সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই চেনা পথে পঞ্চমী দর্শনের গল্প। যে চেনা পথ, যে চেনা মানুষ, যে চেনা শহর, যে চেনা গলি, যে ধীরে ধীরে বদলে গেছে অনেক আগেই। বদলে গেছে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনও। বদলে গেছে জীবনের অর্থ। আর তার সাথে আরও অনেক কিছুই। তবু এই বদলে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়া এই চেনা পথে পঞ্চমীর সন্ধ্যায় আলোর রেনু আর উত্তাপ গায়ে মেখে হেঁটে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগলো আমার।
যে পথ একদিন সেই ছোটবেলার কথা আমায় মনে করিয়ে দিলো বহুদিন পরে। আসলে বুড়ো বয়সে এই হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাকে ফিরে পেতে আমার ইচ্ছা করে খুব। সেই ছোটবেলার দিন, সেই ছোট বেলার মানুষজনকে রাস্তায় দেখে কত যে ভালো লাগে আমার কি বলব আপনাদের। শ্রীরামপুরে ঘরে বসেই সন্ধ্যায় জানলা দিয়ে কানে আসছিলো সেই বিখ্যাত পূজোর গান। যে গান প্রতি পুজোয় শুনতে পাই। একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও, তাতে আগুন পাবে, তবু আমাকে তুমি পাবে না। সত্যিই তো সেই চেনা পথে কি আর তাকে ফিরে পাওয়া যাবে আর কোনো দিন। দেশলাই কাঠির আগুন জ্বলা রাস্তায়।
না, চেনা পথে পঞ্চমীর এই সন্ধ্যায় আলো আঁধারি পথ পেরিয়ে কেমন করে আমরা দুজন নিস্তরঙ্গ গঙ্গার তীরে বসে স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম একদিন দুজন মিলে কতদিন আগে। যে স্বপ্ন নবমীর নিশিতেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল এই শহরের এক পূজো মণ্ডপে দশমীর প্রতিমা বিসর্জনের আগেই। কিন্তু সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে আজও বেঁচে থাকা। আর সেই চেনা নদীর তীরে বসে দুজন মিলে দেখা নৌকায় ছোটো কুপি জ্বেলে সেই মাঝির ঘরে ফিরে যাওয়া। আর পঞ্চমীর একফালি চাঁদ এর সেই মন কেমন করে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া আনমনে। এসব যে সেই চেনা শহরের দৃশ্য অবলোকন করেই বেঁচে থাকা আমার।
আজ বহুদিন পর সেই চেনা শহরে চেনা পথে আলোর ঝলকানি আর মাইকের গর্জন শুনতে শুনতে এগোতে থাকলাম আমরা। সেই কবেকার পুরোনো পূজো গোস্বামী পাড়ার সেই মিতালী সংসদ এর পুজোয় দেখলাম ফাঁকা মণ্ডপ। ফাঁকা চেয়ার। মা দুর্গার মুখে চেনা সেই স্মিত হাসি। খুঁজে বেড়ালাম আমার শৈশবকে তন্নতন্ন করে মণ্ডপের ভেতর। সেই ছোট বেলার অন্ধকার গলিপথ পেরিয়ে পুকুরের ধার দিয়ে এক দৌড়ে সন্ধ্যা হলেই ঢুকে পড়তাম মিতালী সংসদের মণ্ডপে আর বুকে ব্যাজ লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম এই পঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই। না, আজ আর কোনো গেটেই কাউকে খুঁজে পেলাম না যে আমি। বন্দুক নিয়ে দৌড় দেখতে পেলাম না কোনো শিশুরও।
উঠে পড়লাম আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সেই রাজবাড়ীর খেলার মাঠ আর সেই ভেঙে পরা বুড়িমার বাড়ির পুজোয়। হলদে আলোর স্পর্শ নিয়ে ফাঁকা নিস্তব্ধ রাস্তায় শুধুই আমরা তিনজন হেঁটে চলেছি ধীর পায়ে। আংগু পাঙ্গু আর গাঙ্গু। হ্যাঁ আমরা এই তিন জন। একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা এই চেনা পথের পথিক হয়ে। গন্তব্য কোথায় হ্যাঁ সেই আমাদের চেনা রাজবাড়ীতে। কিন্তু রাজবাড়ীর গেটে যে তালা পড়ে গেছে অনেক আগেই। পঞ্চমীর বোধন হবার পরেই তালা পড়ে গেছে অনেক আগেই সেই রাজবাড়ীর সিংহদুয়ারে। শুধু চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ীর ভেঙে পড়া স্থাপত্য আর তার ইতিহাস। একা, একদম একা। আর তাকে চারিদিকে ঘিরে আছে ছোটো ছোটো বাক্সের কুঠুরির মত নানা সাইজের ছোটো ছোটো ফ্ল্যাট আর ঘর। মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেলো। রাজবাড়ী দর্শন হলো না বলে। আর সেই চেনা খেলার মাঠ আজ কত বদলে গেছে।
গঙ্গার তীর ধরে সেই আবার চেনা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চলে এলাম সেই হরবাবুর ঘাট,সেই সিইএসসির ক্লাব। রাস্তায় দেখা হলো রাজুর সাথে সেই চেনা মানুষ এর উজ্জ্বল হাসি মাখা মুখ। কত পরিচিত মুখ যে এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই শহরে কে জানে। আলোয় ঘেরা সিইএসসির মাঠ, সেই চেনা ঠাকুরের মুখ কেমন যেন বদলে গেছে মনে হলো যে। তাহলে শুধু আমার জীবন বদলে যায়নি বদলে গেছে মার মুখও এই সেই বহু পুরোনো চিত্তরঞ্জন ক্লাবের মাঠে। কেমন দুধে আলতার মতন রং বদলে গিয়ে অন্য রং এর মনে হলো। শুধু বদলে যায়নি সেই রাস্তার পাশের চেনা রেশন দোকান আর তার ওপর সেই ভেঙে পড়া এক চিলতে ঘর। যে ঘর আমার খুব চেনা বহু দিনের চেনা।
সি ই এস সি ক্লাবে বদলে যাওয়া মাকে নমস্কার জানিয়ে সোজা রিমঝিম বৃষ্টির ধারায় স্নান করবো বলে সেই বহু পুরোনো ভেঙে পড়া পাড়ার চেনা মাঠে লাহিড়ী পাড়ায় চলে এলাম আমরা হাঁটতে হাঁটতে। সেই আগের জাঁক জমকের পূজো আর নেই এই পাড়ায়। বদলে গেছে পূজোর চালচিত্র, পূজোর অনুষঙ্গ, আলোর রোশনাই অনেক কিছুই। কিন্তু ভালো লাগলো এই বদলে যাওয়া জীবন আর শহরের মাঝে কেমন হঠাৎ করেই রিমঝিম বৃষ্টির দেখা পেয়ে গেলাম আমি।
যে এতটুকুও বদলে যায়নি এই হাজার বদলে যাওয়ার ভীড়ে। ওর মুখের হাসি, ওর দু চোখের তারায় আলোর ঝিকিমিকি। ওর এক চিলতে ছোট্ট ঘরে সগর্ব আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওর উপস্থিতি, কেমন পঞ্চমীর চাঁদ এর আলোকেও কেমন ম্লান করে দিলো যেনো। শহরে হাজার আলোর ভীড়ে রিমঝিম বৃষ্টি কেমন অন্য রূপে বিরাজ করছে যেনো একা একাই। সত্যিই বিশ্বাস করুন এই বদলে যাওয়া চেনা পথে পঞ্চমীর সন্ধ্যায় আমার সেরা প্রাপ্তি এই রিমঝিম বৃষ্টির দর্শন মেলা।
মনটা ভরে গেলো বেশ হাজার মন খারাপের মাঝে ভালো হয়ে গেলো যে এই পঞ্চমীর সন্ধ্যায়। ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম আমরা। বেশ ভালো লাগলো যে পূজোর এই পঞ্চমীর সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়াতে চেনা পথে। ফেরার পথে আলোয় আলোকিত উদ্ভাসিত সেই জেলার প্রথম হওয়া পূজোর মণ্ডপে কুলার এর ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আর হাওয়া সামলে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেক কষ্ট করে। যে আলোর রোশনাই আমায় মোহিত করলো। যে মণ্ডপের আলোর রোশনাইয়ে পঞ্চমীর চাঁদের আলো কেমন ম্লান হয়ে গেছে অনেকটাই। তবু কেমন যেন নিজেকে সেই অচেনা আলো গায়ে মেখে মুঠোফোনে নিজেকে বন্দী করলাম বারবার অনেক বার।
আর এই অচেনা আলোর পথ ছেড়ে ধীরে ধীরে এপারে ঘরের দিকে ফিরে এলাম আমরা। ফাঁকা রাস্তায় বাড়ির পাশের চেনা মণ্ডপে তখনও শেষ মুহূর্তের কাজ হচ্ছে জোর কদমে। রাত পোহালেই যে ষষ্ঠীর বোধন মা দুর্গার। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সেই বড়বাগানের যে গলিতে ছোট বেলায় ঘুড়ি ধরে বেড়াতাম আমি দৌড়ে দৌড়ে। সেই কম আলোর রাস্তায় মার আজ অন্য রূপ। প্রেম বিলানো গৌড় নিতাই রূপে বিরাজ করছেন মা আমার এখানে। সত্যিই বলছি এত বদলে যাওয়ার মাঝে রিমঝিম বৃষ্টির দেখা পেয়ে কেমন যেন একটা মন ভালো নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় পূজো পরিক্রমা করে। বদলে যাওয়া শহরের গলিপথে রিমঝিম বৃষ্টির ধারায় স্নাত হয়ে।
চেনা পথে পঞ্চমী দর্শন - অভিজিৎ বসু।
নয় অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন