দেশের বিচারব্যবস্থা আর অন্ধ নয়। এই বার্তা দিতেই বদলে গেলো ভারতের বিচারব্যবস্থার প্রতীক। আইন আর বিচার ব্যবস্থার এই যে প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো লেডি জাস্টিস এর মুর্তি বদলে যাওয়া যা নিয়ে ইতিমধ্যেই সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে হৈ চৈ। কেউ কেউ বলছেন দেশের সবকিছুই বদলে দিতে চাইছে দেশের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ৩০০ বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’ বিদ্যমান। তিন শতক পরে সেই প্রতীকের ভারতীয়করণ হল। বদলে গেলো ভারতের ন্যায়ের প্রতীক।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় সেই নতুন প্রতীক উন্মোচন করে ঘোষণা করেছেন, ‘‘আইন এখন আর অন্ধ নয়। আইন এ বার চোখ মেলে দেখবে আর সবাইকে সমান ভাবে দেখবে।’’ সেই ভাবনা থেকেই ন্যায়ের প্রতীকের চোখের বাঁধন খুলেছে। তরবারি সরে হাতে উঠেছে সংবিধান। তবে এর পাশাপাশি বদলেছে নতুন মূর্তির সেই পুরোনো পোশাকও।
আগের ‘লেডি জাস্টিস’-এর মূর্তিটি ছিল রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন। তার পরনে ছিল রোমান ঐতিহ্যের দুধসাদা গাউন। দু’বাহুতে বাজুবন্ধ। কোমরে কাপড়ের বন্ধনী। নতুন মূর্তির পরনে কুঁচি-আচল দিয়ে পরানো নকশা পাড়ের শাড়ি। গলায় কয়েক ছড়া হার, আর তার কানে রয়েছে লম্বাটে দুল, হাতে বালা। সঙ্গে কোমরবন্ধ এবং মাথায় ভারতীয় দেব-দেবীর মতো মুকুট।
ভারতে এই ‘লেডি জাস্টিস’-এর আগমন ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরেই। ন্যায়ের প্রাচীন মূর্তিটির সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় করিয়েছিলেন রোমান সম্রাট অগস্টস। সে প্রায় দু’হাজার বছর আগের কথা। পরে ওই একই ন্যায়ের প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয় ব্রিটেন-সহ বেশ কিছু দেশে। ভারতে ‘লেডি জাস্টিস’-এর আগমন ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরেই। প্রায় ৩০০ বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’। তিন শতক পরে সেই প্রতীকের ভারতীয়করণ হল। যে বদলকে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব থেকে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ‘মুক্তি’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান বিচারপতি।
ন্যায়ের প্রতীকের পরিবর্তনে যে সেই ‘মুক্তি’ হয়েছে, সেই মুক্তি কি সত্যি সত্যিই আসবে দেশের এই বিচার ব্যবস্থায়। চোখ বন্ধ করা মুর্তি চোখ খুলে কি সত্যি করেই দেশের বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে পারবে। সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে নানা মহলে উঠতে শুরু করেছে। সেই বহু পুরোনো ঔপনিবেশিক আমলের চিন্তা আর ভাবনা আজ হঠাৎ বদলে গেলো এক লহমায়। আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে এমনিতেই আমরা সবাই সমান। সেখানে বন্ধ চোখ করা সেই লেডি জাস্টিস এর মুর্তি দেশের স্বাধীনতার এত বছর পর একটা অন্য অনুভূতি আর শিহরণ জাগিয়ে দিলো গোটা দেশ জুড়ে। যা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা চর্চা।
গত কয়েক মাস ধরেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম সহ নানা রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে ভারতীয় আইন। শাসক বিজেপির নেতারা বলছেন, ‘‘ওই সবই ব্রিটিশ শাসকের প্রভাবমুক্ত হয়ে আদতে ভারতীয় আইনের ‘আত্মশুদ্ধি’র প্রক্রিয়া।’’ ন্যায়ের প্রতীকের ভারতীয়করণকেও সেই আত্মশুদ্ধি বলেই মনে করছেন বিজেপির নেতারা। তাঁদের বক্তব্য সেই ভারতীয়করণ করার জন্য যদি ন্যায়ের প্রতীককে ভারতীয় পোশাক পরানো হয়, তবে ক্ষতি কী!
কিন্তু বিজেপির এই বদল করে দেওয়াকে অনেকেই আবার কড়া সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না। তাই বিরোধীদের মত, এটা হলো দেশের বিচার ব্যবস্থার মধ্য গৈরিকীকরণ করে হিন্দুত্বের মৃদুমন্দ হাওয়াকে তার গতি একটু বাড়িয়ে দেওয়া। যাতে এই ভারতীয়করণ এর মধ্যে রাজনীতিকরণের সুক্ষ্ম বীজ বপন করা যায় ধীরে সুস্থে। সুপ্রিম কোর্টে বদলে যাওয়া লেডি জাস্টিস এর মুর্তি কি সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।
সেই লেডি জাস্টিস এর এক হাতে তরবারির বদলে রাখা হলো ভারতীয় সংবিধান। যে সংবিধান মেনেই দেশের আইন ব্যবস্থা চালু থাকে। দেশের এই সংবিধান হলো আমাদের রক্ষাকর্তা। আর তাই সেই সংবিধানকে লেডি জাস্টিস মূর্তির হাতে স্থাপন করে অন্য এক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। যা আগে কখনো ভাবনা চিন্তা করেনি কোনো দল। এমন কথা কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির। যে ভাবনা অনেক আগেই কংগ্রেসের করা উচিত ছিল বলে তাঁরা মনে করেন।
কংগ্রেস যদিও এই বদলকে বিজেপির রাজনীতির ফায়দা তোলা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছে। তাদের মতে দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আজ বদলে দিচ্ছে বিজেপি। এই রাজনীতি আর পাল্টা রণনীতির মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো বদলে যাওয়া এই লেডি জাস্টিস এর মুর্তি। যা আমাদের চোখে আমাদের দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত হয়ে গিয়েছিল গত তিনশো বছর ধরেই। সেই মুর্তিটি আজ বদলে গেলো আমাদের চোখের সামনে। সত্যিই কি বদলে গেলো ভারতের সংবিধানের অন্যতম এই আকর্ষণ লেডি জাস্টিস এর ন্যায় মুর্তি। না কি শুধু এই মুর্তি বদলের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ইতিহাস বদলের প্রক্রিয়া জারি রইলো।
খোলা চোখ,হাতে সংবিধান - মূর্তি বদলে সুপ্রিম বার্তা।
অভিজিৎ বসু।
সতেরো অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন