আজ এক অন্য জীবনের গল্প। এক ফুটবলের মাঠের স্বপ্ন দেখা লিঙ্কম্যান এর জীবন সংগ্রামের গল্প। সৎ ভাবে জীবনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা এক আদন্ত্য গ্রামের সহজ সরল মানুষের গল্প। হ্যাঁ, ইনি হলেন ইকড়া গ্রামের উত্তম কুমার চ্যাটার্জী। সেই ছোটকাল থেকেই কষ্ট করে দিন যাপন যাঁর। কোনো ভাবে মাধ্যমিক এর গণ্ডি পার করে অবিনাশপুরে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া। আর তার সাথেই ছিল সবুজ মাঠের টানেই পায়ে বল নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো। একসময়ে তিনি খেলতেন জেলাস্তরের ফুটবলেও। কোনো সময় বাঁকুড়া, দুর্গাপুর, বর্ধমান জেলাতে নানা সময়ে খেলতে যেতেন তিনি। বেশ ভালই খেলতেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন কলকাতার মাঠে খেলার।
কিন্তু সব স্বপ্ন কি আর পূরণ হয়। বাড়ির আর্থিক খারাপ অবস্থার কারণেই তাই পড়া বন্ধ হলো একসময় তাঁর। মাঠ ছাড়তে বাধ্য হতে হলো তাকে সেই সময়। কতই বা বয়স তাঁর সেই সময় পনেরো বছর হবে। কিন্তু কি করবেন তিনি। কাজে লেগে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন পরিবারের সদস্যরা। আর সেকথা মেনেই মাঠ ছেড়ে নেমে পড়লেন তিনি রাস্তায়। হ্যাঁ, সেই ভোর বেলায় প্রায় চারটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে চলে আসতেন তিনি নিজের গ্রাম ইকড়া থেকে গড়গড়ি। সেখানে সাইকেল রেখে ভোরের বাস ধরে সিউড়ি পৌঁছে যেতেন তিনি। তারপর খবরের কাগজ সংগ্রহ করে ঘুরে ঘুরে সেই কাগজ বিলির কাজে লেগে পড়লেন উত্তম চ্যাটার্জী।
শীত, গ্রীষ্ম বর্ষা সব সময় এই ভাবেই কাগজ পৌঁছে দিতে দিতে তার জীবনের অনেক গুলো বছর কেটে গেলো। প্রায় তেতাল্লিশ বছর এই ভাবে কাগজ দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি হাসি মুখে। আসলে তাঁর কথায়, দেখুন এই ভাবেই মেয়ের বিয়ে দিলাম সিউড়ি তে। ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে কিন্তু তেমন কোনো কাজ করে না। এই ষাট বছর বয়সেও তো সেই ভোর বেলায় অন্ধকার থাকতে উঠে দৌড়তে হয় কাগজ দিতে। কিন্তু সেটা কতদিন পারবেন তিনি কে জানে। এই চিন্তা করেন আজকাল আর মনে মনে ভাবেন তাহলে সংসার চলবে কি করে।
প্রথম জীবনে তো কাগজ দেবার আগে আমি লোকের বাড়ী রান্নার কাজও করেছি। কিন্তু তারপর 1981 সাল থেকে কাগজের এজেন্সি নিয়ে কাগজ বিক্রি করতেই নেমে পড়লাম রাস্তায়। আর সেই সূত্রেই বহু মানুষের সাথে আলাপ যোগাযোগ হয়েছে তাঁর। উত্তম বাবু জানালেন করোনার সময়ে তিনি সেই ইকড়াগ্রাম থেকে পুরো রাস্তা সাইকেল চালিয়ে সিউড়ি সদরে বাড়ী বাড়ী ঘুরে কাগজ বিলি করে তারপর বাড়ী ফিরতেন তিনি প্রায় বিশ পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা। তবে তাঁর আফশোষ সেই সময় সবাইকে কিছু চাল ডাল খাবার দিয়ে সাহায্য করলেও তাদের কেউ একটু সাহায্য করেনি কোনো দিন। কেউ জিজ্ঞাসা করেনি এই সংবাদপত্র বিক্রেতাদের চলছে কি করে। শুধু ওই ভ্যাক্সিন দেবার সময় একটু সিউড়ি পুরসভা তাদেরকে সাহায্য করে। এটা তাঁর সেই সময় একটু খারাপ লেগেছিল। খবর পৌঁছে দিয়েছে যারা সেই সময় কষ্ট করে বাড়ী বাড়ী সেই সময় কেউ তাদেরকে সাহায্য করা দূরের কথা একবার জিজ্ঞাসা করেনি দিন চলছে কি করে।
আজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর সংবাদপত্র বাহক হিসেবে এটাই তাঁর আফশোষ। কথায় কথায় তিনি জানান দেখুন আমি সেই ওভারল্যান্ড কাগজ বিক্রি করেছি। তবে পুরোনো দিনের সেই সব কাগজ, সেই কাগজে যাঁরা লিখতেন, খবর যে ভাবে প্রকাশ করা হতো সেই সব দিন এখন অনেক বদলে গেছে। এখন কি আর সব খবর ছাপা হয় কাগজে। হয় না, অনেক খবর তো কাটছাঁট করে তারপর ছাপা হয়। আর এটাই বোধহয় বেশ খারাপ লাগে তার এই সংবাদপত্র জগতে প্রায় পঞ্চাশ বছর কাগজ বিলির পরে। এমন করে চলতে থাকলে তিনি জানেন না কী করে চলবে এই তার প্রিয় ভালোবাসার খবরের কাগজ।
দিন দিন তো নিউজ পেপার এর বাজার দ্রুত হারেই কমছে। সব খবর তো এখন বুঝলেন না সবাই মোবাইল ফোনে পেয়ে যাচ্ছে তাহলে আর বাড়িতে কেনো কাগজ কিনবে বলতে পারেন। সত্যিই বেশ বড় সত্যিই কথাই বলে দিলেন তিনি। টিভি আর মোবাইল এর যুগে তো এটাই হচ্ছে আসল কথা। তার প্রমাণ মিলছেও তবু তো তিনি সেই কাগজকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন দিন গুজরান করছেন। আর এর মাঝে খেলাকে ভালোবেসে নিজে উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের ক্লাবকে তৈরি করেন, মাঠ তৈরি করে রেজিস্ট্রি করেন। যখন তিনি ইকড়া পল্লী মঙ্গল সমিতি ক্লাব। আর এই ক্লাবেই চালু হলো একাদশী ফুটবল টুর্নামেন্ট। যে টুর্নামেন্ট হতো দুর্গা পুজোর ঠিক পরেই।
এই পল্লী মঙ্গল সমিতি ক্লাব এর চ্যালেঞ্জ কাপ এর খেলা শুরু হয় আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তাঁর হাত ধরেই। আজও সেই খেলা তাঁর গ্রামের মাঠে হয়ে আসছে। এই বছর এই খেলার এক উদ্যোক্তা শ্রীকান্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন , আমরা গ্রামের সেই পুরোনো দিনের খেলাকে ভালোবেসে আজও সেটাকে চালু রেখেছি। যদিও এই মাঠের রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন অনুযায়ী যা করা দরকার ছিল সেটা হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন। আর এই ইকড়া গ্রামের শিল্ড এর খেলা খেলতে বীরভূমের নানা জায়গা থেকে ভীড় করে নানা ক্লাব এর দল। ষোলো দলের খেলা হয় মাঠে প্রতিবছর একাদশীর দিন। অনেকেই এই খেলায় তাঁদের বাবা মার নামে শিল্ড উৎসর্গ করেন।
আর এই গ্রামের খেলা নিয়ে আর কাগজ বিক্রি করেই হাসি মুখে দিন কাটে ইকড়া গ্রামের উত্তম কুমারের। যে স্বপ্ন দেখে এই ভাবেই যেনো সে আগামী দিনে বেঁচে থাকতে পারে হাসি মুখে খবরের কাগজ বিলি করে। আর সবুজ মাঠের খেলার সাথী হয়ে। এই কঠিন জীবনের দৌড়ে দৌড়তে পারে সেই সবুজ মাঠের লিংক ম্যান এর মতই।
জীবনের সবুজ মাঠে দৌড়ে বেড়ানো এক লিঙ্ক ম্যানের গল্প - অভিজিৎ বসু।
আট নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন