সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভিখারী অন্তর্ধান রহস্য - প্রথম পর্ব

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই বহু পুরোনো আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আন্দোলনের কথা। যে আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্য রাজনীতিতে শক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছিল এক সময়। কংগ্রেসের সেই ডাকাবুকো যুবনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সরকারের সেই আন্দোলন করে। যিনি আজ রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শুধু এই আন্দোলন আর সরকারের বিরোধিতা করেই। 

 সেই হারিয়ে যাওয়া এক মানুষের কথা। যাকে নিয়ে একসময় আজকের মতই আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল গোটা রাজ্য, গোটা বাংলা। সেই ভিখারী পাসওয়ান এর অন্তর্ধান রহস্য। যা বোধহয় আমাদের মন থেকে একদম মুছেই গেছে। হ্যাঁ প্রায় বত্রিশ বছর আগের ঘটনা। যা আজও অধরা রয়ে গেছে এতদিন পরেও। যদিও সেদিন তৎকালীন রাজ্যের বাম সরকার, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিশেষ আমল দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই তীব্র আন্দোলনকে। যা আজ একভাবেই ঘটছে গোটা রাজ্য জুড়ে। 

 যা তিনি বারবার তাঁর নিজের সেই রাজ্য শাসনের পঁচিশ বছরের সময়ে বাম আমলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে সরকারের বিরোধিতা করা হলো বিরোধীদের একমাত্র কাজ। আর সরকারের ক্ষমতায় বসে সেই বিরোধী দলের বিরোধিতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া সরকারের একমাত্র কাজ। তাই বোধ হয় তিনি সেই বিখ্যাত উক্তিটি করতে পেরেছিলেন, ধর্ষনের এক ঘটনায়,এমন তো কতই হয়। হ্যাঁ আমাদের সেই বিখ্যাত প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। 

আর সেটাই বোধ হয় যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। সরকার তার ক্ষমতা, পুলিশ, প্রশাসন নিয়ে লড়ে যায় বিরোধী দলের আন্দোলনের বিরুদ্ধে জোরদার। আর বিরোধীরা আন্দোলন করে, সুবিচার চেয়ে রাস্তায় নামে, লাঠির বাড়ী তাদের মাথায় পড়ে। টিয়ার গ্যাস এর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। ইঁটের টুকরো মাথায় লেগে পুলিশের মাথা ফেটে যায়। টিভিতে ছবি ওঠে, টিআরপি ওঠে, আলোচনা হয়, সমালোচনা হয় বাসে ট্রামে, ট্রেনে। সন্ধ্যায় ঘন্টা খানেক হয়, তারপর যে কে সেই ভাবেই চলে সরকার। এসব তো আন্দোলন আর বিরোধিতার সেই চিরচেনা ছবি। যা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। বিরোধী যখন শাসক হয় তখন যে তার রূপ বদলে যায় গিরগিটির মতই এটাই তো নিয়ম। 


আসলে শাসকের চেয়ারে বসে যা করা যায় না। বিরোধী হয়ে তার অনেক কিছুই করা যায়। তার সচিত্র উদাহরণ, তার জ্বল জ্বলে ছবি আজও আমাদের হৃদয় জুড়ে আছে গভীর ক্ষত হয়ে। আসলে সরকারি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অনেক কিছুই খুব সহজেই করে ফেলা যায়। যেটা করতে খুব বেশি কসরৎ করতে হয়না। আর তাই বোধ হয় দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে শুধুই বিরোধিতা করে বেশিদিন ভালো থাকা যায় না। কারণ রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে যে বিরোধিতার থেকে ক্ষমতার স্বাদ অনেক বেশি ভালো সেটা বোঝেন আমাদের এই রাজনীতির কুশীলবরা আর কারবারিরা। 

যাক গে এসব কথা থাক। আজ সেই ঊনিশ শো তিরানব্বই সালের তিরিশে অক্টোবরের এক রাতের কথা। সেই হারিয়ে যাওয়া ভিখারী পাসওয়ান এর কথা। সেই ভিক্টোরিয়া জুটমিলের কথা। সেই জুটমিলের বস্তির কথা। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আন্দোলনের কথা। যে আন্দোলন এর কথা আমার আজ বড়ো বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে। আসলে কি জানেন সাদা জীবনের কালো কথায় এমন কত কিছুই যে জড়িয়ে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কে জানে। শুধু রাত দুপুর হলেই তারা আমায় বড্ড জ্বালাতন করে যে। 

সালটা উনিশশো তিরানব্বই। তিরিশে অক্টোবরের মাঝ রাত। অভিযোগ একদল পুলিশ নাকি জোর করে ঘর থেকে তুলে আনে ভিখারী পাসোয়ানকে তার তেলিনী পাড়ার ঘর থেকে। যে অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে জুটমিলের এক হামলার ঘটনার নানা গোপন কথা নাকি ভিখারী জানে। তাকে পেটালেই সব বেরিয়ে আসবে। আসলে যে কোনো ক্ষোভ বিক্ষোভকে তো এইভাবেই পিটিয়ে শাস্তি দিয়ে দমন করা হয়। হুগলীর সেই ডাকাবুকো অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তখন হরমনপ্রীত সিং। যার কাছে নিচু তোলার পুলিশ মারফৎ খবর যায় এই ভিখারী হলো আসল লোক। সে সবটাই জানে কেনো এই অশান্তি হলো জুটমিলে। কারা এই অশান্তির নাটের গুরু। কারা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দেহরক্ষী বলরাম সিংহকে তেলিনিপাড়ায় পিটিয়ে মারে। 


ব্যাস যেমন ভাবা তেমন কাজ। অভিযোগ ওঠে রাতেই পুলিশ হানা দিলো ভিখারীর তেলেনিপাড়ার একচিলতে টালির ছোট্ট ঘরে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করা হলো। গামছা পরা অবস্থায় তাকে তুলে আনা হলো চুঁচুড়ার ধরমপুর পুলিশ ফাঁড়িতে। যেদিন এই তিন পুলিশের মধ্য ছিলেন স্বপন নামহাট্টা, সমর দত্ত ও আর একজন পুলিশ কর্মী। আর যেমন ভাবা ঠিক তেমন কাজ। 

লাঠি হলো আসল শক্তি পুলিশের আর সরকারের। লাঠির জোরেই তো ক্ষমতার আসল স্বাদ মেলে। জুটমিলের সেই গণ্ডগোল কারা করেছে সেটা জানতেই এই পদক্ষেপ পুলিশের। পুলিশ বারবার জানতে চায় সেই কথা ভিখারীর কাছে। ভিখারী পুলিশের সোর্স হিসেবে সে কাজ করত বলেও শোনা যায়। ছিল তার আরও কিছু কাজ কারবার সবটাই পুলিশ নাকি জানতো। তাই পুলিশের মনে হয় এই গোটা ঘটনা তার অজানা নয়। পুলিশকে সে বলছে না কারণ কাউকে বোধ হয় বাঁচাতে চায় ভিখারী পাসওয়ান। তাই জন্য সে আসল সত্য গোপন করছে। শুরু হয় পুলিশের অপারেশন ভিখারী পাসওয়ান।

 পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে ঘর থেকে তুলে এনে মাথা নিচু করে পা ওপরে বেঁধে শুধু মার আর মার দেওয়া হয়। পুলিশ ভাবে ভয়ে নিশ্চয়ই বলে দেবে সে সব কিছুই। কিন্তু পুলিশের এই মার খেয়েও জেদ চেপে যায় তারও কিছুটা। কোনো কথা বলেন না ভিখারী। ভিখারীর মা লালতী দেবী ও তার বউ সেই রাতেই ছুটে যায় তেলিনীপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে। হাতজোড় করে অনেক কান্নাকাটি করে, কাকুতি মিনতি করে যাতে তার ছেলেকে যাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভিখারী কোনো দোষ করেনি যে। কিন্তু না, পুলিশের টনক নড়ে না কিছুতেই। তাদের চোখের জলে কিছুতেই মন গলে না পুলিশের। 

তাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে যাতে কোনোদিন আর এমন কাজ না করতে পারে। সেই শিক্ষা দিতেই নাকি অভিযোগ ওঠে পুলিশ তাকে হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে বেধড়ক মারধর করে। একসময় পুলিশ ভাবে এই লাঠির বাড়ি আর মারে হয়ত মুখ খুলবে ভিখারী পাসওয়ান। যে চটকলে খুব গরীব মানুষরা পেটের টানে কাজ করে। নোংরা পুতিগন্ধময় পরিবেশে থাকে। কোনো রকমে দিন যাপন করে। তারা আবার আন্দোলন করবে, মারধর করবে পুলিশকে। অলীক সেই আন্দোলন আবার সরকারকে বিপাকে ফেলবে। না, এটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না যে। 

এটাই বোধহয় সরকারের সেই বিখ্যাত পুলিশ অফিসার হরমনপ্রীত সিংয়ের পছন্দ হয়নি কোনো মতেই। আর তাই একটা উচিৎ শিক্ষা দিতেই লাঠির বাড়ি পড়ে ভিখারীর পিঠে। কিন্তু সেটা যে উল্টো পথে চলে যাবে বোধ হয় বুঝতে পারেন নি কেউই সেদিন। মার আর মার। মুখ থেকে কথা বের করতেই হবে কারা করেছে এই গণ্ডগোল। কিন্তু না, পুলিশের মারে মুখ খুলতে নারাজ ভিখারী। তারও বোধ হয় জেদ চেপে যায় কিছুটা। 

আসলে কি আর আছে ভিখারীর মতন এমন সাধারণ গরীব দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের। ওটাই যে সম্বল শুধু। সেও বেঁকে বসে কিছুটা। পুলিশের মার খেয়ে মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে সে সব কিছুই। কিন্তু না মুখ খোলে না সে সেই রাতে। আর জেদ চেপে যায় পুলিশের। আরও মারো, আরও মারো। একটা এই জুট মিলের বস্তির বাস করা মানুষ এর কাছে হেরে যাবে পুলিশের লাঠি না কিছুতেই হতে পারে না সেটা। মারের মাত্রা বাড়তে থাকে। রাতও বাড়তে থাকে। কিন্তু মুখ বুজে সব মেনে নিয়ে আর মানিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ভিখারী স্থির হয়ে যায়। চুপ করে যায়। কোনো সাড়াশব্দ মেলে না তার। কথা বলে না কোনো। 

এসব দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় পুলিশ। কি হলো রে বাবা। ভয় পেয়ে যায় তারা। সঙ্গে সঙ্গে বড়ো কর্তাদের কাছে রাতেই ফোন যায়। ভিখারীর চোখে মুখে জল দেওয়া হয় কিছুটা। কিন্তু না তাতেও নড়েনা যে ভিখারী। তখন পুলিশ কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সেই রাতেই চুঁচুড়া সদর হাসপাতালের পুলিশের এক বিশ্বস্ত ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক তাকে রাতেই তলব করে আনা হয় ধরমপুর পুলিশ ফাঁড়িতে। সেই ডাক্তার এসে বলেন ভিখারী আর বেঁচে নেই, সে মারা গেছে। পুলিশ কর্তাদের তখন মাথায় হাত পড়ে যায়। একি হলো রে বাবা। এই তথ্য উঠে আসে সিবিআই এর পর্যবেক্ষণে যা তারা আদালতে পেশ করে।

অভিযোগ এরপর  দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়।যা পরে সিবিআই জানে তাদের তদন্তে। কি করে ধামাচাপা দেওয়া হবে এই ঘটনা। সেই নিয়ে রাতেই চলে ভাবনা চিন্তা। অবশেষে অনেক পরে পরিকল্পনা করে বাঁশবেড়িয়ার ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে নিয়ে যাওয়া হয় তার দেহ। রাতে মাঝিদের সাহায্য নিয়ে ভিখারীর শরীরে তার জড়িয়ে সঙ্গে থান ইট বেঁধে মাঝ গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়  বলেও অভিযোগ ওঠে। অবশ্য এই সব তথ্য সিবিআই পর্যবেক্ষণ হিসেবে আদালতে লিপিবদ্ধ করে। একজন এসপি পদ মর্যাদার সিবিআই এর অফিসারকে এই কেসের দায়িত্বও দেওয়া হয় হাইকোর্টের নির্দেশে। যদিও এর কোনো তথ্য প্রমাণ সাক্ষী আদালতে হাজির করানো যায় নি। আসলে এই নানা তথ্য সংগ্রহ করে সিবিআই যা তারা তাদের পর্যবেক্ষণে জানায় আদালতকে। পুলিশ যদিও এই সব তাদের  বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে অস্বীকার করে যায় আগাগোড়া। 

সেই থেকেই শুরু ভিখারী অন্তর্ধান অধ্যায়। যে অধ্যায় এর কথা আজ আমার মনে পরে গেলো এই রাত দুপুরে। সেই অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটন আজও হয়নি। রাজ্য ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছে। সেই ভিখারীর নানা গল্প কাহিনী রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করবো আমার এই রাতের অন্ধকারে এই আঁকিবুঁকি ব্লগে আঁকাবাঁকা অক্ষরে। যে গল্প হয়তো কোনোদিন কেউ বলে নি আপনাদের। 

হ্যাঁ, এই ঘটনা জানাজানি হবার পরই তো হৈ চৈ হুল্লোড় পড়ে যায় রাজ্যে জুড়ে। যেমন আজকাল ঘটছে চারিদিকে। এটা তো স্বাভাবিক একজন মানুষকে পুলিশ ঘর থেকে তুলে নিয়ে এলো তারপর কোনো হদিস নেই তার। আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ইস্যু ছাড়তে চান নি সেই সময় কিছুতেই। ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনিও।

 রাজ্য সরকারের অপদার্থতা আর ব্যর্থতা নিয়ে সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পদত্যাগ এর দাবি তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন। সেই সময় আকবর আলী খোন্দকার কে নির্দেশ দেন মমতা এই ইস্যু কোনো মতেই ছাড়া যাবে না, এই ঘটনা অনেক বড় ঘটনা। সরকার ব্যর্থ, পুলিশ ব্যর্থ। একজন জলজ্যান্ত মানুষকে পুলিশ ঘর থেকে তুলে এনে পিটিয়ে মেরে তার দেহ লোপাট করে দিলো। এটা মেনে নেওয়া যায় কি। যে ঘটনার বহু পরে ঘটে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের গণ আন্দোলন।

 কিন্তু সেই সময় বামেদের সরকার বাহাদুর বুঝে যান কোনো মতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ওই এলাকায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। মিটিং,মিছিল করতে দেওয়া যাবে না। আটকে দিতে হবে যে কোনো উপায়। না হলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বাড়বে। তাহলে তার সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। এটাই তো আজকাল দেখছি আমরা। সেই সময় সরকারের উপর চাপ বাড়াতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনশনেও বসেন ভিখারী ইস্যুতে। যাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে পারেন তিনি। এই চাপ বাড়িয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলার রাজনীতির সাক্ষী তো আমরা অনেক ঘটনাই দেখেছি। 

ভিখারী অন্তর্ধানের সময় ভিখারি পাসওয়ান এর স্ত্রী অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিখারী আন্দোলন পর্বে যে সন্তান এর জন্ম হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ছেলের নাম দেন ভিক্ট্রি পাসওয়ান। যাতে নিখোঁজ ভিখারীর সেই আন্দোলন জয় পায়। তৈরি হয় আন্দোলন মঞ্চ। ভিখারীর ভাই কানাই এর কাজের ব্যবস্থা করা হয়। পরে ভিখারীর স্ত্রীকেও জুট মিলে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়। রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যায় ভিখারীর সেই নিখোঁজের ঘটনাও।

তেলিনিপাড়া সেই সময় ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরবাড়ি। যখন তখন তিনি চলে যেতেন সেই আন্দোলনের আঁতুড় ঘর তেলিনীপাড়াতে। কিন্তু যে সময় তাঁকে ঢুকতেই দেওয়া হবে না কোনো ভাবেই তেলিনিপাড়াতে সভা করতে দেওয়া যাবে না ভোটের আগে। সব বাধা অতিক্রম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু পৌঁছে গেলেন তেলিনীপাড়ার সেই মাঠে সভা করতে। না, কোনো ভাবেই তাকে আটকে রাখতে পারে নি বাম সরকারের পুলিশ। যে ঘটনা তিনি বার বার তাঁর নিজের জীবনে ঘটিয়েছেন। সেটাই যে তাঁর আসল ক্যারিশমা। এই জন্য তিনি আন্দোলনের অগ্নিকন্যা। 

ভিখারী অন্তর্ধানের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে কি বলেন সেটা নিয়ে তখন চিন্তা বাড়ছে সরকার পক্ষের। এক প্ল্যান করা হলো। এই ভিড়ের মাঝে মমতার সভায় যা তিনি বলবেন সেটা রেকর্ড করতে হবে। টেপ রেকর্ডার করে। সেই সময় অমরেন্দ্র কুমার সিং হুগলীর ডিএম। চন্দননগরের মহকুমা শাসক নবনী দে। জেলাশাসকের নির্দেশ এলো মহকুমা শাসক এর কাছে। সরকার এর বিরুদ্ধে ভোটের আগে কি বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা রেকর্ড করে রাখতে হবে ওপর মহলের নির্দেশ। 

চন্দননগরের মহকুমা শাসক নবনী দে পড়লেন মহা ফাঁপরে। কি করেন ভাবছেন। কাকে দেবেন এই কঠিন কাজ এর দায়িত্ব। সাত পাঁচ ভাবছেন সেই সময় চন্দননগর মহকুমা তথ্য আধিকারিক এর সঙ্গে এসডিও সাহেবের বেশ বন্ধুত্ব। বললেন কি বিপদ বলুন তো। মমতার কথা রেকর্ড করার নির্দেশ এসেছে ওপর মহল থেকে। কি যে করি। খুব ভদ্র, সজ্জন, নিপাট ভালো সেই তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের তথ্য আধিকারিক বের হলেন টেপ রেকর্ডার এর খোঁজে। পেয়েও গেলেন একটি বড়ো টেপ রেকর্ডার। তারপর তেলিনীপাড়াতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার দিনে বড়ো বাজারের একটি ব্যাগে ভরে কোনো ভাবে লুকিয়ে সেই রেকর্ডার নিয়ে হাজির হলেন তিনি সভায় তেলিনীপাড়াতে।  একজন সাথে সহকারী হিসেবে অফিস এর লোক নিয়ে গেছিলেন তিনি। সাথে আরও এক সহযোগী। গ্রুপ ডি কর্মচারী। 

দূরে ডিএম অফিস থেকে দেওয়া গাড়ি রেখে কোনো রকমে ভীড় ঠেলে এগিয়ে সেই রেকর্ডার মঞ্চের কাছে বসিয়ে রাখা হলো। সুইচ অন করে। একটু ভয়ে ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন তারা। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কেউ বুঝতে পারলে আর জানতে পারলে আর ঘরে ফেরা হবে না তাদেরও। সেই বিখ্যাত ভঙ্গিতে সেদিন আগুন ঝড়েছিল নেত্রীর গলায়। রাজ্য সরকারের প্রতি বিষোদগার আর গাল দিয়ে সরকারের অপদার্থতাকে সেদিন তিনি তুলে ধরেছিলেন সেই তেলিনীপাড়ার সভায়।

 যা ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। মিটিং শেষ হলো। ভয়ে ভয়ে সেই অফিসার পরে যিনি হুগলী জেলার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক হয়েছিলেন, আরও পর যিনি নবান্নে কাজ করেছিলেন বেশ কিছুদিন ডেপুটি ডিরেক্টর পদে। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত সেই অফিসার ব্যাগটা কোনো রকমে মাটি থেকে ভয়ে ভয়ে তুলে এনে গাড়িতে চেপে সোজা এসডিও অফিস চন্দননগর চলে এলেন। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে এসে জানালেন হয়েছে সব কথা রেকর্ড। 

দেখলেন মহকুমা শাসক এর অফিসে বসে আছেন স্বয়ং জেলাশাসক এ কে সিং। চালানো হলো রেকর্ডার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই পরিচিত চেনা কন্ঠ। চেনা প্রতিবাদী স্বর। বাম সরকারকে উৎখাত করার ডাক। সরকারকে ফেলে দেওয়ার ডাক। যে সরকার এমন করে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে তার দেহ লোপাট করতে পারে সেই সরকারের আর এক মিনিট ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই বক্তা সেই বিরোধী কংগ্রেস দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ, প্রশাসনকে ধিক্কার জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, এর দায়ভার নিতে হবে জেলাশাসক আর এসপিকেও। যেটা শুনে ডিএম এ কে সিং কিছুটা ঘাবড়ে যান সেদিন। এর কিছুদিন পরেই যদিও বদলি হয়ে যান হুগলীর সেই ডিএম। 

কিন্তু সেই রেকর্ড করার ঘটনার কথা বলতে বলতে কিছুটা হলেও পুরোনো সেই দিনে ফিরে যাচ্ছিলেন সেই অফিসার। যিনি আজ অবসর নিয়ে চন্দননগর শহরেই থাকেন। সেই এসডিও সাহেব নবনী দে কলকাতায় চলে গেছেন অবসর নিয়ে বহুকাল আগেই। এইভাবেই তো নানা ঘটনা আর ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে এগিয়ে চলে ভিখারী পাসওয়ান এর গল্প। যা আমাদের সবার কাছেই শুধুই একটা ফিকে স্মৃতি মাত্র। কিন্তু তার সেই ঘটনা, ভিখারীর সেই নিখোঁজের ইতিহাস,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আন্দোলন তো আর মুছে যায়নি ইতিহাসের পাতা থেকে। যা আজও স্মৃতির পাতায় উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। 

ভিখারী অন্তর্ধান রহস্য - অভিজিৎ বসু।
প্রথম পর্ব।
আটাশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...