সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই সুদূর গোবর ডাঙ্গা থেকে ট্রেন ধরে ঠিক ঘড়ির সময় মেপে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে সকাল সকাল একদম সবাইকে হারিয়ে দিয়ে সময়ের আগেই অফিসে চলে আসা। তারপর ফাঁকা মাঠে কপি বুক স্টাইলে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এর মত ব্যাট করা একদম ধরে ধরে যাতে কোনো ভাবেই মাঠে খেলতে নেমে সে নিজে কোনো ভাবে আউট না হয়ে যায় মাঠে। তার সাথে খেলতে নামা অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যান আউট হলেও ক্ষতি নেই তার কোনো। দল অল ডাউন হলেও সে নিজে যেনো নট আউট থেকে মাঠ ছাড়তে পারে মাথা উঁচু করে। এটাই তার আসল কথা জীবনের।
আর তারপর বেলা বাড়লে অফিসে ভীড় বাড়লে নিজের বাড়ি থেকে সেই গোল টিফিন কৌটো করে আনা ভাত খেয়ে মুখে পান চিবিয়ে স্লগ ওভারে হালকা চালে ব্যাট করে বিকেল বিকেল মাঠ ছেড়ে সেই ভীড় ট্রেন ধরে ঘরে ফেরা। তার সেই চেনা কালো ব্যাগ ঝুলিয়ে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে আর নিরাপদে। হ্যাঁ, আমাদের সেই কবে কার কোন আমলের খেলোয়ার সেটা বোধ হয় বলতে পারবো না আমি আজ। কিন্তু ওর সাথে আমার বহুদিনের পরিচয়। হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত বাংলা মিডিয়ার সুবীর চক্রবর্তী।
সকালের চ্যানেলে টিআরপি আনতে আর অফিস এর বাবুদের একটু রিলিফ দিতে যে হাসিমুখে সিদ্ধহস্ত। সেই সুদূর কোন দূরের গ্রামের জায়গায় থেকেও কেমন সবাইকে হারিয়ে দিয়ে অনায়াসে হাসতে হাসতে অফিস ঢুকে পাশের সহকর্মীকে বলতে পারে আমি কিন্তু সাতটার আগেই বা আটটার আগেই অফিস ঢুকে গেছি ভাই। যা শুনে অফিসের ছোটো, বড়ো, মেজো, সেজো এমনকি অফিসের সেই বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকা কাজ শিখতে আসা ইন্টার্ন রাও কেমন অবাক চোখে আর মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর তখন তার মুখে মিষ্টি মধুর একটা গর্বের হাসি। যে হাসির মধ্যে যে কত কিছুই লুকিয়ে থাকে কে জানে।
বহুদিন দেখা হয়নি আমার সুবীর এর সঙ্গে। কথা হয়নি আমার সাথে ওর। হবার কথাও নয়। টোটো চালকের সাথে আর কার কি দরকার থাকতে পারে এখন। আমার এখন আর এডিটর এর ঘরে অনায়াস প্রবেশ এর সুযোগ নেই। আমার এখন ডেপুটি এডিটর এর সাথে হাসতে হাসতে কথা বলা নেই কোনো খবর নিয়ে। অতএব কি দরকার তার সাথে আর মোবাইল ফোনে কি খবর লিখে, বৃথা সেই ছিপ ফেলার ফাতনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার। কি উত্তর আসে এই আশায়। সত্যিই কত বিচিত্র যে এই মানুষের বন্ধন আর জীবন আর জীবনের সম্পর্ক কে জানে। যাকগে আজ বহুদিন পরে আমার এই সাদা জীবনের কালো কথা লিখতে বসে রাতদুপুরে ওর কথা মনে পড়ে গেলো যে।
কবে যে সুবীর এর সাথে আমার আলাপ হয় সেটা মনে আসছে না আর। সেই ওভারল্যান্ড কাগজ না রাজপথ এর অফিস কে জানে। বহু পুরোনো দিনের সাংবাদিক সুবীর। বসদের খুব কাছের লোক আর আস্থার লোক আর বিশ্বাসের আর ভরসার লোক। একদম নির্দিষ্ট আজ্ঞাবহ একজন ভালো কর্মী। আমার মত অন্তত বেয়াদপ কর্মী নয় ও। তাই একদম সেই ওর বলা এবিপি আনন্দ চ্যানেলের বিখ্যাত সেই ওয়ার্কশপ করার সময় টো এর ওপর ভর করে সুবীর হাসতে হাসতে নিশ্চিন্তে নিরাপদে আর নির্ভয়ে বিভিন্ন বিখ্যাত চ্যানেলে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিলো এই দীর্ঘ শত্রুহীন বন্ধুহীন ওর এই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবন।
কিছু স্মৃতি ভেসে আসে আজ আমার। সেই হায়দরাবাদ বেড়াতে যাওয়া আমার। সেই বুধবার দুপুরে ওর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ওর ভাগ্যলতায় জটাশঙ্করের বাড়িতে খেতে আসা। অনেকক্ষণ গল্প করা দুপুরবেলায় দুজন মিলে। তারপর ওর কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসা সিদ্ধার্থ সরকার কে ধরে করে। সেই কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রীট এর অফিসে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে আসা প্রতিদিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে গাড়ি করে। জেলা থেকে কলকাতায় আমাকে আনার জন্য চেষ্টা করা ওর। এমন অনেক কথাই মনে পড়ে যায় আজ এই রাতের বেলায়। তারপর সেই ওর মির্জা গালিব স্ট্রীট এর অফিসে শেষ দিন শুকনো মুখে কারুর সাথে কথা না বলে অফিস করা। সন্ধ্যায় ব্যাগ ঝুলিয়ে গোবরডাঙ্গা ফিরে যাওয়া।
সবাই জেনে গেছিলো ও মহুয়া চ্যানেলে বড়ো পদে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাক হয়ে কাটিয়ে পরদিন ইটিভি বাংলা ছেড়ে চলে গেলো ও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। এই গুণ আছে বলেই আজ সুবীর এত নিরাপদে নির্বিঘ্নে কাজ করে গেলো বিভিন্ন মিডিয়াতে। আমি ভেবে ছিলাম হয়তো আমায় বলবে অভিজিৎ বসু, তুমি কি আসবে নাকি এই আমার চ্যানেলে। না, সুবীর সেটা বলে নি আমায় কোনোদিনই। এই চব্বিশ ঘন্টা অফিসে যেদিন বেলা এগারোটায় জী গ্রুপের চেয়ারম্যান ড সুভাষ চন্দ্র কলকাতা অফিসে পৌঁছে গেলেন সেদিন কি সুন্দর একাই হাসি মুখে সেই ফাঁকা মাঠে হাসতে হাসতে সামলে দিল সে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে।
আমি তখন বিপদে আছি সুবীর তখন ভালো অবস্থায় আছে 24 ঘন্টা চ্যানেলে। বসদের বেশ কাছের লোক। কিন্তু ভাবলাম হয়তো বলবে অভিজিৎ বসু দেখি আমি বলে তোমার কথা যদি কিছু কনসিডার হয়। তোমার জন্য যদি কিছু করা যায়। না, সুবীর এর কাছে সেটা আর আমার পাওয়া হয়ে ওঠেনি এই জীবনে। অথচ ওর সাথে আলাপ আমার প্রায় পঁচিশ বছরের বেশি সময় হবে বোধ হয়। যাই হোক এসব নিয়ে কোনো দুঃখ, আক্ষেপ বা কষ্ট নেই আমার কোনোও। মনে এলো তাই লিখে দিলাম আমি এই সাদা জীবনের কালো কথায়।
কিন্তু তারপর পোদ্দার কোর্টের অফিসে অনির্বাণ চৌধুরীর আমায় ডেকে রাস্তা থেকে চাকরি দেওয়া। সুবীর এর নিউজ রুমে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরা। এই বুড়ো তুমি আমার কত পুরোনো বন্ধু বল সেটা তুমি সবাইকে। সেসব কথা আজ এই গভীর রাতে মনে পড়ে যায় আমার। সেই যে কিছুদিন আগে কলকাতা সেক্টর ফাইভ থেকে ব্যাংক এর লোন এর কাজ সেরে উল্টোডাঙ্গা ফেরার সময় সেই চেনা বাস স্টপেজ থেকে ওর হঠাৎ বাসে উঠে পড়া। আমি জায়গা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে ওর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উল্টোডাঙ্গা যাওয়া।
আসলে কাজের সূত্রে যোগাযোগ আর সম্পর্ক যে দীর্ঘস্থায়ী হয় না কিছুতেই। শুধুই সেই সম্পর্ক টিকে থাকে কিছু অফিস এর ভর কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করে। আর সেই ভর কেন্দ্রের গতি কোনদিকে অফিস এর হাওয়া কোনদিকে সেটা বেশ ভালো করেই বোঝার ক্ষমতা ছিল এই ছোট্ট খাটো অ্যাক্রিডেশন কার্ড ওলা সাংবাদিক এর। যদিও পরে সেই কার্ড আর ওর রিনিউ করা হয়নি বহুদিন। জানিনা এখন সেটা হয়েছে কি না। যদিও সে ছোটো নয়, অনেক বড় অনেক ব্যাপারে সে দীর্ঘদেহী, অন্য যে কোনো মানুষের থেকে সাংবাদিকের থেকে। যাক গে, যার যেটা গুণ সেটা তো মানতেই হবে একবাক্যে।
সেই ইটিভি নিউজ বাংলা, চব্বিশ ঘন্টা, এবিপি আনন্দ, মহুয়া বাংলা, টিভি নাইন যে কোনো বাংলা চ্যানেল বাংলায় এলেই সুবীর এর চাকরি বাঁধা। যেটা দেখে আমি বেশ গর্ব অনুভব করি ওর এই কন্টাক্ট দেখে। আজ এত দিন পর মনে পড়ে গেলো সেই সব কথা। সেই ওর পোদ্দার কোর্টের রাস্তায় ফুটপাথে পান এর দোকানে পান খেতে যাওয়া দুপুর বেলায়। আমি আর শৌনক এর সেই এক দোকানে পান খেতে যাওয়া হেঁটে চেনা ফুটপাথ ধরে দুপুর বেলায়। তারপর ফেরার পথে এডিটর অনির্বাণ চৌধুরীদার জন্য পান নিয়ে এসে এডিটর ঘরে ঢুকে সেটা হাসিমুখে দেওয়া। ওর মুখে তখন মিটি মিটি হাসি।
বিকেল চারটে বেজে গেছে তখন আর একটু সময় কেটে গেলেই ব্যাগ হাতে সুবীর এর নিউজ রুম এর মঞ্চ থেকে প্রস্থান করা সেই ব্যাগ হাতে নিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে সেই নাটকের মঞ্চের বিবেকের মতো। সে যা ঘটনা ঘটে যাক এই খবরের জগতে। তার কোনো মাথাব্যথা আর হেলদোল নেই কোনো মতেই। এই হলো আমাদের সবার প্রিয় কম কথা বলা, একজন খুব কাছ থেকে দেখা এই সাংবাদিক যার নাম সুবীর চক্রবর্তী। চব্বিশ ঘন্টা চাকরি ছেড়ে ওর টিভি নাইন চ্যানেলে চলে যাওয়া , আর আমার চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে আসা টোটো চালাবো বলে। তারপরেও তো কি খবর বলে মাঝে মাঝেই রাতে মেসেজ দিয়ে কথা বলতো আমার সঙ্গে। আর তখন আমিও বলতাম টোটো চালিয়ে দাদা এই দিব্যি আছি। কারুর পা ধরে বেঁচে নেই।
এই ভাবেই ধীরে ধীরে আমিও হারিয়ে গেলাম বাংলা মিডিয়া থেকে। সুবীর ও আর কি খবর লিখে বহুদিন ফাতনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকে না। বলে না দুর তুমি খবর না বললে বলো না কিছুটা ছদ্ম বা কপট রাগ দেখিয়ে। হ্যাঁ, আজ ওর সেই পুরোনো দিনের কথা স্মৃতির উত্তাপ মাখা কিছু কথা মনে পড়ে গেলো আমার। আর তাই আমি আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে আমার সাদা জীবনের কালো কথায় লিখে ফেললাম। আমি আমার বহু পুরোনো দিনের বন্ধু সেই সুবীর চক্রবর্তীর কথা যে হয়তো কোনোদিন আর অবসর নিতে পারবে না এই তার সাংবাদিক জীবন থেকে । হয়তো এই সাদা জীবনের কালো কথা কারুর পছন্দ হবে আর কারুর হবে না। কিন্তু আমার এই লেখা তো কাউকে খুশি করতে নয়। কারুর কাছে পয়েন্ট তোলার জন্যও নয়। আমার কথা আমার নিজেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভবের কথা।
সুবীর কথা - অভিজিৎ বসু।
দু হাজার চব্বিশ, পনেরো অক্টোবর।
ছবি - সৌজন্য মোবাইল ফোন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন