আজ হলো ঝর্না কলমের দিন। যে ঝর্না কলমের খোঁচায় কালিতে লেখা নাম, আর কিছু আঁকাবাঁকা অক্ষর কারুর বুকের হৃদয়ে ছুরি মেরেছে বারবার। আবার সেই প্রেমের টানে এই ঝর্না কলমের খোঁচায় জেগে উঠেছে গভীর গোপন ভালোবাসার চিনচিনে নানা কথা ও তার প্রেম ও বিরহ। প্রেমের দিবস আজ নয় বটে। কিন্তু প্রেমের দিবস না হলেও প্রেমের মিষ্টি মধুর চিঠি লিখতে যে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করা হয় সেই ফাউন্টেন পেন দিবস আজ। দু হাজার বারো সাল থেকে এই দিবস পালন করা হয়। এই দিবস পালন করা হয় যাতে এই দিন পালনের মধ্যে দিয়ে লেখার আনন্দের পাশাপাশি মার্জিত সরঞ্জাম দিয়ে লেখার সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।
প্রথম দিকে প্রাচীন আমলে মিশরীয় সভ্যতা ও গ্রীক সভ্যতায় ব্যবহার করা হতো খাগড়ার কলম। এরপর মধ্যযুগে পাখির পালক দিয়ে তৈরি কুইল দিয়ে লেখা হতো। প্রথম পরিচিত ফাউন্টেন পেন 1702 সালে জার্মান উদ্ভাবক জোহান সেবাস্তিয়ান বাথ দ্বারা তৈরী হয় কিন্তু এটা তেমন জনপ্রিয় হয়নি ও গৃহীত হয়নি।
পরে 1809 সালে বার্থোলোমিউ একটি ফাউন্টেন পেন এর পেটেন্ট তৈরি করেন। কিন্তু এতে বার বার কালির জন্য একটি জলাধার ছিল ঘন ঘন রিফিল করতে হতো। 19 শতকের শেষের দিকে ফাউন্টেন কলম শিল্প ব্যাপক উৎপাদনের কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে।
ওয়াটারম্যান 1884 সালে প্রতিষ্ঠা হয় ও পড়ে 1888 সালে পার্কার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বেশ নির্ভর যোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের কলম তৈরি করে। 1884 সালে লুইস ওয়াটারম্যান প্রথম ব্যবহারিক ফাউন্টেন পেনের পেটেন্ট করেছিলেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে পাখির পালক দিয়ে তৈরি কুইল পেন ব্যবহারের প্রায় হাজার বছর পরে এই ফাউন্টেন পেনের নকশা এসেছে। ভারতে প্রথম পরিচিত ফাউন্টেন পেন তৈরি করেন ড: রাধিকানাথ সাহা। তিনি 1910 সালে এই ফাউন্টেন পেন তৈরির জন্য একটি পেটেন্ট পান। 1932 সালে রাজামুন্দ্রীর বাসিন্দা কেভি রত্নম মহাত্মা গান্ধীর মেড ইন ইন্ডিয়া পণ্যের আহ্বান শুনে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। একটি ফাউন্টেন পেন তৈরি করেন যা তিনি রত্মম পেনস নামে মহাত্মা গান্ধীকে 1935 সালে উপহার দেন। পরে 1930 থেকে 1934 সালের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে উত্তাল। কালি সেই সময় আমদানি করা হতো। ভারতে কোনো কালি নির্মাতা ছিল না। 1934 সালে রাজশাহীতে বর্তমানে বাংলাদেশে সুলেখা ওয়ার্কাস এর প্রতিষ্ঠা হয়। সেই শুরু করলো সুলেখা কালির যাত্রা।
নানা ধরনের ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতেন সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ চন্দ্র বসু, মোরারজি দেশাই, কাজী নজরুল ইসলাম, বিধান চন্দ্র রায়, এবং রাজেন্দ্র প্রসাদের মত কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা ব্যবহার করতেন ইবোনাইট ফাউন্টেন পেন। 1931 সালে মুম্বইতে ঘোড়া কালির ব্যবহার দেখা যায়। পরে এই ঘোড়া কালি উট এ পরিবর্তন করা হয়। মুম্বইতে একটি কলমের যন্ত্রাংশ তৈরির ইউনিট তৈরি হয় 1941 সালে। সেই সময় সীতা ও সিটি নিবের পরিবর্তে উইলশন নিব পাঠানো হয় একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পরে 1940 সালে উইলসন পেনসের জন্ম হয়। তারা দেশিওভাবে ফাউন্টেন পেন তৈরি শুরু করে ভারতে।
এইভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়েছে এই ফাউন্টেন পেনের ইতিহাস। ভেনাস পেন, মুম্বাই ফাউন্টেন পেন আরও নানা কোম্পানি পেন তৈরি করে। এমনকি জানা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি রেনেসাঁর সময়ে একটি কার্যকরী ফাউন্টেন পেন তৈরি করেন তিনি। এবং সেটি তিনি বাবহারও করেন বলে জানা যায়। যদিও আজকাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ফাউন্টেন পেন। বল পেনের যুগে ফাউন্টেন পেন কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কিছু দিন আগেও তো এই ঝর্না কলমের বাজার এত খারাপ ছিল না। এখন এই ইউজ এন্ড থ্রো এর যুগে ঝর্না কলম কি একদম হারিয়ে গেলো।
যে কলম আমাদের শৈশবের সঙ্গী ছিল। হাতের লেখা ভালো হবে বলে ছোটো বেলায় ধরিয়ে দেওয়া হতো এই ঝর্না কলম কালি ভরে। সেই ফাউন্টেন পেন এর দিবসে তার কথা বড়ো বেশি করে মনে পরে যাচ্ছে। সেই সাদা জামার বুক পকেটে রাখা পেন নিয়ে মাথায় দই এর ফোঁটা দিয়ে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। সেই পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে আসা। পেন এর একটু কালি সাদা জামায় দাগ লেগে যাওয়া। আর সেই ছড়া কেটে বলতে শোনা যেতো হাতে কালি মুখে কালি ছেলে আমার ঘরে এলি।
তারপর ধীরে ধীরে ছোটকাল কাটিয়ে বড় হওয়া। সেই ঝর্না কলমের ডগায় নানা গভীর গোপন ভালোবাসার কথা মুক্তোর মত লিখে সেটা ভালোবাসার জনকে লুকিয়ে তার হাতে দেওয়া। সেই স্মৃতি আজও আমাদের বুকে বেঁচে আছে এই ফাউন্টেন পেন এর দিবসে। নভেম্বর মাসের প্রথম শুক্রবার তাই এই ঝর্না কলমের দিন এমন নানা কথাই মনে পড়ে গেলো। যে গভীর গোপন কথা একদিন আড়ালে আবডালে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতাম। সেই আলোকের ঝর্না ধারায় আজ সেই ঝর্না কলম অনেকটাই দূরে সরে গেছে আমাদের জীবন থেকে। কিন্তু তার ইতিহাস তার সেই পুরোনো দিনের নানা স্মৃতি আজও জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে।
ঝর্না কলমের দিন - অভিজিৎ বসু।
পয়লা নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন