আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।
আমি কাঁদলাম
বহু হাসলাম
এই জীবন জোয়ারে ভাসলাম
আমি বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রাখলাম নিশানা।
ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান এর কথা মনে পড়ে গেল আমার এই ঝড়ের সময়ে। কতদিন আগে এই গান গেয়েছিলেন হেমন্ত বাবু। সত্যিই ঝড়ের কাছে আমার নিজের ঠিকানা রেখে আসার জন্যই তো এই দৌড়। এক ছুটে চলে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের মাঝে। ঝড়ের কাছে, একদম কাছে ছুটে যাওয়া।
আর সেখানে গিয়ে হাসা, কাঁদা, ছবি তোলা, জলে ভেজা, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত গতিতে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলা ঝড়ের কাছে, সামনে। যাতে ঝড়কে জড়িয়ে ধরা যায় ঠিক এই ভালোবাসার বাহুডোরে। এই সময়ে হঠাৎ চোখে পড়ল এক আমার পরিচিত পুলিশ অফিসারের একটি ফেসবুক পোস্ট। তিনি লিখছেন সাইক্লোন ট্যুরিজম শব্দটি তিনি প্রথম শুনলেন। মানে এই ঝড়ের রাতে একদল মানুষ দুর্যোগ দেখতে বেরিয়ে পড়েছেন। এই আর একদল মানুষের দুর্ভোগ দেখতে বেরিয়ে পড়েছেন কেমন হাসি মুখে। হ্যাঁ, হুগলীর সেই বিখ্যাত এই পুলিশ অফিসার একসময় বিখ্যাত হয়েছিলেন নন্দীগ্রাম এর আন্দোলনের সময়। বর্তমানে যিনি পশ্চিম মেদিনীপুরে পোস্টিং আছেন।
ভেঙে পড়া গাছ, টিনের চাল উড়ে নেড়া হয়ে যাওয়া ভেঙে যাওয়া ঘর, একরাশ দুশ্চিন্তা আর শুকনো মুখে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকা কিছু গরীব মানুষের হাহাকার আর অনুজ্বল মুখ দেখতে। একটুকরো ত্রিপল পাওয়ার জন্য হাহাকার, একটু জল পাওয়ার জন্য হাহাকার, একটু খাবার পাওয়ার জন্য কোলে দুধের শিশু নিয়ে মায়ের আকুলিবিকুলি করা। এই সব কিছুকে এড়িয়ে শুধুই ট্যুরিজম এর টানে দামী গাড়ি নিয়ে ঝড়ের কাছে ছুটে যাওয়া। মনে হল আচ্ছা এইভাবে যারা ঝড়ের কাছে ছুটে চলে যান তাদের জীবনে বোধহয় কোনো ঝড়, ঝঞ্ঝা, বিপর্যয় কিছুই নেই। কিছুই আসেনি কোনোদিন কোনো সময় কোনোভাবেই। তাদের গোটা জীবনটাই বোধহয় বাম্পার ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালানোর মত।। তাই কি তাঁরা সবাই মিলে এই ঝড়ের রাতে বৃষ্টি ভেজা পথে এগিয়ে চলেন তার কাছে কোনো কিছুর পরোয়া না করেই, কে জানে হয়তো তাই হবে।
এই বিপর্যয়কে কাছ থেকে দেখার যে বাসনা সেটা ঠিক এমন সাইক্লোন আসছে তো কি হয়েছে, চলে তো যাই তারপর দেখা যাবে। এটা বেশ বাড়ছে দিন দিন। এই ক্ষুদ্র প্রাণের ভয় করে আর কি হবে। আর তাই দীঘা, পুরী আর মন্দারমনিতে ভীড় জমিয়েছেন এই ঝড়ের সময় বহু মানুষ এটাই এখন একটা ট্রেন্ড এই ডার্ক ট্যুরিজম এর টানে ছুটে বেরিয়ে পড়া। ঠিক ওই রাতের বেলায় খেয়েদেয়ে একটু ডার্ক চকোলেট খাওয়ার মতই। একটু এই আলুনি আর এই ম্যাদামারা জীবনে ডার্ক ট্যুরিজম বা আঁধার পর্যটনের অভিজ্ঞতা করলে ক্ষতি কি। ক্ষতি তো কিছু নেই তাতে।
বহু মানুষের বহু শখ আছে। খাওয়া, ঘোরা, বেড়ানো, টাকা জমানো, কিন্তু এই শখ একটু অন্য ধরনের নতুন স্বাদের জন্য। এই ডার্ক ট্যুরিজম হলো সেই পর্যটন যে জায়গাগুলোতে ট্র্যাজেডির চিহ্ন আছে। এসব জায়গায় গিয়ে মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ, মহাবিপর্যয়, দুঃখ কষ্ট দেখে আনন্দ পায়। তারা হাসি মুখে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলে খুশি হয়। সেই বিপর্যয় আর গণহত্যার জায়গায় দাঁড়িয়ে। এটাই তো এখন জীবনের অন্যতম একটা ফ্যাশন আর স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে গেছে।
জাপানের হিরোশিমা দর্শন, নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরো, লিথুয়ানিয়াতে কেজিবির সদর দফতর, ইউক্রেন শহরের চেরনোবিল এইসব জায়গাগুলো হলো এখন এই ডার্ক ট্যুরিজমের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষে উঠে এসেছে। কেউ কেউ আবার একে ব্ল্যাক ট্যুরিজমও বলেন। আর এইসব বিখ্যাত জায়গায় দর্শনীয় জায়গায় ঘোরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষকে। যার জন্য তৈরি হয়েছে নানা রকম ব্যবস্থাও।
পোল্যান্ডের বন্দী শিবির, হিরোশিমা নাগাসাকি শহর, নিউ ইয়র্কের সন্ত্রাসবাদী হামলায় ভেঙে পড়া বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র, চীনের নানচিং গণহত্যার স্মারক হল, যুদ্ধবিধ্বস্ত চেরনোবিল দর্শন, এমন বহু জায়গায় ছুটে যান মানুষ শুধু দুঃখের দর্শন করে জীবনে একটু অন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। যে অভিজ্ঞতা তার মনের মণিকোঠায় জ্বল জ্বল করবে সারাজীবন ধরে। আর যাকে বুকের মাঝে আগলে বেঁচে থাকবেন তিনি বাকি জীবন।
ঠিক এমনই হলো সাইক্লোন ট্যুরিজম। যে ট্যুরিজম হলো ঝড়ের কাছে যারা পরাজিত বিপর্যস্ত, যাদের জনজীবন ঝড়ের দাপটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। যাঁরা একটু খাদ্য, জল, বাসস্থান এর জন্য প্রশাসনের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে দ্বিধা করছেন না একটুও শিরদাঁড়া ঝুঁকিয়ে। তাদের এই শুকনো মুখ দেখতে একদল মানুষ ছুটে যাচ্ছেন ঝড় এর মাঝে। দামী গাড়ি চালিয়ে হাসি মুখে। তাদের মুখে চোখে উজ্জ্বল হাসি। কারণ একটাই তারা এই তাদের সব পাওয়া জীবনে একটু এমন করেই হারিয়ে যেতে চান এই ঝড়ের মাঝেই। শুধু তাদের ওই ঠিকানা রেখে যাবেন বলেই।
ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা -
অভিজিৎ বসু।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক ও দেবরাজ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন