বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গাকে মনে আছে? ‘অপু বলিল, কি ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে, না দিদি? তাহাদের মা বলিল, তাহাদের জ্যেঠামশায়ের ভিটার পিছনে ছাতিম গাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র নৈশবায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাতে বেনুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালার ডালে পাতায় চিকচিক করছে।’
হ্যাঁ, এই ছাতিমের গন্ধেই এখন চারিদিক ম ম করছে গোটা শান্তিনিকেতন। সন্ধ্যাবেলায় পূর্বপল্লীর মাঠ, গুরুপল্লীর ফাঁকা রাস্তা, রতনপল্লী আর সেই ছাতিম তলার অঙ্গনে এখন শুধুই ছাতিম গাছের মাথা ভরে থোকায় থোকায় ফুটে আছে হালকা সবুজ সাদা রঙের অসংখ্য ছাতিম ফুল। যে ফুলের সুবাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় হেমন্তের কথা। এই ঋতু যে খুব ক্ষণস্থায়ী।
আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও খুব প্রিয় ফুল ছিল এই ছাতিম। এই শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে তাই ছাতিমের পাতা উপহার দেবার খুব চল ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি, সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি। সত্যিই কবির এই লাইন এই অনুভূতি, এই মাটির কাছে থাকার কথা আর ছাতিম তলার সেই সুবাস এখন গোটা শান্তিনিকেতন জুড়েই। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনে এখন হেমন্তেও আর শিশির পড়েনা পাতায় পাতায়। পথের পাঁচালীর বর্ণনামতো শিশিরাদ্র ছাতিমের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না আর চারিদিকে।
সত্যিই প্রকৃতির কি এক অদ্ভুত খেলা! রাতে যে ফুলের এত গন্ধ, সকালেই তা কি করে কর্পূরের মতো উবে যায় কে জানে! আবার নিশি শেষে বাসি ফুল থেকে ভেসে আসে তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ, সে গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করে। সেদিন সন্ধ্যায় পূর্বপল্লীর মেলা মাঠ ধরে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে মনে হলো সত্যিই প্রকৃতির এই রূপ রস গন্ধ গায়ে মেখে বেঁচে থাকার কি অদ্ভুত যে আনন্দ সেটা আর অনুভব করা হলো কই আমার পুরোপুরি।
কদম ফুল যেমন বর্ষার দূত, ছাতিম তেমন হেমন্তের। ছাতিমের মাতাল করা গন্ধ মনে করিয়ে দেয় দুয়ারে এসেছে হৈমন্তিকা। এই রুক্ষ হেমন্তের যতটুকু পেলবতা, তা যেন ছাতিমেরই দান। নরম রোদের স্বল্পায়ু বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসছে এই কবির বড়ো প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতনে। আর রাত নামতেই ছড়িয়ে পড়ছে ছাতিমের মাতাল করা গন্ধ চারিদিকে।
আর তাই এই ছাতিম ফুল যেনো হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরৎকে যেমন বর্ষারই প্রলম্বিত অংশ বলা হয়, হেমন্তও তেমন শীতের যেনো পূর্বরাগ। কিন্তু এই বদলে যাওয়া শহরে, ধূলিধুসর মাখামাখি হয়ে ছুটে চলা শহরে আর ছাতিম এর সুবাস কোথায় মেলে। কোথায় আর শীতের আগে হেমন্তের ছোঁয়া মেলে এই ছুটে চলা জীবনে। আকাশ ঢেকে যাওয়া এই নগরে হেমন্তের দেখা পাওয়া যে বড়ই ভার। তাই এখন প্রকৃতি আর তার আপন বৈশিষ্ট্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাই সম্ভবত চুপিসারে আসা এই ঋতুকে এখানে অনেকটা চেনা যায় শরৎ শেষে ময়লা হতে থাকা সীমিত আকাশ, বিকেলের নরম রোদ, ছোট হয়ে আসা দিন আর ছাতিমের তীব্র সৌরভে। যে সৌরভ এখন গোটা শান্তিনিকেতন জুড়েই।
তাই সন্ধ্যার পর পথ চলতে চলতে হঠাৎ নাকে এসে লাগা বুনো সৌরভের ঝাপটা জানান দেয় এই তরু ও তার ফুলের অস্তিত্ব। মনে করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া হেমন্তের কথা। মনে পড়ে যায় সেই বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক'-এ পাওয়া লাইন, 'কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল। গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত... চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধনঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ আছে তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই। এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস।... ছাতিম ফুলের সুবাস আরও ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে... ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোপায় গুঁজিল।'
না, কোথায় আর সেই ভানুমতী আজ। যে ছাতিম ফুলের থোকা মাথায় দিয়ে হেঁটে যায় আপনমনে ওই পথ ধরে সন্ধ্যাবেলায়। বৃক্ষহীন এই শহরে কোথায় আর সেই গাছের দেখা মেলে। কোথায় আর সেই গুচ্ছ গুচ্ছ হালকা ঘিয়ে রঙের ফুলের সুবাসে মাতাল করা পথ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় এক শীতের সকালে।
তাই ছাতিম ছাড়া হেমন্ত-সন্ধ্যার বিবরণ যেমন পূর্ণাঙ্গ হয় না। ছাতিমের গন্ধ যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ। তাই রুক্ষ হেমন্তের যতটুকু পেলবতা, তা যেন ছাতিমেরই দান। যতই আমাদের আশপাশ থেকে উড়ে যাক
ছাতিমের সেই মাতাল করা গন্ধ। যে গাছের ফুলকে ঘিরে থেকে সাত সাতটি পাতা সেই সপ্তপর্না গাছ আমাদের সবার কাছে বেঁচে থাকে ঠিক ওই হেমন্তের সন্ধ্যার মতই।
হেমন্তের ছোঁয়া মেখে ছাতিম ফুলের সুবাসে মনকেমন -
অভিজিৎ বসু।
একুশে অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে গুগল ও ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন