সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু ওই বুদবুদের কথা। জীবন তো ঠিক ওই বুদবুদের মতই। এই আছে আর এই নেই। এই আকাশে বাতাসে মেঘমল্লারে ভেসে থাকা আর এই অন্ধকারের আবছা ছায়া গায়ে মেখে অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া বা সেঁধিয়ে যাওয়া। সত্যিই অসাধারন এই বুদবুদের রকমারি নানা রঙের বাহারি খেলা। যা দেখে মনটা ভরে যায়।
ওদের আমি অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিলাম। ছোট্ট ওই বুদবুদের জীবনে ওদের উপচে পড়া খুশি আর হাসির ঝিলিক কেমন করে ছড়িয়ে পড়ছে। কেমন করে ওরা যেনো জিওন কাঠি হাতে নিয়ে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের সুখ আর দুঃখকে হাসি মুখে অনাবিল ভাবে। একটুও কিছু না ভেবেই, না চিন্তা করেই, না ভয় পেয়ে। আসলে বোধহয় এমন করেই বেঁচে থাকতে হয় জীবনে। ভেসে থাকতে হয় জীবনের সমুদ্রের ঢেউয়ের সব ঝড় ঝাপটা সামলে নিয়ে। একটা একটা করে দিন কাটিয়ে দিতে হয় এমনি করেই হাসি মাখা উজ্জ্বল মুখে আর সেই বনজোছনার রাতের চাঁদের নরম আলো গায়ে মেখে। জীবনের এই সব নানা ছবি আমায় যে বড় নাড়া দেয়।
মায়ের হাত ধরে শনিবার কঙ্কালীতলা মন্দিরের হাটে এসে বসা ওই ছোট্ট মেয়ে দুটির। ওদের হাতে সেই ছোটো বেলার এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া সেই লাল নীল বুদবুদের খেলনার জীবনকাঠি। গাছের নিচে বসে কেমন করে যেনো মেতে ওঠা এই বুদবুদের খেলায়। উড়িয়ে দেওয়া জীবনের সুখ আর দুঃখকে কত হাসি মুখে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ধরতে চায় ওরা। কিন্তু না এত সহজে কি আর সব কিছু ধরা দেয়। তবুও ওরা হাসি মুখে চেষ্টা করে যায় প্রাণপণ খিদে পেটে।
গাছের ফাঁক দিয়ে রোদের লাল আভা ঠিকরে পড়ে ওদের মুখে। বেচা কেনাহীন হাটে বসে আনমনে খেলে যাওয়া। আমি দুর থেকে দেখি ওদের। একমনে জরিপ করি ওদের। ওদের দু চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি আমার কঠিন মনের অন্দরে নাড়া দেয়। মনে মনে ভাবি সত্যিই তো এইভাবেই এক ফুঁ দিয়ে যদি জীবনের সব কিছুকে উড়িয়ে দিতে পারতাম কি ভালই যে হতো তাহলে সেটা আর পারলাম কই আমি এই জীবনে।
জীবনের সুখ দুঃখকে উড়িয়ে দিয়ে আনন্দে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠে বলতাম জীবন, আর জীবনের এই ব্যালেন্সের খেলায় আমি হারতে হারতেও জিতে গেছি আজ। আর তারপর একটা ওই গোল বলকে বুকে জড়িয়ে ধরে গায়ে মেখে বুকের অন্দরে চেপে ধরে রাখতে পারতাম আপন করে। তাহলে কি ভালই যে হতো। আর ওই মেঘের কোল ঘেঁষে হেঁটে যেতাম আমি আমার সেই রঙিন বলকে বুকে ধরে চুপি চুপি। আর মেঘের জলকণা কেমন করে গায়ে জড়িয়ে ধরত আমায় আমার শুকিয়ে যাওয়া বুড়িয়ে যাওয়া ওই আনন্দহীন জীবনকে। তাহলে কি ভালই যে লাগতো আমার।
আমি দুর থেকে সেই বুদবুদের আনন্দে ভেসে যাওয়া জীবনকে দুর থেকে দেখতে দেখতে ওদের কাছে চলে এলাম। একটু কেমন যেনো থমকে গেলো ওরা। কিছুটা বোধ হয় লজ্জাও পেলো ওরা আমায় দেখে। চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলো ওরা। তারপর ধীরে ধীরে আবার আগের মতোই কেমন করে ওরা দুজন ভালোবাসার স্বপ্নকে জাল বুনে উড়িয়ে দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। এক একটা স্বপ্ন,সুখের পরশ মাখা স্বপ্নের রঙিন পৃথিবীকে উড়িয়ে দিয়ে আনন্দে নেচে উঠল ওরা। হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করলো সেই উড়ে যাওয়া স্বপ্নকে। কিন্তু ধরার আগেই যে তারা ভেঙে গেলো। মিশে একাকার হয়ে গেল। তবু কেমন করে ওরা হাততালি দিয়ে উঠলো আনন্দে।
আমি ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। রকমারি বুদবুদের ভেসে যাওয়া দেখলাম। ওদের উজ্জ্বল মুখের হাসির উপচে পড়া ঝলক দেখলাম। ওদের কালো কুচকুচে চোখের তারায় কেমন আলোর নাচন দেখলাম। ওদের তেল না পড়া কালো ফ্যাকাশে চুলের জট পড়া বিনুনীতে দেখলাম গঙ্গা আর যমুনার জুটির দৃশ্য। আর ওদের পাশে হাত বাড়িয়ে টলমল করা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই লাল ফ্রক পড়া ছোট্ট মেয়ের দৃষ্টিতে দেখলাম মায়াবী নিষ্পাপ মন কেমন করা হাসি।
যে হাসি সুখ, দুঃখ, অভিমান,কষ্ট, যন্ত্রণা, ঘৃণা, প্রেম, ভালোবাসা, প্রতারণা, অবহেলা সব কিছুকে কেমন করে যেনো এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অবলীলায় একটা একটা বুদবুদকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ওই ছোট্ট হাতে। কখনও সুখ। কখনও দুঃখ। কখনও হাসি। কখনও কান্নাকে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয়। আমি এক মনে, এক দৃষ্টিতে ওদের দেখতে থাকলাম।
আমার চোখের সামনে দিয়ে ডানা মেলে উড়ে উড়ে বেড়ায় ওই বুদবুদের ঢেউ। ইচ্ছা হয় আমার হাত বাড়িয়ে ধরতে ওদের। কিন্তু কেমন যেনো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। সঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে ধরতে পারিনা আমি কিছুতেই সুখ আর দুঃখকে একসাথে। আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় ওরা, উড়ে বেড়ায় ওরা। আর ওই ছোটো শিশুরা সেটা দেখে কেমন খিল খিল করে হেসে ওঠে ওরা আপনমনে।
ওরা বোধহয় বুঝতে পারে কিছু। আমার এই না ধরতে পারা দেখে ওরা বেশ মজা পায়। আমি ওদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। ওরা আপনমনে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় বুদবুদের রকমারি নানা রঙের ভালোবাসার গোলা। আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায় কিন্তু না হাত বাড়িয়ে ধরতে পারিনা আমি কিছুতেই।
টলমল পায়ে ওই লাল ফ্রক পরা ছোটো শিশুটি আমার দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়। কেমন নিষ্পাপ চোখে আমায় দেখে। তারপর ভরসা দেয় ছোটো ছোটো হাতে সুখ আর দুঃখকে হাসি মুখে ধরে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি একমনে ওকে দেখি। ওই ছোট্ট শিশুকে দেখি। ওর ছোট্ট হাতে ধরা তখন ঐ ভালোবাসার স্পর্শ মাখা জীবন। কেমন করে কচি হাতে আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে সে।
সংকোচতা কাটিয়ে দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরি তাকে। আর সেটা দেখে হাততালি দিয়ে খুশিতে উপচে পড়ে ওরা দুজন। আনন্দে ওরা আরও বুদবুদের নানা রঙের ভালবাসার গোলা ছড়িয়ে দেয় আমার চারপাশে। আমিও তাদের দু হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করি।
বুদবুদের ভালবাসার জীবন - অভিজিৎ বসু।
একত্রিশ আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
জীবনকে এভাবে দেখতে,বুঝতে অনুভব করতে সকলে পারে না।সকলের মনের ভেতর সেই আকাশটা নেই। এই আরও বেশি চাওয়ার তেল মাখা বাঁশের ওঠানামার সমাজ সংসারে এ এক সংখ্যালঘু মনের একাকী হেঁটে চলা। লেখকের এ পথ ফড়িং -এর, শিশিরভেজা ঘাসের, হাটের মাঝে সকলের অগোচরে খুশির আলপনা বুনে দেওয়া বুদবুদের।
উত্তরমুছুন