শনিবারের রাত আর রবিবারের সকাল আমার কাছে তার আর কোন ফারাক নেই। সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠেও কোনো তাড়া নেই আমার কোথাও যাওয়ার। সপ্তাহের সাতটা দিন এর বিশেষ কোনো তাৎপর্যই নেই আর আমার এই গতিহীন জীবনে। রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে যেমন বাজার যাওয়ার তাড়া থাকতো সেটাও আজকাল আর নেই। কেমন যেনো একটা নিথর আর নিরস দিন যাপন করা। সরসতা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিছুটা পরের মুখাপেক্ষি হয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। জীবনের এই আপাত শান্ত ,নিরীহ ও নির্মোহ জীবন যাপনের হ্যাপা খুব একটা নেই বিশেষ। যা হয়, যেমন হয় একটা কাটিয়ে দিলেই হয় আর কি। এটাই এই জীবনের একমাত্র ভরসা।
এই যে এত দৌড়ে বেড়ানো, ছুটে বেড়ানো জীবনের মোরাম পথ ধরে যে পথের চারপাশে কত মানুষ জনের ভীড় ছিল একসময়। বাজারে গেলেই দেখা হতো সেই কালো মুক্তোর মত হাসি হেসে আর ওর ভরাট বুকের মাঝে কাপড় টেনে যে বলতো, কি গো আজ যে বড়ো দেরী করে এলে তুমি। আর একটু হলেই আমার দেখা পেতে না তুমি। আমি ব্যাগ নিয়ে রাস্তার ধারে ওর মুখের এই কথা শুনেই কেমন যেনো অবাক হতাম। সত্যিই তো ওর জন্য যে এতদূর থেকে এসে ওর কাছে একটু সবজি কেনা সেতো ওকে দেখবো বলেই।
সত্যিই তো ও কি করে জানলো যে আমি ওর টানেই কেমন ছুটে আসি এই কটা কচি ঢেঁড়স নিতে। নিজের হাতে ঝুড়ি থেকে বেছে নিতে নিতে বলে আগের সপ্তাহে কত বেলা করে বাড়ি গেলাম আমি কিন্তু তুমি তো এলেই না গো। কি যে বলি ওকে আমি। এই বলেই ওর সেই কালো চোখের দীঘল দৃষ্টি আমার মুখে সজোরে ঘা মারে। গ্রাম থেকে আসা ওই বউ এর কথা শুনতে বেশ মজা লাগে আমার। স্বামীর শরীর ভালো নেই। তাই গ্রাম থেকে ভ্যান রিক্সা করে ভোরবেলায় ক্ষেতের কচি ঢেঁড়স তুলে বাজারে বসা। তারপর বেচাকেনা শেষ হলে আবার ঘরে ফিরে যাওয়া স্বামীর কাছে। এই শুকসারির ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। শহুরে জীবনের উত্তেজনা নেই।
আজ রবিবার সকালে উঠে ঘুম ভেঙে মনে হলো সেই কালো দীঘল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করা মহিলার কথা। কে জানে ওকি আর অপেক্ষা করে আমার জন্য কে জানে। হয়তো করে না আর। বুঝে গেছে রবিবারের বদলে অন্য কোনোদিন সস্তার বাজার কিনতে আমি বাজারে যাই হয়তো আজকাল। জীবন বোধহয় এমনই অপেক্ষার পালা অবসান হতে বেশি দেরী করেনা আর কেউই। কতদিন ভেবেছি আমি ওর নামটা জিজ্ঞাসা করবো। ঘরে আর কে কে আছে জিজ্ঞাসা করব ওকে। না, সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি আমার কোনোদিন। হয়তো আমায় উত্তর দেওয়ার আগে ওর চোখের দৃষ্টিতে ফালাফালা করে দিত আমার শুকনো হৃদয়। আর আমি সেই ফালাফালা হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরতাম একবুক টাটকা সবুজ ভালোবাসা নিয়ে।
সকাল থেকেই কেমন হিম হিম ভাব। জানলার শার্শীতে হিমের পরশ আর হালকা শীতের কাপড় জড়ানো রবিবারের আলসেমির সকাল। যে সকালে কোনো উত্তেজনা নেই, হুড়োহুড়ি নেই, কোনো ভাবেই হুঁশিয়ারি নেই। একদম একটা পরিকল্পনাহীন, অগোছালো পংক্তিমালা নিয়ে গড়ে ওঠা এক মাদ্যামারা সকাল। যে সকাল নিয়ে আমার একসময় কত স্মৃতি ছিল। যে সকালে জানলার ধারে আর ভীড় করছে না কেউই। সাদা কবুতর, ঘোলা চোখের ঘুঘু, আর অন্য পাখির দল কেউই নেই যে তারা।
রবিবারের এই সকাল যে সপ্তাহে একটা দিন ধূমকেতুর মত উদয় হতো। যে সকালটা দৌড়ে বেড়ানোর দিন নয়। শুধুই চুপটি করে অপেক্ষা করে উপভোগের দিন ছিল আমার। কর্মজীবনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর অফিস যাওয়ার জন্য ছুটে বেড়ানো নয়। টাইমে প্রেজেন্ট দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা নয়। শুধুই ছটা দিন এর দৌড়ের আর কাজের পরে একটা অন্যরকম দিন।
তাই এই রবিবার রাতেই বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। হালকা ঠাণ্ডা গায়ে মেখে গলায় মাফলার জড়িয়ে এদিক ওদিক অগোছালো ভাবেই ঘুরে বেড়ালাম আমি। মাথার ওপরে আকাশে তখনও ফুল মুন চাঁদের আলোয় আলোকিত গোটা বোলপুর আর শান্তিনিকেতন শহর। লালদীঘির জলের ওপর চাঁদের টলটলে ছায়া দোল খাচ্ছে। মাথার ওপর বাদুড়ের ডানার ঝটপট শব্দ। তালগাছের ডালে দোল খাচ্ছে গরীব বাবুই এর ছোট্টো কুঁজোর মত উল্টোনো বাসা। কেমন একটা অন্যরকম শিরশিরে অনুভূতি যেনো। রবিবারের সকালের সেই অনুভূতি তো হয়নি আমার এই চাঁদের আলোমাখা সন্ধ্যায়।
আসলে বোধহয় আমরা সবাই ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনা যে কোনটা ঠিক, আর কোনটা ঠিক নয়। কোনটা ভালো আর কোনটা আরও বেশি ভালো। এইসবের ফারাক বুঝে উঠতে পারিনা আমি। তাই যে অনুভূতিহীন, আবেগহীন, দৌড়হীন শীতের কাপড় জড়ানো সকালকে ভালবাসতে পারিনি আমি আজ এই রবিবারের সকালেই। সেই রবিবারের সন্ধ্যায় যে অন্য রূপ।
ঠিক তেমনই এই রবিবারের সকালের বদলে এই চাঁদ মাখা সন্ধ্যা কত অপরূপ। কুয়াশা ঘেরা সকালের বদলে এই সন্ধ্যা যে অন্য রূপে ধরা দিল আমার কাছে। সেই অন্য রূপের সন্ধ্যায় আমি আপনমনে ঘুরে বেড়ালাম একা একদম একা। সেই লালদীঘির ধার, গুরুপল্লীর ফাঁকা রাস্তা, রতনপল্লীর চেনা পথ, সেই মেলা মাঠের নিস্তব্ধ শুনশান নীরবতা মাখা পথ, যে পথের চারপাশে ভীড় করে ছাতিমের বুনো গন্ধ, হাসনুহানার গন্ধ সব মিলেমিশে একাকার। নিস্তব্ধতাকে সঙ্গে নিয়ে, আর চাঁদকে সঙ্গী করে আমি ঘুরে বেড়ালাম একা, একদম একা।
রবিবারের সকাল - অভিজিৎ বসু।
আঠারো নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন