সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু আকাশবাণীর সেই মনোজদার কথা। হ্যাঁ সেই মনোজ কর এর কথা। কলকাতা অল ইন্ডিয়া রেডিওর বিজ্ঞান বিভাগের মনোজ কর। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে নানা মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার নানা রঙের, নানা জীবনের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি আমি। যাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আমার এই জীবনে জড়িয়ে আছেন তাদের আর ভোলা যায়না কিছুতেই।
সেই পুরোনো স্মৃতি, সম্পর্ক, যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেলেও মনে হয় এমন একজন মানুষ যে শুধু সারা জীবন দৌড়ে কাটিয়ে দিলো একটা কাজকে গভীর ভাবে ভালোবেসে। সরকারি গণ মাধ্যমের এমন একজন অস্থায়ী কর্মী হয়েও কেমন করে যে এই ভাবে অস্থায়ী একটা জীবন কাটিয়ে দিলো কে জানে। কি করে যে কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাস তার নানা জানা অজানার মাঝে নিজের গোটা জীবনটা ডুবিয়ে দিলো কে জানে।
কিছু কিছু মানুষ বোধহয় এমনই হয়। যারা শুধু কাজ ভালোবাসে। মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করে হাসি মুখে কাজ করে যায়। সব কিছুর সামাল দেয়। দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলেও সব কিছুর মাঝে তাঁকেই লাগে না হলে যে অচল হয়ে যায় গোটা দপ্তরের কাজ। যাকে নিয়ে এত কথা, এত গল্প সেই মনোজদার সাথে আমার আলাপ পরিচয় হয় খুব সম্ভবতঃ ঊনিশ শো বিরানব্বই সালে। আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে। তখন সবে আমি সাংবাদিক হবো বলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।আনন্দবাজারের বিখ্যাত সাংবাদিক স্যার কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী আমায় বলেছেন একবার আকাশবাণীতে যেতে। বিজ্ঞান বিভাগের স্বাতী চট্টোপাধ্যায় এর সাথে দেখা করতে।
তার আগে যদিও একবার আমি যুববানীতে গেছিলাম সেই বিখ্যাত মানস মিশ্রর সাথে দেখা করেছি। একটা অনুষ্ঠান করেছি গ্রাম থেকে বলছি। ভজন আর আমি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আর গ্রামের লোকের কথা শোনা। সেই বিখ্যাত দিয়ারার গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে বলছি যেদিন প্রচার হলো রেডিওতে কি যে আনন্দ হয়েছিল সেটা আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না। প্রথম অভিজিৎ বসুর নাম শুনলাম রেডিওতে। পেলাম আড়াইশো টাকার চেক। কিন্তু সেই গ্রাম ছেড়ে সোজা বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ। দেখা করলাম স্বাতী চট্টোপাধ্যায় এর সাথে।
খুব লম্বা, রোগা, গম্ভীর নয় বেশ হাসি মুখে বললেন ও কাজী দেখা করতে বলেছে তোকে। ঠিক আছে কি কাজ করেছি জানতে চাইলেন আমার কাছে। ছোট্ট একটা কোনের ঘর, ফাইলের মধ্য ডুবে আছেন তিনি প্রায়। ফাইল থেকে মাথা তুলে বললেন ওই যে মনোজ আছে ওর সাথে যোগাযোগ করিস কিছু হলে ওই খবর দেবে। দেখলাম ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসে আছেন হাই পাওয়ার এর চশমা পরা একজন। আমি বললাম অভিজিৎ আমার নাম। হেসে বললেন হ্যাঁ ঠিক আছে এসো মাঝে মাঝে কিছু খবর হলে বলে দেবো আমি।
সেই শুরু আমার আকাশবাণীর আকাশ পথে বিচরণ করা একটু একটু করে। ধীরে ধীরে দেখলাম এই বিজ্ঞান বিভাগের আসল অফিসার সেই সময় স্বাতীদি হলেও। সেই গম্ভীর মুখের দত্তদা এই দপ্তরে কাজ করলেও যে নিজের ছেলে মেয়ের প্রশংসা বেশি করতে ভালোবাসতেন। এই দপ্তরের নাড়ী নক্ষত্র কিন্তু সব জানে ওই মনোজদা। দপ্তরের আসল চাবি ওই মনোজ দার হাতেই। কে কোন বিষয়ে বলবেন, কাকে বুকিং করতে হবে সব তার নখদর্পণে। মনোজ কর ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের চাকা পাংচার হবার অবস্হা।
আমি নিজে কোনো রকমে পাশ করে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে এই বিভাগেই স্বাতীদির দৌলতে অস্থায়ী কর্মীর কাজের সুযোগ পেলাম হঠাৎ করেই। আউটডোর কাজ করতে পারলেও স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে এডিটিং করা সেই কঠিন কাজ হাতে ধরে যে মানুষটা দিনের পর দিন হাতে ধরে শিখিয়ে দিলেন আমায় সেটা সেই মনোজ কর। স্টুডিওতে ডাক্তারদের রেকর্ডিং করা, অডিও ঠিক আছে কি না সেটা বলে দেওয়া, পুল আর রেকর্ডিং এর ফিতে ঠিক করে মেশিনে জড়িয়ে আটকাতে পারলাম কি না ঠিক করে। সব কিছুই কেমন হাসি মুখে দেখিয়ে দিত ওই মনোজ দা। ভুল করলেও কোনো দিন কোনো রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করেননি তিনি আমাদের ওপর।
আসলে এটাই বোধহয় ওনার জীবনের সবথেকে বড়ো প্লাস পয়েন্ট। আর তাই বোধ হয় শুধু বিজ্ঞান বিভাগের নয় যে কোনো বিভাগে কিছু কাজ এর দরকার হলেই ডাক পড়তো মনোজ কর এর। আকাশবাণীর সেই লম্বা করিডোর ধরে প্লাস্টিক এর চটি পরে কেমন হাসি মুখে সব কাজের সামাল দিয়ে অফিসারদের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিতেন। আর তাই যে কোনো কঠিন কাজ মনোজদা হাসি মুখে উৎরে দিত। একজন অস্থায়ী কর্মী হিসেবে যে ছয়দিনের বুকিং পেতেন সেটা নিয়েই। এর জন্য কিছু বাড়তি আয় হয়নি তার কোনো দিনই।
কেমন যেনো একটা নেশার ঘোরে কাজ করে যেতো মনোজ দা। কিন্তু কোনো দিন কোনো ভাবে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা কাউকে বলতে শুনিনি তাকে। আকাশবানীর সেই সময় স্বর্ণ যুগ। স্বাতীদি,কৃষ্ণশর্বরী দি, নুরুল দা, সমরেশ দা, অঞ্জন দা, জামাল দা, হীরক দা, অমর দা, বাসবী দি, অনেক পরে স্বপ্নময় দা, মানস প্রতিম দা, দেবাশীষ পাল দা, বার্তা সম্পাদক সুনিত চক্রবর্তী, অরিজিৎ দাশগুপ্ত, স্টেশন ডিরেক্টর বিখ্যাত মানুষ ড অমিত চক্রবর্তী। এই সব মানুষের মেলা তখন আকাশবাণীর অন্দরে। যেখানে নানা অনুষ্ঠান, আউটডোর, ইনডোর এর কাজ সামলে দেয় একঝাঁক তরতাজা ছেলে মেয়ে। যারা অস্থায়ী তকমা নিয়ে ক্যাজুয়াল কর্মী হয়ে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ করে যায় এই বিখ্যাত গণ মাধ্যমে সকাল থেকে রাত অবধি। তাদের একজন এই মনোজ কর।
কবে যে যাত্রা শুরু করে মনোজদা ঠিক জানি না আমি সেটা। তার কবে কত সালে এই কাজের জগতে প্রবেশ সেটাও জানি না আমি। কত সালে আকাশবাণীর দরজায় পা রাখে কে জানে। তবে প্রায় চল্লিশ বছর না হলেও পঁয়ত্রিশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে আজও মনোজ দা সেই বিজ্ঞান বিভাগের অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করে চলেছেন একভাবেই। একদম একভাবে, একরূপে সেই মুখে হাসি নিয়েই কাজ করছেন তিনি আজও। মাঝে মাঝেই আমার কথা হয় মনোজ দার সাথে।
কোনো বিপদে পড়লে বিজ্ঞানের এই বিষয় নিয়ে কে ভালো বলতে পারবেন জানতে চেয়ে ফোন করলে মনোজদা এক বাক্যে বলে দেন উনি হলেন সব থেকে ভালো লোক এই বিষয়ে। বলে তার নম্বর বলে দেন আমায়। সেই তো শুনেছি আমি লকডাউন এর সময় যখন একটু একটু করে ট্রেনে ওঠার অনুমতি মিলেছে যাত্রীদের। সেই সময় নিজে ট্রেনে উঠে সারা সপ্তাহের বিজ্ঞান বিভাগের কি অনুষ্ঠান এর টেপ জমা দিতে হবে সেটা ডিউটি রুমে জমা দিয়ে সব দায়িত্ব সামলে হাসি মুখে বাড়ী ফিরে যেতেন তিনি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি এমন অস্থায়ী একজন কর্মীর জন্য বোধহয় বিজ্ঞান দপ্তরও গর্বিত।
আসলে কি জানেন সাদা জীবনের কালো কথায় আঁকা বাঁকা অক্ষরে আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে এমন একজন মানুষের কথা না লিখলে বোধহয় ঠিক করতাম না। একজন সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হয়ে তাহলে বোধহয় সেটা অপরাধ করতাম আমি। মনোজদা না থাকলে হয়তো আকাশবাণী কলকাতা স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ দপ্তরে, বিজ্ঞান বিভাগে কাজ করতেই পারতাম না আমি। পরে সেই আকাশবাণীতে আমি নানা এন্টারটেনমেন্ট এর কাজ করেছি বিখ্যাত সেই সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে। যিনি আজ আর নেই। যে গল্প আমি লিখেছি।
কিন্তু সেই মনোজ কর এর কাছে কাজ শিখেই তো বিজ্ঞান মেলায় টেপ রেকর্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি চারিদিকে নানা জেলায়। গ্রামে শহরে বিজ্ঞান নিয়ে সচেতন মূলক নানা কর্মকান্ডকে তুলে এনে সেটা প্রচার করেছি আমরা। আর মাসের শেষে ছয় দিনের বুকিং দিয়ে যাতে আমরা ঠিক সময়ে চেক পাই তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এই আমাদের সবার মনোজদা। আমরা একসময় হয়তো ভেবেছিলাম যে এই অস্থায়ী জীবনে একটু স্থায়ীত্ব আসবে। তাই ক্যাজুয়াল কর্মী হলেও মাঝে মাঝে আশা ভরসা করতাম যদি ভালো কিছু হয় আকাশবাণীতে। এখানেই যদি জীবনের বাকি দিন গুলো কেটে যায় আমাদের। হয়তো মনোজদাও সেই স্বপ্ন দেখতো মনে মনে আমাদের মত। কিন্তু আমি মনোজদাকে সেই কথা কোনোদিন বলতে শুনিনি।
আশ্চর্য একজন মানুষ যে সারা জীবন মুখ বুজে একটা দপ্তরে বিজ্ঞান নিয়ে প্রচার এর জন্য সব কিছু উজাড় করে দিলো হাসি মুখে। আমি জানিনা মনোজদা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন কি না। জানি না বিজ্ঞানের প্রতি এই প্রেম ভালোবাসা কি করে হলো তাঁর। কিন্তু সে যাই হোক এই মানুষটা নিজের কথা ভাবলো না কোনোদিন যে তার কি হলো এই জীবনে। সেই চক্ররেল ধরে বাবুঘাটের কাছে ইডেন গার্ডেন্স স্টেশনে নেমে হেঁটে অফিস আসা। আর সন্ধ্যা বেলায় সেই এক জায়গা থেকে ট্রেন ধরে ঘরে ফেরা। আর সেই ছোটো টিফিন বক্সে রুটি আর তরকারি নিয়ে আসা। কাজের চাপে চারটে বেজে যেত টিফিন খেতে তার। কিন্তু আমায় বলতেন অভিজিৎ নাও খাও। আমি বলতাম না না তুমি খাও।
এমন হাসি মুখে একটা গোটা জীবনের প্রায় বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিলো শুধু বিজ্ঞান বিভাগের প্রচার করে। সত্যিই কি অসাধারন এই বিজ্ঞানময় অস্থায়ী জীবন। এই জীবন হয়তো কোনো দিন প্রচারের আলোয় আসবে না। আর কয়েক বছর পরে তাঁর ষাট বছর হলেই হয়তো মনোজদাকেও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মে আর অস্থায়ী কাজের সুযোগও দেওয়া হবে না তাকে আর। কোনও বুকিং মিলবে না আর তার।
কিন্তু আকাশবাণীর বহু অস্থায়ী কর্মীর মাঝে বিজ্ঞান বিভাগের এই মনোজ কর, আমাদের সবার কাছে কিন্তু উজ্বল হয়েই থাকবেন। বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞান আন্দোলনের এই প্রচারের একজন স্থায়ী সদস্য হয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন এই মনোজ কর। হয়তো কোনো ভাবেই কোনো দিন তাঁর এই কথা খাতায় কলমে কিছু লেখা থাকবে না, কিন্তু তাঁর এই অবদান মনে রাখবে আকাশবাণীর সকলেই। আর বিজ্ঞানকে ভালোবাসা মানুষজন। স্যালুট মনোজ কর।
আকাশবাণীর মনোজ কর - অভিজিৎ বসু।
পঁচিশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন