পূজোর ভীড়ে আনাচে কানাচেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন কত নাম না জানা গল্প যে লুকিয়ে থাকে তার কোনো শেষ নেই। আসলে আমার এই ব্লগে সেই গল্পের লোকদের খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করা। আর একটু তাদের কোনোভাবে সন্ধান পেলেই কেমন করে যেন জমিয়ে ফেলা তার সাথে আলাপ করে কথা বলে। তারপর তার সাথে আলাপ করে নানা কথা জানার চেষ্টা করা। এটা একটা বদ নেশা বলতে পারেন আমার।
জানি এই নেশাকে নিয়েই যারা এখন মিডিয়া পেশায় আছেন তারা কেউ কেউ হেসে বলেন দুর মালটা পাগল হয়ে গেছে। আবার কেউ সামনে এক রকম কথা বলেন আর পেছনে পাশ ফিরলেই বলে ঠিক হয়েছে দেখ কেমন লাগে এখন তোর। কি অবস্থা হয়েছে মালটার দেখ, শিরদাঁড়া সোজা করে চলবে মালটা। দেখ কেমন লাগে এখন। টোটো চালকের কথা বলে, রাস্তায় ঘুরে, কঙ্কালীতলার হাটে বসে থাকতে হচ্ছে মিডিয়া ছেড়ে মালটাকে। খুব রেলা ছিল যে সব ভেঙে গেছে এখন। আরও অবস্থা খারাপ হয়ে মরবে মালটা ,মরতে হবে এই ভাবেই ওকে। জানি আমি কারা সামনে হাসেন আর পেছনে এই কথা বলেন। তবু আমি তাদের সাথে হেসে কথা বলি সব জেনেও। এটাই যে নেশা জীবনকে দেখার নেশা।
শ্রীরামপুরে কুমিরজলা রোডের রাস্তার ধারে ওকে দেখেছিলাম আমি। রাস্তার ফুটপাতে বসে আছে ও। দু চোখে ঘুম জড়ানো চোখ। ওর মুখে একটা অদ্ভুত শিশুর অবাক করা মায়া জড়ানো মিষ্টি হাসি লেগে আছে যেনো সব সময়। ওকে দেখে বেশ ভালই লাগলো। শ্রীরামপুরে দিলীপ স্মৃতি সংঘের পূজোর সামনে রাস্তায় বসে শান্তিনিকেতন এর ব্লাউস বিক্রি করছে। বাবার সাথে এসেছে পুজোর চারটে দিন একটু বিক্রি হবে বলে। ওকে দেখে ওর কথা শুনবো বলে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।
রাত বারোটার সময় ওর দু চোখে ঘুম আর ঠাকুর দেখতে বের হওয়া দর্শনার্থীদের কাছে পরখ করে দেখে নেওয়া। কম দামে যদি কিছু পাওয়া যায় জিনিস। শুধু ওই নয়, ব্লাউজ এর পাশে ব্যাগ, শাড়ি, কুর্তি জামা নিয়েও বসে পড়েছে অনেকেই। সবাই বোলপুরের বাসিন্দা। পূজোর চারদিন হাট বন্ধ। সোনাঝুড়িতে কোনো ব্যবসা হবে না আর তাই ওদের শহরে চলে আসা। একটু টাকা ইনকাম করার আশায়।
বাবার হাত ধরে শৈশব ছেড়ে হঠাৎ কেমন বড়ো হয়ে যাওয়া মুলুক এর ওই ক্লাস সিক্স এ পড়া শিশুও শহরের ফুটপাথে বসে আছে। নামটা জিজ্ঞাসা করিনি আর। কতদিন আগে যে কবি লিখেছিলেন এমন দৃশ্য অবলোকন করে। সত্যিই অসাধারণ এই জীবনের নানা রঙের উজ্জ্বল ছোপ ছোপ ছবি। যে ছবি জুড়ে থাকে নানা গভীর গোপন কাহিনী। যে শিশুর জীবনে পূজোর গন্ধ মানে হলো রাস্তায় বসে বেচাকেনা করা।
বাবার সাথে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতে ওর চলে আসা শহরে। আমরা বোলপুর থাকি বলে জেনে কি মিষ্টি হাসি ওর। দু চোখে কেমন মায়ার দৃষ্টি। ওর ফোন নম্বর দিয়ে বলা হাটে এসো তোমরা দেখা হবে আবার। যেমন জিনিস বলবে বানিয়ে দেবো আমি। একদম পাকা ব্যবসাদার এর মতই পাকা কথা বলে নজর কাড়লো ওই ছোটো ছেলেটা সপ্তমীর রাতে। দেখলাম একাই ব্যবসা সামলে ওই ক্লাস সিক্সে পড়া শিশু কেমন ছাতা হয়ে উঠেছে ওই ছোট্ট ছেলেটি বাবার কাছে। মাঝে মাঝেই ওর বাবা ওকে রেখে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। ও দিব্যি একা একা ব্লাউজ বিক্রি করছে হাসি মুখে কোনো দুঃখ কষ্ট না পেয়েই।
আমি ওকে বিশ্বাস করুন মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। ওই রাতের বেলায় কেমন ঘুম জড়ানো চোখে চেষ্টা করছে ও জেগে থেকে জিনিস বিক্রি করে লাভ করে ঘরে ফেরার। ওর মার মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দ দেবার। কারণ দশ হাজার টাকা দিতে হয়েছে যে রাস্তার ধারে বসার জন্য এই শহরের পূজোর মণ্ডপ আর নেতাকে। এর বদলে মিলেছে শুধু একটা ছোট থাকার জায়গা। বাকি সব খরচ ওদের নিজেদের। আর সেই টাকা যদি ওদের জিনিস বিক্রি হয়ে লাভ না হয় তাহলে যে ক্ষতি হয়ে যাবে তাদের। ঘরে ফিরবে কি নিয়ে।
এই উৎসবের মাঝে এমন ছোটো শিশুর উৎসবের মাঝে মিশে যাওয়া, এমন করেই উৎসবকে আঁকড়ে ধরা দেখে মনে মনে ওকে কুর্ণিশ জানালাম আমি। যাকে দেখে মনে হলো আমার, ওর এই জীবন দর্শন চিনিয়ে দিলো আমায় যে এইভাবেই যে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয়। না হেরে, যে যাই বলুক হাসি মুখে সবকিছু শুনে জবাব দিতে হয়। যে জীবনের শিক্ষা আমায় দিয়ে গেলো ওই সুদূর বোলপুরের মুলুক থেকে আসা ওই ছোটো শিশুটি। যার দুচোখের ঘুম জড়ানো স্বপ্ন দেখা দেখে আমারও মনে হলো ক্ষতি কি এই বুড়ো বয়সে যদি ওর মতো না পারলেও যদি একটু স্বপ্ন দেখতে পারি আবার নতুন করে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তাহলে কি ভালো যে হতো।
শৈশব হারিয়ে স্বপ্ন দেখা শিশু - অভিজিৎ বসু।
বারো অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি অভিজিৎ বসু।
চারদিকে বিপুল খাওয়াদাওয়া, আলো ঝলমল প্যান্ডেল আর বেশ আছি উৎসবের সময়ে এই ছেলেটার বসে থাকাটা মন খারাপ করে দিচ্ছে।এত আলোর নীচে কতটা অন্ধকার মেখে ও বসে আছে তা পরিমাপ করার ক্যলকুলেটরই আমাদের হাতে নেই। বড় মন কেমন করে লেখা।
উত্তরমুছুন