সে আসছে। আর একটু দূরে আছে এই এসে পড়ল বলে। এই ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড ধরে, ঘড়ি ধরে, পাঁজি দেখে তার আসার জন্য সবাই মিলে হাঁ করে অপেক্ষা করা। ঠিক যেনো বিয়ে বাড়িতে বর আসার অপেক্ষায় থাকা। আর তারপর ঝড় এর কাছে ছুটে চলে যাওয়া দৌড় দিয়ে একছুটে। হ্যাঁ, ঝড় এর কাছে ছুটে যেতে বেশ ভালই লাগে কি বলুন। জীবনের এত ঝড় ঝাপটা সামলে নিয়ে এই দানা, বেদানা বা ডালিম ঝড় এর কাছে যেতে আর ভয় কি বলুন।
সত্যিই আজকাল বেশ হয়েছে ঝড় এলেই একটা নাম চেপে যায় তাঁর গায়ে। ঠিক ওই নতুন শিশু শুধু ভূমিষ্ঠ হবার পরে যেমন হয় আর কি। আচ্ছা ওই দানা নাম কেনো হলো। কে জানি হয়তো কিছু ভেবেই অমন নাম দিয়েছেন হাওয়া অফিসার। দানা তো খায় পশুরা। আবার অন্ধকার জগতের লোকজন বলে ওই যে দানা ভরে দেবো কিন্তু। তাহলে দানা কি সত্যিই আমাদের ভরে দেবে এইবার। এই সুন্দর হাসিখুশি জীবন যদি দানাময় হয়ে যায় তাহলে কি যে হবে কে জানে।
আর ওই যে আয়লা। কি মিষ্টি নাম বলুন তো। ঠিক যেনো জলে ভেজা গ্রামের বধু কলসী কাঁখে নিয়ে ঘরে ফিরছে। আর আমি রাস্তার পাশে বাবলা গাছের নিচে বসে একমনে দুর থেকে দেখছি তাকে চুপি চুপি। ভেজা শাড়ির শপ শপ আওয়াজ। কলসীর মুখের জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, হলুদ প্রজাপতির উড়ে যাওয়া, সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। না তাকে আয়লা বলে ডাকা হয়নি কোনোদিনই। সেই সাহস হয়নি যে আমার। ঝড় কে কাছে ডাকার, কাছে আদর করে ডাকার মত বুকের পাটা আর দম কোনোটাই যে নেই আমার। তবু ঝড় এলেই কেমন যেনো উদাস হয়ে যাই আমি।
মনে পড়ে যায় সেই ফণীর কথা। ওই নামটা শুনলেই মনে হয় মনিহারা ফণীর কথা। কিন্তু আমাদের পাড়ার ফণী বেশ সুন্দর হাসিখুশি ছেলে ছিল। পাড়ায় এই বাড়ী ওই বাড়িতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে টুকটাক কাজ করত সে। একটু আধটু ইলেক্ট্রিকের কাজ জানত সেই ফণী। তাই আমরা ওকে দরকার পড়লেই ডাকতাম। আর ফণী একগাল হেসে চলে আসতো আমাদের বাড়িতে। কিন্তু হঠাৎ একদিন অন্ধকার রাতে সেই ফণী সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো। দূরে অনেক দূরে সেই ঝড়ের রাতেই।
আজকাল ঝড় আসছে ঠিক বুঝতে পারা যায় কি বলুন। সুগার রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়ার মতো, হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ভিআইপি রোগীর মেডিক্যাল বুলেটিনের মত হাওয়া অফিসের অফিসার এর ওয়েদার এর বুলেটিন দেখে। একদম ঠিক যেনো ডার্বি ম্যাচের ধারাভাষ্য দেওয়া কতদূর আছে সে গোলপোস্ট থেকে। কোথায় তার ল্যান্ডফল হবে, কোথায় মারবে সে তার লেজের ঝাপটা। ঠিক যেনো সেই সুরজিৎ সেনগুপ্তর কর্নার কিক মারার মত এগিয়ে আসা গোলপোস্টের দিকে।
আকাশে মেঘের ভেলায় থম মেরে আছে চারিদিক। গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে রিপোর্টারদের ছুটে চলা। আর সেই ঝড় এর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাতে বুম নিয়ে আর এক বুক সাহস নিয়ে। আর এক নিশ্বাসে জীবনকে বাজি রেখে ঝড়ের বর্ণনা দেওয়া। আর আমরা ঘর থেকে বসে সেটা শুনে আহা উহু করে তাঁকে স্যালুট দেওয়া। সত্যিই ঝড় যেনো এখন অনেক বদলে গেছে। প্রতি মুহূর্তে নতুন রূপে সেজে গুজে এসে পড়ছে সে আমাদের সামনে। আর সেই ঝড়ের খোঁজে গিয়ে তার ছবি ধরে প্রান হাতে করে বেঁচে আছে আমাদের সংবাদ মাধ্যমের বন্ধুরা। ঝড়ের এমন লাইভ টেলিকাস্ট না, মনে পড়ে আমার। মনে পড়ে যায় সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান, ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হলো সাথী।
এমন ঝড়ের রাতেই তো সেই আমার ছোটবেলায় দপ করে ঘরের কুপি বা লণ্ঠন এর নিভে যাওয়া। পাড়ায় তখনও কারুর ঘরে কারেন্ট আসেনি। ঘরের দেওয়ালে যে ছায়া পড়ছিল সেই ছাওয়ার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাওয়া। সেই দুর থেকে ছুটে আসা গোঁ গোঁ আওয়াজ। পশ্চিমের পলকা জানলার ফাঁক দিয়ে সেই ঝড়ের টের পাওয়া। ভয় পেয়ে কেমন মার কোলের কাছে সেঁধিয়ে যাওয়া। মার আঁচলের কাপড়ে তখন হলুদ বাটার সেই কাঁচা হলুদের গন্ধ আজও নাকে লেগে আছে আমার।
সেই আমাদের টালির ঘরে আর তার পলকা দেওয়ালে তখন ঝড়ের প্রবল হানা। না, সেই সময় সেই ছোটো বেলায় ঝড় এর কোনো নামকরণ হয়নি কোনোদিনই। ঠিক ওই ছোটো শিশু যাকে কেলো, পাঁচু, মিঠাই, বলে পাড়াতে ডাকা হতো সেই আমলে তেমন নামও জোটেনি সেই পুরোনো আদ্যিকালের সেই ঝড়ের। দানা , আয়লা, আমফান তো দূরের কথা। হয়তো সেই ঝড় বড্ড ব্যাকডেটেড ছিল আজকালের এই ঝড়ের থেকে। কিন্তু সেও ঝড়ই তো ছিল। যে ঝড় আপডেটেড না হলেও বড্ড ব্যাকডেটেড ঝড় হয়েও বেঁচে ছিল আমার জীবনে কাঁচা হলুদের মিষ্টি গন্ধ নিয়ে।
ঝড় উঠেছে - অভিজিৎ বসু।
তেইশ অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন