কালী পূজোর রাতে হঠাৎ সাদা জীবনের কালো কথা লিখতে ইচ্ছা হলো আমার। হ্যাঁ, এই ইচ্ছা বড়ো বেদম বস্তু। আর সেটা যদি হয় এই লেখার ইচ্ছা। সেটাকে চেপে বা আটকে রাখা খুব মুসকিল। ঠিক যেনো ওই বসন্ত কালে প্রেম ভালোবাসা আর পত্র বিনিময়ের ইচ্ছার মত। যে ইচ্ছাকে বুকের মাঝে চেপে রাখা বেশ কঠিন কাজ। কার কথা কখন যে মনে পড়ে যায় এই নিশি রাতে আর রাত বিরেতে কে জানে। সেই তিথি আর পঞ্জিকা মেনে বুকের ভেতর টনটন করে ওঠে ঠিক ওই পাকা ফোড়ার মতই।
যাকগে যাঁর জন্য আজ আমি কলম ধরলাম তার কথা পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয় আমার একদম। বাংলা মিডিয়াতে সব থেকে কঠিন ঘূর্ণি পিচে যে একমাত্র খেলোয়াড় যে ধরে ধরে খেলে টেল এন্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে যার সুখ্যাতি অর্জন করেছে সে ইতিমধ্যেই বাংলা মিডিয়াতে। হয়তো গ্রিনিজ বুকে নামও উঠে যেতো তার ওই কপিবুক স্টাইলে ব্যাটিং এর জন্য অমন ঝোড়ো বোলিং এর সামনে। কিন্তু আচমকা একটা গুগলি বলে যে ও ক্লিন বোল্ড আউট হবে সে নিজেও বোধহয় ভাবতে পারেনি কিছুতেই। কি আর করা যাবে কিন্তু তার মধ্যে ও নিজের কারিশমাতে যে ব্যাটিং করেছে, সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে কিন্তু।
হ্যাঁ, সে আর কেউ নয় আমার অভিন্ন হৃদয় বহু পুরোনো সেই ইটিভির বন্ধু শুভ্রনীল ঘোষ। ওর সেই বহু পুরোনো অফিস এর হাসি মুখের ছবি দেখে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন। আসলে ওকে সবাই ওর এই চেহারার জন্য জায়ান্ট আর গর্জিলা বলেই ডাকে। সে ইটিভির সবার কাছেই ও বেশিরভাগ এই নামেই পরিচিত। শুভ্র নামের থেকে এই নাম ওকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করেছিল ইটিভির তিন নম্বর চৌরঙ্গী স্কোয়ার এর অফিসে। নানা মজার কাহিনী গল্প ছড়িয়ে আছে সেই তিন নম্বর চৌরঙ্গী বাড়ীর আনাচে কানাচেতে। সে সব আজ ধুলো পড়া স্মৃতির বক্সে বন্দী হয়ে গেছে অনেক আগেই।
যা হয়ত আজ অনেক পুরোনো আর ক্লিশে হয়ে গেছে তবু আমাদের কাছে সেই সব গল্প স্মৃতি আজও আমাদের কেমন করে জড়িয়ে আছে যেনো এই রাত দুপুরেও। ওর সেই গামছা পড়ে নিউজ রুমে চলে আসা। সেই নিয়ে কত হাসাহাসি হওয়া। ওর সেই বাড়ী থেকে মুড়ি এনে মুড়ি খাওয়া দাওয়া করা আর আসর বসানো অফিস এর টেবিল এর মাঝে। সেটা ইটিভির ও পরে চব্বিশ ঘণ্টার দু জায়গায় এই মুড়ি খাওয়া নিয়ে কত যে মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। সেই রাতের ওর ডিউটি করা। এমন হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। আমি তখন হুগলী জেলার রিপোর্টার ও তখন কলকাতার রাজপথে ঘুরছে। তার আগে ওর সানন্দা কাগজে কলকাতা শহরে কাজ করার অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই হয়েছে বেশ কিছু দিন।
ওর চেহারা যেমন ওকে এডভান্টেজ দেয় সব জায়গায় কিন্তু আমাদের সেটা দেয়না। যাকগে এসব বলে কি হবে ভগবান এর সব বিচার কি সবার সাথে সমান হয়। হুগলীর গুড়াপের ছেলে শুভ্রনীল। চাষ বাস করা অভিজ্ঞতা অনেক ওর। ওর বাবা স্কুল মাস্টার। বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবারে বড়ো হওয়া ওর। তবু মাস্টারি চাকরি না করে ও কেনো যে ওর বাবাকে অনুসরণ না করে এই মিডিয়ার কাজ করতে শুরু করলো সেটা জানি না আমি। ওর বাবার যা পরিচিতি ছিল তাতে ওদের গ্রামে যা শ্রদ্ধা ও ভক্তি ও সম্মান পেতেন তিনি নিদেনপক্ষে প্রাইমারী স্কুলের টিচার হয়ে যেতে পারত ও আরামেই। আর আমাদের থেকে ও পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিল। কিন্তু সেটা না করে ও সাংবাদিক হয়ে গেলো।
আমার মনে আছে তখন সেই আকবর আলি খোন্দকার এম পি বা সাংসদ শ্রীরামপুরের তৃণমুল দলের। শুভ্র একদিন বললো, অভিজিৎ তুই আকবর কে বলে কিছু কাজ ধর। ও তোকে খুব ভালবাসে। এনজিওর কাজ বাকিটা আমি আর দিব্যেন্দু দেখে নেবো। তুই শুধু কাজটা ধরে নে। তারপর আর আমি সেই বিষয়ে উৎসাহ বিশেষ দেখাইনি। ও আর কিছু বলেনি। গোড়া থেকেই ওর ব্যবসার বুদ্ধি বেশ প্রবল ছিল। যেটা আমার কোনো কালেই ছিল না। যাক গে সব মানুষ তো আর সমান হয়না এই দুনিয়ায়।
ইটিভির জীবন শেষ করে শুভ্র এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে তারা নিউজ হয়ে প্রয়াত অঞ্জন বন্দোপাধ্যায় এর হাত ধরে চব্বিশ ঘণ্টায় চলে এলো। এক দম বাংলা মিডিয়ার সেরা লোকদের সমাহারে তৈরি এই চ্যানেলে। যে চ্যানেলের স্বর্ণযুগে সে হাজির ছিল সেই পোদ্দার কোর্টের অফিসে। পরে অনির্বাণ চৌধূরীর রৌপ্য যুগেও ও ছিল পোদ্দার কোর্ট আর মিডিয়া সিটি তে। পরে দুই দাদার যুগ এর শেষে দিদির যুগেও ছিল ও চব্বিশ ঘণ্টায়। যেখানে আমরা সবাই কেউ এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে খেলে, কেউ স্ট্যাম্প আউট হয়ে, কেউ ঘূর্ণি বল বুঝতে না পেরে সবাই আউট হয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে এসেছি হাসি মুখে, কান্না বুকে চেপে, বিরস বদনে, কিম্বা এলোপাথাড়ি বাউন্সার বল সামলাতে না পেরে। কিন্তু শুভ্র বেশ ধরে বুঝে সুন্দর ব্যাট করে বুঝিয়ে দিয়েছে ও ভালো জাতের ব্যাটসম্যান এই কঠিন মাঠে।
আমার আজও মনে পড়ে যায় তখন চব্বিশ ঘণ্টায় দাদার রৌপ্য যুগ সবে শেষ হয়েছে। অফিস তখন ঝড়ের কবলে পরা নৌকার মতো মাঝ গঙ্গায় জলের ওপর দুলছে। সবাই প্রাণভয়ে দৌড়াতে শুরু করেছি নৌকার এই মাথা থেকে ওই মাথায়। আর সেই সময় প্রতিদিন অফিস পৌঁছলেই ও জিজ্ঞাসা করতো কি রে কবে ঝাঁপ মারবি এই দোদুল্যমান নৌকা থেকে। অফিস ঢুকে ব্যাগ রাখার আগেই এটাই ওর একমাত্র জানতে চায় ও বারবার। আমি বলতাম আরে চিন্তা কি তোর, আমি দিয়ে দেবো ঝাঁপ যে কোনো দিন। যা আমি কোনো কাজ ছাড়ার আগেই ভাবিনি কখনো আমার পরিবার, সংসার সব কিছুর কথা এই জীবনে। না হলে কি আর কেউ তাড়িয়ে দেবার আগেই কেউ বোল্ড আউট করে দেবার আগেই এমন করে টোটো চালাবো বলে কেউ ব্যাগ নিয়ে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে মাঠ ছেড়ে আপনমনে।
ও বলতো এইতো আর কিছুদিন তারপর তিথি ধরে সময় ধরে জ্যোতিষ এর নিয়ম মেনে কথা শুনে আমিও ঝাঁপ দেবো। ভাবতাম সত্যিই সেটা করবে ও নিজেও। কিন্তু না আমরা অনেকে কাজ ছেড়ে দুলে দুলে ওঠা নৌকা থেকে কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায় ঝাঁপ মারলেও। শুভ্রনীল কিন্তু বহাল তবিয়তে থেকে গেলো সেই শুভক্ষণ আর তিথির অপেক্ষা করে অনেক দিন অনেক গুলো বছর বেশ হাসি মুখে। যাক গে সেটা তো ওর ব্যাপার। কিন্তু একদিন যখন বালি স্টেশনে আমার সাথে দেখা হলো ওর তখন মনে হলো ওকে ডাকার পরেও কেমন যেন দৌড়ে অন্য কামরায় উঠে পড়লো ও। বোধহয় সেই তিথি তখনও আসেনি বলে এই ভাবে এভয়েড করলো আমায়। একটু খারাপ লাগলো সেদিন আমার। এতোদিন, এত বছরের পুরনো সম্পর্ক আজ শুধু চাকরি করা আর না করার মাঝে লুকিয়ে রইলো। বাড়ী ফিরলাম একটু মন খারাপ নিয়ে। সেদিন মনে হলো স্বার্থ রক্ষা হলো আসল কথা বন্ধুত্বের সম্পর্কের থেকে।
মনে পড়ল সেই দুজন মিলে একসাথে করোনার সময় অফিস যেতাম আমরা। সেই দক্ষিণেশ্বর মন্দির পার হতাম মা কে প্রনাম জানিয়ে। কোনোদিন এয়ারপোর্ট হয়ে আবার কোনোদিন হাওড়া হয়ে সেক্টর ফাইভ যেতাম আমরা ওর দরকার মতো। ওর কত ব্যক্তিগত কাজে বাড়ি ফেরার সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে এয়ারপোর্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি আমরা। কতদিন ও সোমাকে নিয়ে অফিস পৌঁছে দিয়েছে। সেই শুভ্র বালি স্টেশনে চিনতে পারলো না আমায়। না কি এটা আমার ভাবার ভুল। হয়তো চব্বিশ ঘণ্টার জেলার বিল আমি করতাম বলে কিছুটা হলেও রাগ ছিল ওর আমার ওপর তার জন্য এমন এড়িয়ে চলে গেলো হয়তো। কি আর করা যাবে সব কি আর নিয়ম মেনে চলে এই জীবনে।
মনে পড়ল ওর বাবাকে নিয়ে শ্রীরামপুরে চোখের ডাক্তার সৌরভ সান্যাল কে দেখাতে নিয়ে আসার কথা। সেই উমা মিষ্টান্ন ভান্ডার এ আমরা সবাই কচুরি খেলাম তিনজনে মিলে। ওর বাবা বলল বৌমাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি যেও তুমি কিন্তু বাবা। ওর বউ একদিন এলো মার্কেট করতে শ্রীরামপুরে বললাম চল বাড়িতে এল না বললো পড়ে আসবে।একদিন ওর বউ এর ফোন এলো শুভ্র অসুস্থ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এম্বুলেন্স লাগবে উত্তরপাড়ার পুরপ্রধান দিলীপ যাদব কে বললাম। ওর বউ এর উদ্বিগ্ন মুখ কি হবে। আমি চব্বিশ ঘণ্টার সবাইকে জানালাম এই খবর শুভ্র হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওকে দেখতে গেলো অফিস এর অনেকে। প্রতিদিন খবর নিতাম ওর বউ এর কাছ থেকে আমি।
ফিরে এলো ও হাসপাতাল থেকে। ধীরে ধীরে অফিস যাওয়া শুরু করলো আবার সেই সেক্টর ফাইভ এর অফিসে। বেশ ভালো লাগলো যখন খবর পেলাম ও একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছে ধীরে ধীরে। ও আবার সেই পুরোনো চেনা মাঠে খেলতে নামছে জেনে ভালো লাগলো আমার। আর এইভাবেই চলতে থাকলো আমাদের জীবন। হঠাৎ একদিন শুনলাম আমি যে
ডিপেনডেবল নির্ভর যোগ্য ব্যাটসম্যান সেই রাহুল দ্রাবিড় বোল্ড হয়ে গেল দুম করে। না, ফোন করতে পারিনি আমি সেদিন ওকে।
পরে একদিন কথা হলো ওর সঙ্গে। দেখা হলো উত্তরপাড়ায় দিলীপ যাদবের চা এর ঠেকে আড্ডায়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক সাংবাদিকতা পড়াতে যায় ও এখন শুনি। ফোন করলেই বলে না রে, কোনো খবর নেই আমার কাছে। হয়তো মনে মনে কষ্ট পায় ও লাস্ট ওভারের গুগলি বলটা দেখে বুঝতে পারেনি বলে। ওর নিজের কনফিডেন্স এর ওপর হয়তো কিছুটা রাগ আর অভিমান হয় ওর। তাই ইদানিং একটু কেমন যেনো থমকে গেছে চুপ করে গেছে ও।
আমার ইচ্ছা হয় বলি কি দরকার ছিল তোর জোর করে ক্রিজে ব্যাট করার। তিথি নক্ষত্র দেখে ছেড়ে দিলেই এই কষ্টটা আজ আর পেতে হত না তোকে এই সময়ে লাস্ট ওভারে ব্যাট করতে এসে। কিন্তু না এত দিনের সম্পর্কেও কেমন একটা জড়তা এসে গেছে আজ আমার। তাই সেই ত্রিশ বছরের বন্ধু হলেও সেটা আর বলতে পারিনি আমি কিছুতেই। মনে মনে বলি সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিজে নিজেই আপন ভাবেই। আর সেই সম্পর্কের বন্ধন এর মাঝে ফাঁক জন্মে যায় কিছু ঘটনা আর সেই ঘটনার অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে। তবু সেই পুরোনো স্মৃতি আর সম্পর্কের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে আমার এই এলোমেলো এলেবেলে জীবনে কিছু কথা লিখে ফেললাম আজ।
শুধু সেই কাগজ পেতে মুড়ি খাবার দুপুর, সেই ইলিশ মাছ নকিব না কিরণ কার কাছ থেকে অফিস এনে সবাইকে বিক্রি করার হৈ হুল্লোড় করা দুপুর, সেই নারকেল এনে মুড়ি দিয়ে মেখে খাবার দুপুর, সেই জেলার রিপোর্টারদের তোর কাছে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকার স্মৃতি, সেই তোর ব্রেকিং জয়ন্তর পাশে বসে বানান ঠিক করে দিয়ে দ্রুত ব্রেকিং লেখার সেই কি বোর্ডের খট খট আওয়াজ। সকালের শিফট শেষ হলে সেই নিচে প্রদীপ দার চায়ের দোকানে গিয়ে তিন্নির সাথে চা খেতে খেতে গল্প করার দৃশ্য, এমন নানা টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে আসছে আমার মনে এই রাত দুপুরে। যাকে আমিও তোর মত ভুলতে চাই কিন্তু পারিনা কিছুতেই। সেই বাংলা মিডিয়ার এই নানা যুগের কথা কি ভোলা যায় রে।
আমাদের শুভ্রনীল - অভিজিৎ বসু।
পয়লা নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন