বাবার জন্য মেয়ের এই অনন্ত অপেক্ষা। আবার এই বাবার জন্যই মেয়ের জেল যাত্রা। বাবার জন্য মেয়ের এই যে এক বুক উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর বাবার হাত ধরে সেই চেনা পথ ধরে একসাথে ঘরে ফেরা। তার সাথে যে গভীর গোপন ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটার ছবি ধরা পড়ল আজ তিহার জেল এর সামনে কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যায়। যা দেখে ফের আবার আন্দোলিত হলো গোটা দেশের মিডিয়া সাথে বাংলার মিডিয়াও। হ্যাঁ, সেই বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলের জেল মুক্তির ছবি এখন সারা দেশ জেনে গেছে এতক্ষণে টিভির আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে।
আর সেটা জেনেই কেউ কেউ বলছেন পিতৃপক্ষের আগে কৃষ্ণ বন্দনা আর তারপরেই শুরু হবে উৎসব এর সূচনা । ফেসবুকের কালো দেওয়ালে আছড়ে পড়ছে নানা কথা নানা লেখা সমুদ্রের ঢেউ এর মত আছড়ে পড়ছে সেই সব কিছুই। কেউ বলছেন বাংলা মিডিয়ার এই চরম নির্লজ্জতার করুণ অবস্থা ভাবলে লজ্জা হয়। আবার কেউ বলছেন এই বার কি আবার চড়াম চড়াম ঢাক এর আওয়াজ শোনা যাবে বীরভূমের লালমাটির দেশে সোনাঝুরির জঙ্গলে। কেউ বলছেন তাদের দাদা মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছেন তাই মাথা উঁচু করেই জেল মুক্তি হলো তাঁর। অবশেষে গরু পাচার মামলায় জামিন পেয়ে গেলেন অনুব্রত মণ্ডল।
আমরা কেউই জানি না কত গরু পাচার করেছিলেন তিনি বছর বছর। কত টাকা তিনি রোজগার করে ছিলেন বেআইনি পথে। মেয়ে সুকন্যা মণ্ডল এর কি অপরাধ ছিল এই ঘটনার সাথে। আমরা এইসবের কিছুই জানি না। শুধু এটা জানি যে কেন্দ্রীয় এজেন্সী ভোটের আগে বীরভূমের বাঘ কেষ্ট মন্ডল কে ধরে নিয়ে গেলেন যাতে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক সুবিধা হয় কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের। কিন্তু সেটা যে খুব বেশি সুবিধা হলো তাদের তেমন নয় কিন্তু। সেটা তো ভোটের ফল প্রকাশের পরই দেখা যায়। ভোটের রাজনীতিতে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি রাজনীতির ময়দানে সুবিধা পেতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করা। যা ইদানিং খুব বেশি করে হচ্ছে সারা দেশেই।
যাকগে আজ সাদা জীবনের কালো কথায় শুধু সেই ঘড়ি দেখে পুলিশকে হুমকি দেওয়া বোম মারার নিদান দেওয়া সেই ডাকাবুকো কেষ্ট মণ্ডলের কথা। সেই যে মাথায় কম অক্সিজেন প্রবেশ করা দিদির খুব কাছের প্রাণের কেষ্ট মন্ডল এর কথা। সেই যে বীরভূম জেলার বুথ এর পর্যালোচনা মিটিং এ বসে বুথ সভাপতিকে বলা কত ভোটে পিছিয়ে আছেন আপনি বিজেপি র থেকে আপনার এলাকায়, দাদা অল্প একশো ভোট হবে। আপনার লজ্জা করে না সেটা বলতে আবার নতুন জামা পরে মিটিং করতে এসেছেন আপনি। সেই হলো কেষ্ট মণ্ডল। যিনি দলের একজন অনুগত সৈনিক। দিদির একজন অন্ধ ভক্ত। পার্টির একজন ইয়েস ম্যান।
হ্যাঁ, সেটাই হলেন তিনি। হাজার ঝড় ঝাপটা সামলে নিজের চেহারা অর্ধেক ঝরিয়ে দিয়ে, মাথায় কালো কুচকুচে চুলে কলপ করে জেল থেকে বেরিয়ে আজ হাসি মুখে মেয়ের হাত ধরেই ঘরে ফিরলেন তিনি। পরম বিশ্বাস আর নির্ভরতায়। যে তাঁর এই ঘরে ফেরার আশা হয়তো অনেকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। হয়তো নিজেই একসময় মনে মনে ভাবতেন আর কি তাঁর ঘরে ফেরা হবে কোনোদিন কোনো সময় কোনো ভাবেই। মেয়ে দিন কয়েক আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। বার বার তিনি জেলে থাকার সময় বলেছেন তার যা হয় হোক, তার মেয়েটার যেনো কোনো কষ্ট না হয় তার। মা মরা মেয়েই যে তাঁর একমাত্র সম্বল। এটাই ছিল তাঁর একমাত্র চাহিদা।
আর আজ সেটাই হলো মেয়ের মুক্তির পর নিজের ও মুক্তি হলো অবশেষে জেল থেকে। এই মা দুর্গা বাপের বাড়ী আসার কিছুদিন আগেই মেয়ের হাত ধরেই লিচুপট্টির সেই চেনা ঘরে ফিরলেন অনুব্রত মণ্ডল। যে বাড়ী আজ সেজে উঠেছে বহুদিন পরে। যে বাড়ীতে আজ খুশির জোয়ার। যে বাড়িতে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তাঁর এই প্রিয় কেষ্ট কে সংবর্ধনা দেবার কথা ঘোষণা করেছেন। একদম বীরের সম্মান। যে লড়াই আর কষ্ট সহ্য করে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি জেলে কাটালেন তার মেয়েকে নিয়ে সেটা হয়তো ইতিহাসে লেখা থাকবে।
কিন্তু এই যে মারাদোনা,মেসি, রোনাল্ডো কার্লোস, পাওলো রোসির মত বা জিনেদিন জিদান এর মত খেলোয়াড়রা গোল হজম করে খেলায় পিছিয়ে গিয়েও খেলার শেষ মিনিটে আবার হেরে যাওয়া খেলায় ফিরে আসা এই ভাবেই। সেই তাঁর চেনা কথায় খেলা হবে। ভয়ঙ্কর খেলা হবে। বলে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের বুকে ভয় ধরানো যায়। ভোটের বাজারে বাজার গরম করা যায়। আর তার ডিভিডেন্ড দলের কাছে সুদে আসলে দলের নেত্রীর হাতে তুলে দেওয়া যায়। সেটাই যে তার সারা জীবনের একমাত্র কাজ।
তাই চেনা পথ ধরে মেয়েকে পাশে নিয়ে ঘরে ফিরে আসার সময়। অজয় নদীর ওপর অবন সেতু পার হবার সময়, একশো আট শিব মন্দির পার হবার সময় নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রনাম জানিয়ে বলেছেন হে ভগবান আসল খেলা তো তুমিই খেলো, ভয়ঙ্কর খেলা। আমি তো শুধুই নিমিত্ত মাত্র।
আর সেই সময় খোয়াইয়ের মাঠের ওপর দিয়ে রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটানো। সেই সোনাঝুরির জঙ্গলে ইউক্যালিপটাস এর পাতায় ভীরু কপোতীর কাঁপন। কোপাই এর কালো জলে মাছেদের এদিক ওদিক ত্রস্ত ভাবে দৌড়ে বেড়ানো। কঙ্কালীতলায় মায়ের মন্দিরে ঘণ্টা ধ্বনি। মা তারার মন্দিরে ধুপ ধুনো আর ঘণ্টার আওয়াজ। আর শ্যামবাটির ক্যানাল পাড়ে চুপটি করে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়ন যেনো অপেক্ষা করছে। মেয়েকে পাশে নিয়ে এই সব দেখতে দেখতে নিজের ঘরে ফিরে এলেন বহুদিন পর। পূজোর আগে মেয়ে সুকন্যার হাত ধরে ঘরে ফিরে এলেন আমাদের সবার কেষ্ট দা।
মেয়ের হাত ধরে ঘরে ফেরা - অভিজিৎ বসু।
চব্বিশ সেপ্টেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন