সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই মানবজমিন এর লেখকের কথা। সেই দূরবীন দিয়ে জীবন দেখা মানুষটির কথা। সেই যে মানুষটি আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর বা তার বেশি বছর আগে আমায় একটি চিঠিতে যে জীবনকে দেখার কথা বলেছিলেন। যে জীবন হলো সব থেকে বড় শিক্ষক। সেই জীবন দেখার পাঠ গ্রহণ করেই তো হেঁটে চলেছি আমি আজও। সেই মানুষটির কথা আজ লিখতে বসলাম আমি। কারণ আজ তাঁর শুভ জন্মদিন।
হ্যাঁ, আজ বাঙালি সহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর জন্মদিন। যিনি শিশু ও বড়দের জন্য বহু লেখা লিখেছেন। এই মানবজমিন উপন্যাসের জন্য যিনি উনিশশো অষ্টআশি সালে যিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। ছোটদের জন্য লেখা উপ্যনাসের মধ্যে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোসাঁই-বাগানের ভূত খুব জনপ্রিয় তাঁর লেখা। বাংলাদেশ এর ময়মনসিংহতে তাঁর জন্ম হয় দোসরা নভেম্বর উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে। যাঁর ঝুলিতে এরপর শুধুই পুরষ্কার আর পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। তাঁর লেখার স্বীকৃতির জন্য।
ভারত ভাগের সময় তাঁর বাংলাদেশ ছেড়ে এদেশে চলে আসা। তারপর এই বঙ্গের জলপাইগুড়িতে পড়াশোনা শুরু হয় তাঁর প্রথম ছাত্রজীবন অষ্টম শ্রেণী অবধি। পরে কোচবিহার, আসাম , পাটনা সহ নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে পড়ার জীবন কেটে যায় তাঁর। বাবার রেলের চাকরি সেই সূত্রেই তাঁর ঘুরে বেড়ানো সেই ছোটকাল থেকেই। সেই ঘুরে বেড়ানোর নেশাই তাকে লেখার নেশা ধরালো ধীরে ধীরে জীবনে।
প্রথম জীবনে তাঁর বাংলা শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু
করেন তিনি। পরে ধীরে ধীরে লেখার জগতে প্রবেশ করে চাকরি করেন আনন্দবাজার পত্রিকায় ও দেশ পত্রিকায়। তাঁর লেখা প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় জলতরঙ্গ নামে উনিশশো ঊনষাট সালে। আর তার ঠিক সাতবছর পরে এই দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস বের হয় ঘুণপোকা। আর ছোটদের লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস হলো মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি। এরপর ধীরে ধীরে তিনি শুধুই লিখেই গেছেন নানা জীবনের কথা। যে জীবন তিনি শুধুই দেখে গেছেন সারা জীবন গোটা জীবনভর নিজের জীবন দিয়ে।
আজ থেকে বহু বছর আগে প্রায় ত্রিশ বছর হবে মনে হয় বা তার বেশি। যাদবপুরের একটি ধর্মীয় সংগঠন সৎসঙ্গ সংঘের উদ্যোগে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেলাম আমি। সেই লেখার বিষয় ছিল দেশের সংহতি রক্ষা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে হবে। সেই লেখায় আমার লেখা প্রথম হলো। আর সেই প্রথম পুরষ্কার তুলে দিলেন আমার হাতে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যাদবপুরে।
সেই তাঁর মিষ্টি হাসি। উজ্জ্বল দুটি চোখ। একদম আমার হাতে আমার নাম ডেকে তুলে দিলেন তিনি। মঞ্চে কাছে ডেকে তুলে দিলেন পুরস্কার, একটি মানপত্র, একটি পেন, আর সাদা খামে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট। যেটা আমার কাছে অনেক বড়ো প্রাপ্তি আর কি। ভজন আর আমি এই পুরস্কার আনতে গেছিলাম সেই যাদবপুরের অনুষ্ঠানে আমার আজও মনে আছে সেই কথা। ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়েছিলাম সেদিন আমি। বেশ খুশি খুশি ভাব আমার, একটা কিছু লিখে জীবনে প্রথম টাকা পাওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল যে সেদিন। আমার মনে আছে আজও সেই কথা, মাকে এনে পাঁচশো টাকা দিলাম আমি। মা খুব খুশি ছেলে লিখে টাকা এনেছে বলে। সেই টাকা দিয়ে আমাদের ঘরের একটা সিলিং ফ্যান কিনেছিলেন মা। যেটা আজও সেই টালির ঘরে মাথার ওপর ঘোরে।
অল্প কথা হয়েছিল ওনার সাথে আমার সেই ভীড় মঞ্চে। বললেন খুব ভালো লেখো তুমি। লেখা ছাড়বে না একদম। একে ভালবাসতে হয়। প্রতিদিন কিছু লিখবে। হ্যাঁ, পরদিন আমি সেই যোধপুর পার্কের ওনার বাড়িতে দেখা করতে গেলাম একা একটু ভয়ে ভয়ে। দরজায় বেল দিলাম আমি। সকালে সাদা ফতুয়া পড়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি নিজেই। সবে তিনি স্নান সেরে পূজো করে এসেছেন। আমায় হেসে সোফায় বসতে বললেন। সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর। সেই ঘরের মাঝে কাঠের সুন্দর একটা পার্টিশন দেওয়া। একটু জড়সড় হয়ে সঙ্কোচে বসলাম আমি ওই এত বিশাল মানুষ আর বড়ো ঘরের মাঝে কেমন বেমানান হয়ে।
জল আর মিষ্টি দিলেন খেতে, বললেন প্রসাদ খাও, ঠাকুরের প্রসাদ। এটা ওটা কথা হলো টুকটাক। ঠাকুরের কথা, সেই যাদবপুর সৎসঙ্গ মন্দিরের রতিকান্ত দত্তদার কথা। তারপর সেই মুক্তোর মত হাতের লেখায় একটা সাদা কাগজে সেই সাদা খামে মোড়া চিঠি দিলেন আমায়। বললেন এই নাও এটা নিয়ে যাও। যা দীর্ঘদিন ধরে রেখে দিয়েছিলাম আমি সযত্নে। সেই বিখ্যাত তাঁর লেখা চিঠির লাইন অভিজিৎ, জীবনকে দেখো, জীবনই হলো সব থেকে বড়ো শিক্ষক। যে কথাকে আপ্তবাক্য মেনেই আমি জীবন দেখেই বুড়ো হয়ে গেলাম আমি।
আজ সেই তাঁর লেখা চিঠি কোথায় হারিয়ে গেছে আমি জানিনা। সেই ভাঁজ পরা চিঠি শেষ দেখেছিলাম কেমন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে আমার মায়ের ট্রাঙ্কের ভেতরে। আজ সেটা আর নেই কোথাও। নেই আমার মাও। চিঠির মত আজ আমার মাও হারিয়ে গেছেন কোথায় কে জানে। কিন্তু সেদিন এই লেখার মানে বুঝিনি আমি সেই সময়।
আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বুঝতে পারলাম আমি প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে তিনি কি কথা, কি জীবন দেখার কথা, কি জীবন দর্শনের কথা, জীবন হলো শিক্ষকের মত, আমায় বলে ছিলেন সেদিন। যে জীবন দর্শনের কথা, যে জীবনের থেকে বড়ো শিক্ষক আর নেই সেই কথা বুঝতে পারছি আমি একটু একটু করে ধীরে ধীরে। যে কথা সেদিন বুঝতে পারিনি আমি একদম।
আর তাই আজ এতদিন পর তাঁর জন্মদিনে সেই মানবজমিন এর শ্রষ্টা, সেই মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির লেখক, সেই ঘুণপোকার মত লেখা মানুষকে, জীবন দেখার কারিগরকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাই। জন্মদিনে আমার প্রনাম নেবেন শীর্ষেন্দু দা। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি আপনি সুস্থ নীরোগ হয়ে আরও দীর্ঘ জীবন লাভ করুন। আর এমন জীবন দেখার কথা লিখে যান আপনার কলম দিয়ে। যে জীবন, যে জীবনের দর্শন পেয়ে আমরা ধন্য হই, কৃতার্থ হই।
জীবন দেখা কারিগরকে জন্মদিনে প্রনাম - অভিজিৎ বসু।
দোসরা নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন