আমার কোনো ঘুরতে যাওয়ার জায়গাই নেই। আর তাই ছবি তোলারও কোনো সুযোগ নেই আমার। সেই ছবি ওই আকাশ পানে উড়ে যাওয়ার বিস্ময়কর মুখের ছবি। সেই ছবি হাসি মাখা মুখের ছবি। সেই ছবি সিনেমার আলো আঁধারির পথ পেরিয়ে মাল্টিপ্লেক্সের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে উজ্জ্বল মুখের হাতে হাত ধরা দুজনের সুন্দর হাসি মুখের ছবি। সেই ছবি যা সমুদ্রের সফেন উত্তাল জলরাশির মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে একে অপরকে আশ্লেষে, আবেগে, আর আনন্দে জড়িয়ে ধরার, চুমু খাওয়ার ছবি। আবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সাফল্য আর হাসিমাখা মুখের উজ্জ্বল সেই ছবি। কখনও ঠাণ্ডা ট্রেনের কামরায় চড়ে কিম্বা আকাশপথে উড়ে যাওয়ার আগে সকলকে হৈ হৈ করে জানিয়ে দেওয়ার সেই ছবি। আমাদের জীবনটা বোধহয় ছবিময় হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ছবির মধ্যেই কি বেঁচে থাকার চেষ্টা করা আমৃত্যু।
কে জানে কয়েক দশক আগেও তো মানুষ দিব্যিই বেঁচে ছিল এই ছবি ছাড়াই। ছবির ঝাপটায় এত নাজেহাল হতে হয়নি তাদের কখনও। কয়েক দশক কেনো হাজার হাজার বছর ধরেই তো মানুষ দিব্যিই বেঁচে আছে এই ছবি ছাড়াই। সেই সময় সকালে ঘুম ভাঙত তাদের, অফিস কাছারি করতো সবাই বাস, ট্রাম আর ট্রেনে চেপে, মাঠে খেলতে যেতো, মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল এর খেলা দেখতে যেতো, তারা সিনেমা বায়োস্কোপ দেখতে যেতো, প্লেনে চেপে বা রাজধানীতে চেপে বেড়াতেও যেতো দিল্লী, হরিদ্বার, গোয়া , মুসৌরি, পুরী এমনকি সুন্দরী কাশ্মীরেও। কেউ কেউ আবার বিদেশ ভ্রমনেও যেতো কালে ভদ্রে। আত্মীয় স্বজনের বিয়ে বাড়িতেও যেতো হাসিমুখে দল বেঁধে সকলে মিলে। তাহলে এসব নিয়েই তো দিব্যি সুখেই বেঁচে ছিল এই ছবিময় নয়, ছবিহীন মানুষেরা সবাই মিলেমিশে একসাথে হাতে হাত ধরেই।
তাহলে কি এমন হলো পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তনের মত সব বদলে গেলো যে হঠাৎ করেই একদিন। ছবিতে আর অন্যকে দেখিয়ে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই স্বস্তি পাওয়া আর নেমতন্ন বাড়িতে তৃপ্তি লাভ করে ঢেঁকুর তোলা। এই বদলে যাওয়া জীবনটা কি হঠাৎ চলে এলো সেই আচমকা দানা ঝড়ের মতোই, কে জানে। এই ক্ষুদ্র জীবনে আরও কত কিছুই যে ছিল আমাদের কে জানে।
আমার আজও মনে আছে আমার দাদু রাতে মারা গেলেন আমার বয়স তখন দশ বছর হবে। শ্রীরামপুর এর সেই পাঁচ নম্বর এঁদোপুকুরের সেই হেলেপড়া আর ভেঙে পড়া টালির ঘরে দাদু মারা গেলেন মাঝ রাতে। আমি পাশের ঘরে শুয়ে আছি। মা, মামারা, দিদা সবাই কাঁদছে আপনমনে। আপনজনের ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনায়।
পরদিন ভোরবেলায় দাদুর শেষ ছবি তোলার জন্য খবর দেওয়া হলো একজনকে। সেই দাদুর লাল পায়ের আর দাদুর মালা জড়ানো দাড়ি মুখের ছবি তুলে রাখা হলো সেই সাদা কালো ক্যামেরায়। না, আমি সেই দাদুর চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্যকে দেখতে পারিনি কিছুতেই। অনেকে বলেছিল দাদুকে দেখে প্রনাম করতে কিন্তু পারিনি আমি। সেই সাদা চাদর জড়ানো ছবি যা দেখে মন খারাপ করতে চাইনি আমি সেই ছোটবেলায় কিছুতেই। ভোরবেলায় সেই ছবি তোলার লোক এসে পট পট করে কালো ব্যাগের ছেঁড়া চেন খুলে কালো ক্যামেরা বের করে সাদা কালো ছবি তুলে দিলো দাদুর। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গিয়ে আসার জন্য তাকে দশ বা পাঁচ টাকা বেশি দিতে হয়েছিল।
সেই তো ছিল ছবি তুলে বেঁচে থাকার দিন। সেই বিয়ে বাড়িতে সাদা কালো ছবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে হাসি মুখের কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তের ছবি। একে অপরকে মালা পরিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ছবি। যে ছবি আজ হারিয়ে গেছে সেই টিনের ট্রাঙ্কের ভেতরেই। সেই সব ছবির মাঝে এখন লাল লাল মরচে পড়া সরু সরু বিস্তর দাগ। হারিয়ে গেছে সেই সব ছবির মানুষজনও কবেই। কিন্তু আজও বাক্সবন্দী হয়ে রয়ে গেছে সেই লাল মরচে ধরা, মরচে পড়া সেই জীবনের নানা টুকরো টুকরো জলছবি। যে সাদা কালো টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, যন্ত্রণার আঁধার কালো দিন আর রাত্রি যাপনের নানা সময়ের নানা মুহূর্তের ছবি।
আর আমি আজও যে দাদুর শেষ ছবি দেখতে পারিনি ভয়ে না যন্ত্রণায় জানিনা আজও কিছুতেই। সেই ছোট্ট ছেলের বুকের মাঝে আজও অমলিন হয়ে বেঁচে আছে দাদুর সাথে সেই দুপুর বেলায় পুকুরপাড়ে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরার ছবি। মাছ ওঠার পর সেই আনন্দের মুহূর্তের দাদু আর নাতির উজ্জ্বল মুখের সেই আমার সেই শৈশবের ছবি। সেই বাড়ির উঠোনে শীতের সকালে সাদা ফুলকপি তুলে এনে মাকে দিয়ে বলা দেখো দেখো আজ এগুলো হয়েছে বাগানে দাদু করেছে এইসব কপি। সেই শীতের সকালে সবুজ পালং শাকের ডগায় কুয়াশায় ভিজে যাওয়া পাতার ছবি। দাদু চলে যাওয়ার পরও সেই টালির ঘরের ওপরে সেই বড়ো হুইল ছিপটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম আমি শীতের সকালে। সেই বাড়ির পাশের পুকুরে ঘাই মারতো মাছ। তারা আপন মনে খেলা করতো শীতের ঠাণ্ডা জলে। হয়তো অপেক্ষা করত তারাও। না, আর কোনোদিন আমার ছিপ ফেলা হয়নি। আজ এই ভোররাতের অন্ধকারে মনে পরে যায় সেই ছবির কথা।
ভাগ্যিস সেদিন আমি দাদু চলে যাওয়ার দিন সেই শেষ সাদা চাদরে মোড়া ছবিটা দেখতে পারিনি। তাই বোধ হয় সাদা জীবনের কালো কথায় আজও সেই সাদা কালো অমলিন ভালোবাসার সেই হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলো মরচে পড়ে গেলেও কোনো ভাবে বেঁচে আছে আজও। যে ছবিকে বুকে আঁকড়ে ধরে আমিও কেমন দিব্যিই সুখেই বেঁচে আছি।
আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন,
তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা।
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়
আকাশের নীড়;
ওই যে যারা দিনরাত্রি
অলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি
তুমি কি তাদেরি মতো সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।
এতো সেলফি কেনো? - অভিজিৎ বসু।
বাইশ অক্টোবর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন