সারা বছরের প্রতিটা দিন হলো একটা দিবস পালনের জন্য বিখ্যাত। যেমন ভালোবাসার দিন। গোলাপ দেওয়ার দিন। আলিঙ্গনের দিন। এমন নানা দিনের সমারোহে একদম অন্য একটা দিন। যে দিনটা শুধুই একমাত্র তাদের জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু সেই মানুষদের কথা কে আর আমরা মনে রাখি। হ্যাঁ, সাত সকালে ভোরবেলায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষাকে উপেক্ষা করে যে আমার ঘরের জানলা টপকে বা দরজায় সকালের খবরের কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে যায় আজ সেই আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র বাহক দিবস।
সত্যিই সেই কবে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি আট অক্টোবর এই দিবস পালনের শুরু হয়। প্রথম এই সংবাদপত্রের বাহক যিনি ছিলেন সেই তার নাম হলো বার্নি ফ্ল্যাহার্টি। যিনি 1833 সালে দ্য নিউ ইয়র্ক সান এর প্রকাশক বেঞ্জামিন ডের কাছ থেকে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র দশ বছর বয়সে। সেই তাঁর পথ চলা শুরু সংবাদ বাহক হিসেবে। এই হলো সংবাদপত্রের বাহকের পেশার সূচনার কথা। এত গেলো ইতিহাসের কথা।
যাদের নিয়ে একটা গোটা দিন তেমন একটা দুটো মানুষের কথা আজ আমি লিখতে চাই আমার সাদা জীবনের এই কালো কথায়। সত্যিই এই দিনে মনে পরে গেলো আমার সেই বহুদিন আগে শ্রীরামপুরে কাগজ দেওয়া মানিকদার কথা। যিনি আমার বড়ো মামার বন্ধু ছিলেন। মানিকদা কাগজ দিতেন সেই ইটিভির বড়তলার অফিসে। সকাল হলেই সেই পুরোনো উঁচু সাইকেল চেপে দু ব্যাগ ভর্তি কাগজ নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে বেড়াতেন এই বাড়ী থেকে ওই বাড়ি। যেনো ঠিক টাইম ম্যানেজমেন্ট এর পরীক্ষায় পাশ করা যায় তাকে।
যাঁরা সকালে কাগজ দেখে চা খেতে বসেন তাদের এক দুমিনিট দেরি হলেই কৈফিয়ত কি হলো মানিক তোমার বোধহয় বয়স হচ্ছে আর পারছ না। মানিক দা একগাল হেসে বলতেন, না না ওই একটু ট্রেন লেট করেছে তাই আসতে দেরি হলো আমার। এই ভাবেই সারা মাস হাসি মুখে কাগজ দিয়ে মাসের শেষে বিল নিয়ে হাজির হতো মনিকদা। দাম মিটিয়ে বলতাম এক কাপ চা খেয়ে যান মানিকদা। হাসি মুখে বলতো অসুবিধা হবে না তো তোমাদের কোনও। বসে চা খেতেন, কত পুরোনো দিনের গল্প করতেন। সেই নিউগেট ক্লাবের গল্প। যেখানে আমার বড়ো মামা আমি যদিও বড়দা বলতাম সেই দুজনে মিলে কত জিমন্যাস্ট করতেন সেই গল্প শুনতাম আমি। আমার মামার বাড়ির সবাইকে চিনতেন মানিকদা। আর তারপর বলতেন আজ চলি বলে চলে যেতেন।
দাদা বৌদির সংসারে থাকতেন। বিয়ে করলেন না কোনোদিন। সারাটা জীবন একাই কাটিয়ে দিলেন মানিক দা। ইটিভির অফিস বন্ধ হলো একদিন। তারপরও আমার শ্রীরামপুরে ফ্ল্যাটে কাগজ দিতেন মানিকদা। দড়ি বেঁধে ব্যাগ ফেলে দেওয়া তিন তোলা থেকে রাস্তায়। সাড়ে সাতটা বাজলে মানিকদার বেল দেওয়া। তারপর কাগজ পৌঁছে দেওয়া। এটাই ছিল সেই সংবাদপত্র বাহক মানিকদার গল্প। বহুদিন আর কথা হয়নি আমার মানিক দার সঙ্গে। খবর নেওয়া হয় নি তাঁর। রাস্তায় আগে দেখতে পেতাম বহুদিন হলো দেখতে পাইনি আমি। আর আমরা এখন সবাই শ্রীরামপুর ছেড়ে বোলপুরের বাসিন্দা। কোথায় যে হারিয়ে গেলো ম্যানিকদা কে জানে। আজকের দিনে মনে পড়ে গেলো মনিকদার কথা।
বোলপুরে মেয়ের পড়ার জন্য যেখানে আমি ঘর ভাড়া নিলাম সেই রতনপল্লীর যে বাড়িতে আমি ভাড়া থাকতে শুরু করলাম সেই বাড়িতেই কাগজ দিত সেই ছোটু। বোলপুর শহর থেকে অনেক দূর বাহিরি গ্রামের বাসিন্দা এই ছোটু। ক্লাস ফোর এ পড়ে তাঁর মেয়ে। সকাল হলেই একঘণ্টার বেশি সাইকেল চালিয়ে বোলপুর স্টেশন পৌঁছে যাওয়া অন্ধকার থাকতে থাকতেই। তারপর সেই ভোরের ট্রেনে কাগজ এসে পৌঁছালে কাগজ নিয়ে ছুটে চলা একবার রতনপল্লী, তারপর পূর্বপল্লী সেখান থেকে সোনাঝুরির হাট পার করে কোনো রিসোর্টে এই সাত সকালে খবরের কাগজ পৌঁছে দেওয়া। এইভাবেই দিন কাটে তাঁর। কিন্তু পেট ভরে না যে।
আর তাই মেয়ের পড়া যাতে বন্ধ না হয় সংসার এর চাকা যাতে বন্ধ না হয় তাই একটা কারখানায় রাত অবধি কাজ করা শুরু করলো ছোটু। কিন্তু না সেই কাজ বেশিদিন করা গেলো না। এখন আবার শুনলাম একটি দোকানে কাজ করেন তিনি। সেই ভোর বেলায় বেরিয়ে কাগজ দিয়ে মুদি দোকানে কাজ করা দুটোর পর দোকান বন্ধ হলে বাড়ী ফেরা সেই একঘন্টা পথ সাইকেল করে। খেয়েদেয়ে আবার সন্ধায় এসে দোকান খোলা। সত্যিই বলছি এই হলো আমাদের সেই সংবাদপত্র বাহক ছোটুর জীবন।
যে জীবনে শুধু দৌড় আর দৌড়। অনিশ্চিত জীবনে ভেসে চলা এদিক থেকে ওদিক আর দৌড়ে যাওয়া। ভাবলেও কেমন লাগে আমার। কথা হয় ওর মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে মন দিয়ে পড়ছে ওর বাবার জন্য। তাকে যে বড়ো হতে হবে অনেক। আর খবর এর কাগজ বয়ে নিয়ে যাওয়া সেই আমাদের বোলপুরের ছোটু ছুটে চলেছে দৌড়ে চলেছে মেয়ের জন্য সেই ভোর বেলা থেকে রাত পর্যন্ত।
সত্যিই আজ এদের জন্য একটা গোটা দিবস পালন। সারা বিশ্ব জুড়ে যে দিন পালন করছেন অনেকেই। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সেই মানিক দা, সেই দৌড়ে বেড়ানো ছোটু কি জানে আজকের দিনটা শুধু মাত্র তাদের জন্যই,কে জানে। হয়তো জানা নেই ওদের কারুর। আর কি হবেই বা জেনে। খবরের কাগজের ভর্তি ব্যাগ নিয়ে দৌড় তো আর বন্ধ করা যাবে না কিছুতেই। ছোটুদের যে জীবনভর সারাটা জীবন এইভাবে দৌড়ে বেড়াতেই হবে।
ছোটু ও মানিকদার গল্প - অভিজিৎ বসু।
আর অক্টোবর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন