে আমার। তাদের সাথে পরিচয় অল্প সময়ের হলেও মনে হয় কত দিনের চেনা ওরা। সাদা জীবনের কালো কথায় এমন ভালো মানুষদের কথা লিখে ফেলি আমি। হয়তো কেউ বলবেন এ আর এমনকি ঘটনা। এসব নিয়ে লেখার কি দরকার।
কিন্তু আমার মনে হয় জীবনের ছায়া ঘেরা, বৃষ্টি ভেজা দুপুরে রাস্তায় হাঁটতে নেমে এমন মানুষরা চুপ করে কাউকে কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে দেয় বলেই হয়তো মনে হয় জীবনের মানে একটু অন্যরকম। এই অনুভুতির স্পর্শ তার অনুরণন আমায় শিক্ষা দেয় বুঝিয়ে দেয় শুধুই চেনা সম্পর্ক নয়, অচেনা অদেখা সম্পর্কের মাঝেও লুকিয়ে থাকে গভীর গোপন জীবনবোধ। যাকে শুধু অনুভব করতে হয় চুপ করে এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে। আর হাজার দুঃখ কষ্টের মধ্যেও মনে মনে ভাবতে হয় সত্যিই তো জীবন কি সুন্দর।
সিপ্পু ও আমি - অভিজিৎ বসু।
আটাশে জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন