ফোনটা ওকে আমি করেছিলাম এমনি। আলটপকা একটা ফোন করা। নিজের খারাপ অভ্যাসের একটা ফোন। যেমন আমি যাকে তাকে আর যখন তখন করে ফেলি ফোন। সময়, সংলাপ না বুঝে কথা বলি অনর্গল। কেউ আমার সাথে কথা বলেন আবার কেউ বিরক্ত হয়ে কথা বলেন না। কিন্তু সেই কথা বলতে গিয়ে এটা কি শুনলাম আমি। মৌসুমী আর পিয়াস এর একটা বহু পুরনো জুটি ভেঙে গেলো আচমকা। কাউকে কোনো নোটিশ না দিয়ে। একা হয়ে গেলো মৌসুমী। একদম একা হয়ে গেলো মেয়েকে নিয়ে। দূরে অনেক দূরে চলে গেলো পিয়াস।
ওপর প্রান্ত থেকে ওর বলা, ওর কথা, ওর গলার স্বর শুনে আমি নিজেও আর কি বলবো ওকে ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু যা বাস্তব আর যা সত্যিই তাকে তো মানতে হয়। শুধু ফোনের এক প্রান্ত থেকে শুনলাম। কত স্মৃতি, কত মধুর সম্পর্ক সব শেষ। আসলে জীবনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে কার পথ ফুরিয়ে যায় হঠাৎ করেই আমরা সেটা জানি না। বুঝতে পারি না আমাদের রাস্তা ফুরিয়ে গেছে সেই কথাটা।
ওদের সাথে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল কলেজে ভর্তির সময় থেকে। স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম আমরা। সেই সময় থেকেই ওদের সাথে আলাপ আমার সত্যিই বলতে কি ওদের দুজনের বাড়ির সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারপর কলেজ জীবন শেষ হলো। ওদের বিয়ে হওয়া, সংসার করা। সব কিছুই এক শহরে থেকে টের পেতাম আমিও। একে অপরের সাথে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওদের দুজনকে দেখলেই ফিরে যেতাম আমরা অতীত স্মৃতি চারণভূমিতে। পূজো মণ্ডপে দেখা হলে পিয়াস বলতো ওই যে দেখো, আবার সাংবাদিক এসে গেছে। কী যে কখন করে দেয় ও কে জানে। খুব সাবধান কিন্তু। আর মৌসুমী এ সব শুনে মিটি মিটি হাসি দিয়ে বলতো ছাড় তো ওর কথা তুই। বল কেমন আছিস তুই।
সেই সুন্দর জুটিটা ভেঙে গেলো শুনে আমি নিজেও একটু ভেঙে পড়লাম আজ। কত কিছুই আমরা জানতে পারি না সময় মতো। কলেজ জীবনের এমন কত জুটির কথা ভুলেই গেছি আমি। কিন্তু মৌসুমী পিয়াস এর জুটির কথা ভুলতে পারিনি আজও। এত সুন্দর একটা মেয়ে মৌসুমী। এত সুন্দর একটা সুদর্শন পুরুষ পিয়াস। ওদের দুজনের সুন্দর মেড for ইচ other জুটি। সেই জুটি ভাঙার খবর পেয়ে আমি আজ নীরব হয়ে গেলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সত্যিই মৃত্যু কি নীরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সামনে চুপ করে ঘাপটি মেরে। আমরা কেউ তো সেটা বুঝতেই পারিনা। অতি সংগোপনে সে আসে একদম চুপিসাড়ে। আমাদের প্রিয়জনকে এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে চলে যায় দূরে, অনেক দূরে।
আমরা শুধু সেই সব প্রিয় মানুষগুলোর কিছু স্মৃতি আর কিছু অতীত ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকি বাকি জীবন। জীবনের রঙ্গ মঞ্চে এই আসা যাওয়ার নাটকটা খুব কঠিন ও জটিল বোঝা দায়। তবু জীবনের এই ঘূর্ণাবর্তে একে মেনে নিতেই হয়। মনে পড়ে গেল একটা দিনের কথা। কলেজ ফেরত সন্ধ্যায় সাইকেল নিয়ে পিয়াস মৌসুমী আমি ফিরছিলাম গঙ্গার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে। আলগোছে ধীর পায়ে ধীর লয়ে হাঁটা। একটু দেরি করে ঘরে ফেরা। সব মিলিয়ে এই ভাবেই জীবন গঙ্গার ঘোলা জলের মতোই ঘুরছিল। কী হবে কি করে ভালোবাসার মানুষকে নিশ্চিত আশ্রয় দেওয়া যাবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকতো পিয়াস। অনেক কষ্ট করে সেই ভালোবাসার মানুষকে নিশ্চিত আশ্রয় দিয়ে ছিল সে। কিন্তু আজ সেই জুটি ভাঙার খবর পেলাম আমি। যা সত্যিই যন্ত্রণার কষ্টের। সত্যিই বলতে কি এই অবস্থা থেকে হয়তো দিন কেটে যায় কিন্তু সেই দিনের কথা সেই গভীর গোপন কথা কি ভোলা যায়। না যায় না। সে কথাই বললো মৌসুমী।
মেয়েকে নিয়ে নতুন লড়াই। মেয়ের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে নতুন লড়াই শুরু। মা মেয়ের এই লড়াই নিশ্চয়ই সফল হবে। এই প্রাথর্না করি আমি। আর কি বলবো শুধু এটা আর কেউ আমায় বলবে না কোনো দিন রাস্তায় দেখা হলেই যে, এই রে সাংবাদিক এসে গেছে কখন কি ফাঁস করে দেয় কে ও জানে। সত্যিই আমি আজ আমার এক ভালো মনের মানুষ অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে হারালাম। যার সাথে জীবনের অনেক স্মৃতি উপচে পড়া দিন কাটিয়েছি। এক রাস্তায় হেঁটেছি, এক কলেজ ক্যাম্পাসে আড্ডা মেরেছি। সেই দিন তো আর ফিরে আসবে না কোনোদিন।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাই মনে হয় আমার, আমরা সবাই খুব বোকা। জীবনের আর মৃত্যুর এই দড়ি টানা- টানিতে আমরা কেউ জানতে পারি না কে জিতবে আর কে হারবে। তবু আমরা অহংকার আঁকড়ে, দম্ভ আর ঔদ্ধত্যকে বুকে চেপে বেঁচে থাকি। যে কোনো মুহুর্তে সব কিছুই বদলে যায়। জীবন আর মৃত্যুর দড়ি টানা টানিতে। মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকিস মৌসুমী। ভালো থাকিস পিয়াস। তোর হাসি মুখটাই আমার কাছে ধরা থাক।
এই লেখা লিখেছিলাম আজ থেকে প্রায় একবছর আগে। আজ মৌসুমী আর ওর মেয়ের ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো সেই একবছর আগের লেখার কথা। সাদা কালো ফ্রেমের মাঝে আটকে থাকা পিয়াস আর মৌসুমীর সেই অমলিন ছবি আমার মনের মণিকোঠায় জ্বল জ্বল করবে চিরকাল। সেই কলেজ সেরে বিকেল বেলায় সিদ্ধেশ্বরী তলায় ওদের বাড়ি যাওয়া। সেই রবিবার দুপুরে সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করা এন ডির মানে নীতিশ বাবুর বাড়ী থেকে জুলজি পড়ে বেরিয়ে মৌসুমীর বাড়ী যাওয়া আর জমাটি আড্ডা মারা সবাই মিলে।
সেই রবিবার দুপুর এর আড্ডা আজও মনে আছে আমার। ওর দুই দাদার মধ্যে মিন্টু দা বেশ কথা বলতেন আমার সাথে। বড়ো দাদা বৌদিও বেশ ভালো মানুষ ছিলেন। একটা যৌথ পরিবারের সুখী সদস্য সব ওরা। ওর বোন থাকতো আমাদের আড্ডায়, বিয়ে হয়নি সেই সময় ওর বোনের। ওর বাবা বসে থাকতেন সেই গলির মুখে রোদ পোহাতেন এই শীতকালে। ওর মা বারান্দায় বসে থাকতেন। পরে কতদিন যে একসাথে শ্রীরামপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে অফিস গেছি আমরা। কত গল্প করেছি সেসব মনে পড়ে যায় আজ।
সত্যিই অসাধারণ সেই সব দিনগুলো আজ হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। হারিয়ে গেছে পিয়াস আর মৌসুমীর জুটির সেই সুন্দর ছবির একজন হঠাৎ করেই , আর একজন একা একাই বেঁচে আছে এই ধূলিধুসর পৃথিবীতে একা, একমাত্র মেয়েকে আঁকড়ে ধরে। সময় বড়ো দ্রুত গতিতে ছুটে চলে। একবছর আগের সেই হঠাৎ করে ফোন করে জেনে অবাক হওয়া পিয়াস আর নেই। তারপর নিজের মনেই লেখা এই স্মৃতিচারণ আজ প্রায় একবছর আগে সেকথা মনে করিয়ে দিলো আমায় আবার।
মৌসুমী মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকিস তুই। মা আর মেয়ের এই জুটি, এই তোদের দুজনের সুন্দর ছবি দেখে আমার খুব ভালো লাগলো আজ ।তোদের দুজনের মা আর মেয়ের এই বন্ধুত্ব, দুজনের গভীর ভালোবাসা বেঁচে থাক তোদের জীবনে অমলিন হয়ে। এমন হাসিমুখেই বেঁচে থাক তুই। ভালো থাক। আনন্দে থাক। আর সুখে থাক। দুর থেকে পিয়াস তোদের দেখে নিশ্চয়ই মনে মনে খুশি হবে।
পিয়াস আর মৌসুমীর জুটি ভাঙার একবছর - অভিজিৎ বসু।
বিশে নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন