এই পূজোর ভীড়ে কিছু হারিয়ে যাওয়া ছবির খোঁজ পেলাম আমি বহুদিন পর। সপ্তমীর সন্ধ্যায় খুঁজে পেলাম সেই নানা ছবির টুকরো টুকরো মুখ। ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স ঘেঁটে ফিরে পেলাম ফেলে আসা অতীত দিনের নানা টুকরো টুকরো ছবি। সাদা কালো অক্ষরে কিছু লেখা আঁকিবুঁকি কথা। যে সাদা কালো ছবি জীবনের জলছবিতে অমলিন হয়ে মিশে গিয়ে আজও বেঁচে আছে কেমন করে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে তাঁরা একে অপরের দিকে নিষ্পলক চোখে ওই বাক্সের ভেতর। কেমন যেনো মায়া জড়ানো দৃষ্টি তার।
যে ছবি, ছবির মানুষজন কেউ আজ অনেক দূরে হারিয়ে গেছেন বহুদিন আগেই, বহু বছর আগেই। তাদের সব প্রিয়জনদের ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে দূরে, অনেক দূরে চলে গেছেন তিনি বহুদিন আগেই। কিন্তু তাঁর সেই ছবি আজও পড়ে আছে ওই বাক্সবন্দী হয়ে কতদিন ধরে। পড়ে আছে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, কিছু ফেলে আসা দিনের দিনলিপি, একটা গোটা আস্ত ঘর, দুয়ার, দরজা, জানলা, সেই চেনা সব জিনিস পত্র। সেই দুই মেয়ের শৈশবের কিছু সাদা কালো মিষ্টি হাসি মুখের ছবি। সেই তাঁর অতি প্রিয় সংসার সব কিছুই যে আজ ওই বন্ধ ঘরবন্দী হয়ে গেছে। যে মিষ্টি ছবির মুখ আজ অনেক বদলে গেছে এতদিন পড়ে।
আসলে এটাই বোধ হয় জীবন। মায়াময় জীবনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার যে কি সুখ। আর সেই মায়ার বন্ধন কাটিয়ে হঠাৎ অচিন দেশে চলে যাওয়ার যে কি দুঃখ সেটা যে বোঝা মুশকিল। এই জীবন আর মৃত্যুর মাঝে রয়ে যায় কিছু স্মৃতি, কিছু সুখ, কিছু দুঃখ,কিছু কথা, কিছু হাসি আর কিছু কান্না। যাকে আঁকড়ে ধরেই চলে গোটা একটা জীবন। একটা সংসার। একটা পরিবার। যাকগে আজ বহুদিন পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম অঙ্কিত এর আমার শাশুড়ির আর দুই মেয়ের ফ্ল্যাটে। বন্ধ এই ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝেই আমি দেখতে যাই কেমন আছে সে একা একা।
একদিন কতই না জমজমাট ছিল এই ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাট। কত মানুষের আনাগোনা ছিল এখানে। কত হিসাব নিকাশ। কত মান অভিমান। কত সুন্দর করে মেয়েদের ঘর সাজিয়ে দিয়ে বিয়ে দেওয়া। কত হাসি, কান্না সব যে এই দু কামরার ঘরে কেমন যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আজ একা একাই। তারপর সব কেমন দ্রুত বদলে গেলো যে। পড়ে রইলো ঘর, যাকে কেন্দ্র করে এত আয়োজন সেও কেমন টুক করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো হাসি মুখে। পড়ে রইলো এদিক ওদিক দেওয়াল জুড়ে তাঁর হাতের কাজ এর স্মৃতি। যা দেখে বড়ো মেয়ের স্বগতোক্তি এই সব বাবার হাতে তৈরি। বেশ সুন্দর এই স্মৃতিচারণ কত কিছুই যে মনে করিয়ে দিলো আমায়।
সেই বুড়ো বয়সে অবসর এর পরে বড়ো মেয়ের বাড়িতে খাবার এর টিফিন কৌট করে খাবার পৌঁছে দেওয়া দুপুর বেলায়। সেই নাতনিকে স্কুল থেকে ছুটি হলে নিয়ে আসা। দুপুরে বাজার এনে এক কাপ চা খেতে চেয়ে বউ এর কাছে নানা কথা শোনা। সেই পুরী ভ্রমণের বৃষ্টি ভেজা স্মৃতি, সেই কষ্ট করে ছোটো মেয়ের কাছে দুর্গাপুর যাবার স্মৃতি, এমন হাজার হাজার সব স্মৃতির পাতায় যে ভর্তি এই বন্ধ ঘর। সেই ঘরের মধ্যে ভীড় করে আছে নানা ছবি। যে ছবি তোলার মানুষটাই আর নেই আজ।
তবুও তাঁর একটা সাদা কালো ছবি। দুই মেয়ের সেই কবেকার কম বয়সের ছবি। সেই কত বছর আগের লেখা সেই ইস্পাত ইস্কুলের হেড স্যার এর সই করা ছবির পেছনে একটা নীল সাদা কালির আঁচড়। এই সব কিছুই যে একসাথে পাওয়া গেলো আজ এক বাক্সের ভেতর। যে বাক্স রহস্য উদঘাটন করা হয়তো হবে না কোনোদিনই। কিন্তু এই সাদা কালো ছবির জগতে রয়ে যাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের নানা কথা, গল্প আর গভীর আবেগ আর ভালবাসা। যে ভালোবাসার টুকরো টুকরো স্মৃতি চিহ্ন ছড়িয়ে আছে বন্ধ ফ্ল্যাটের এদিক ওদিক।
সাদা কালো ওই ছবির মাঝে আমরা তিনজন মিলে রঙিন ছবি তুলে ধরে রাখলাম নিজেদের এই বন্ধ ফ্ল্যাটের ঘরে বসে। বাইরে প্রবল জনস্রোত। সপ্তমীর সন্ধ্যায় জন জোয়ারে ভাসছে গোটা শহর। আর আমরা তিনজন বন্ধ ঘরে বসে সাদা কালো ছবির মাঝে মুঠোফোনে রঙিন ছবি তুলে ধরে রাখলাম। সাদা কলোর জগৎ ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া ওই মানুষটাকে বার বার মনে করলাম। আর বর্তমানের রঙিন ছবি তুলে মিশিয়ে দিলাম সাদা কালোর সঙ্গে।
তারপর সব কিছুকে আবার সেই অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে পুড়ে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে এলাম আমরা। মিশে গেলাম জনারণ্যে ভীড়ের মাঝে। পড়ে রইলো সেই সাদা কালো ছবি, বন্ধ ঘর, সেই ইস্পাত ইস্কুলের হেড স্যার এর নীল কালীতে সই করা কাগজ। পড়ে রইলো সেই শুভ্রা ,সেই সোমা, রূপা, গোপাল, অভিজিৎ, তিন্নি, বাবু আরও কত কিছুই যে পড়ে রইলো।
সাদা কালো ছবির মাঝে রঙিন ছবি- অভিজিৎ বসু।
এগারো অক্টোবর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন