মুখোশ পড়ার নয়। মুখোশ খোলার সগর্ব একটা বিজ্ঞাপন। যিনি মুখোশ খুলবেন তার স্ট্যাটাস কোথায়, আর কি তার জীবনের ব্যপ্তি। কি মাপের মানুষ তিনি সেটাও জানিনা আমি ঠিক। কিন্তু যাঁর মুখোশ খুলবেন সেই মানুষটা হলেন সদ্য পুরষ্কার পাওয়া সেই ডিস্কো ড্যান্সের বিখ্যাত অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। ফেসবুকের দেওয়ালে এই বিজ্ঞাপনটা দেখে একটু খারাপ লাগলো আমার। মুখ আর মুখোসের ভীড়ে কোনো রকমে আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। আর সেইখানে এইভাবে মুখোশ উন্মোচন করার সগর্বের আর দাপুটে হুমকি। ভয়ে মরে যাই আর কি।
আচ্ছা এই ভাবে রাস্তায়, অফিসে কাছারিতে, আদালতে, বিধানসভায়, সংসদে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, ঘরে , বাইরে, যদি সবাই সবার মুখোশ খুলতে শুরু করে দেয় কি অবস্থাটা হবে ভাবুন তো একবার। ছোটো খুলছে বড়োর মুখোশ, মেজো খুলছে সেজোর মুখোশ, বাবা খুলছে ছেলের মুখোশ, জামাই খুলছে শাশুড়ির মুখোশ, এই ফ্ল্যাটের পাল বাবু খুলছেন পাশের ফ্ল্যাটের মিত্র বাড়ির বউয়ের মুখোশ, দশ জনপথ খুলছে ছাপ্পানো ইঞ্চি ছাতির মুখোশ, নন্দীগ্রাম খুলছে কালীঘাট এর মুখোশ, তাহলে যে একেবারে ধুন্ধুমার বেঁধে যাবে কিন্তু। নকল মুখোশ খোলা নয় কিন্তু সেটা কোনো ভাবেই, একেবারে আসল শক্তিপীঠ এর সাধনা করে মুখোশ উন্মোচন করা। যাতে যার মুখোশ খোলা হলো সে আর মুখ দেখাতে না পারে কোনো জায়গায়, মাটিতে ভূপতিত হয়ে যায়। ভুলুণ্ঠিত হয় তার ইমেজ, তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনা, তাঁর কাজ সব কিছুই মাটিতে মিশে যায়।
আসলে এটাই বোধহয় এখন নিয়ম করে হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। একে অপরের মুখোশ খুলে তাকে মাইক টাইসন এর মত পাঞ্চ করে ছিটকে মাটিতে ফেলে দেওয়া। আর তারপর নিজের দুহাত সগর্বে আকাশ পানে তুলে জয়দ্রথ বা ভীষ্মের মত জয়োল্লাস করা। থ্রেট কালচারের মাঝেই প্রকাশ্যে চলে এলো মুখোশ খোলার হুমকির কালচার। বেশ ভালো ব্যাপার কিন্তু। তাই আমিও ভোরবেলায় মনে মনে লিখতে বসে ভাবছি কার কার মুখোশ উন্মোচন করা যায়। তার নামের একটা তালিকা প্রস্তুত করছি মনে মনে। কোন স্তর দিয়ে শুরু করবো ঘর থেকে না অফিস থেকে নাকি একদম সোজা সাপটা বড়ো বড়ো মস্তবড় মাতব্বর দের থেকে ভাবছি।
কিছুদিন আগেই কলাভবনের এই নন্দন মেলায় এমন এক মুখোশ ঘরের সন্ধান মিলেছিল আমার। ভারী সুন্দর ফাঁকা ঘেরা জায়গায় রাখা আছে নানা মাপের, নানা ধরনের, নানা সাজের সব মুখোশ। যে মুখোশ গুলো চুপটি করে দেওয়ালে ঝুলে আছে আর মিটিমিটি হাসি দিয়ে দেখছে আমাদের এই সব নানা ধরনের মুখদের। আর ভাবছে সত্যিই এই মুখ আর মুখোশের আড়ালে কত কিছুই যে ঘটে যায় জীবনের মোরাম রাস্তায় কে জানে।
মেলার ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় এই ফাঁকা স্টলে কোনো বিক্রেতা নেই। এই মুখোশ বিক্রির জন্য নয় কিন্তু। শুধু কেউ কেউ আসছেন দাঁড়িয়ে পড়ছেন আপনমনে আর তারপর যে যার নিজের ইচ্ছামতো মুখোশ খুলে নিয়ে পড়ছেন, ছবি তুলছেন, হাসি মুখে ফের তারা মুখোশ খুলে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে নিজের মুখ নিয়ে মেলার ভীড়ে মিশে যাচ্ছেন।
আমার বেশ ভালো লেগেছিল এই মুখোশের স্টল দেখে। যার যেমন দরকার তেমন মুখোশ বেছে নাও, পরে নাও নিজের মুখে তারপর ঘুরে বেড়াও, ছবি তোলো, আর তারপর ফের মুখোশ খুলে নিজের চিত্রিত বিচিত্র ওই মুখ নিয়ে আবার ফিরে যাও নিজের ঘরে, সংসারে, সমাজে। যেখানে সবাই তোমার মুখেই তোমায় চেনে, মুখোশে নয়।
আজ সেই মুখোশ খোলার বিজ্ঞাপন দেখে আমার এই মুখোশ এর স্টল এর কথা মনে পড়লো। আমরাও আমি আর আমার মেয়ে বুটা মুখোশ পড়লাম এই স্টলে প্রবেশ করে। একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে ছবি তুললাম। তারপর মুখোশ খুলে রেখে মেলার ভীড়ে মিশে একাকার হয়ে গেলাম দুজনে বাবা আর মেয়ের সেই অভিন্ন জুটিতে।
কিন্তু কই মুখ আর মুখোশকে সম্বল করে তো আমরা সমাজে,সংসারে, হাটে বাজারে, অফিসে, কাছারিতে ঘুরতে পারলাম না আমরা কিছুতেই। যেখানে মুখ আর মুখোশ সেঁটে বসে গেছে আমাদের দুজনের মুখে। কই আমিও তো ভাবলাম কত জনের মুখোশ খোলার চেষ্টা করবো এই ভোরের লেখায়। কত তালিকা প্রস্তুত করলাম কিন্তু না পারলাম কই।
আমার মনে হলো মুখ আর মুখোশ আলাদা থাকাই ভালো কি দরকার তাকে উন্মোচন করে বিপদে ফেলার। শুধু শুধু নিজের মনে কষ্ট বৃদ্ধি করার। যে যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকি না। আর কদিন বাদেই আবার হবে এই নন্দন মেলা শান্তিনিকেতনে। সেই মুখোশের স্টলে যাবো আমি আর আমার মেয়ে। নানা মজার মুখোশ পড়বো আমরা। ছবি তুলবো। কিন্তু সেই মূখোশকে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখে ঘরে ফিরবো শুধু নিজেদের মুখকে সাথে নিয়েই। মুখোশকে আঁকড়ে জড়িয়ে নয়।
মুখোশ খোলার হুমকি - অভিজিৎ বসু।
ছয় নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে আভেরী বসু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন