চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। এটাই তো সেই বিখ্যাত লাইন কবি জীবনানন্দ দাসের। এই দুটো লাইন যে কতবার আওড়েছি আমি কে জানে। আমি কেনো অনেকেই এই লাইন কে মনে মনে বলেছি আমরা।
হ্যাঁ, আজ সাদা জীবনের কালো কথায় একদম আমার স্মৃতি থেকে ফিকে হয়ে যাওয়া সেই সুদূর কলকাতা শহর ছেড়ে ফ্লোরিডায় থাকা এক বিখ্যাত সাংবাদিক এর গল্প। যাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আকাশবাণী কলকাতার সেই লম্বা বারান্দায় খুব সম্ভবত সেই বাংলা বিভাগের দরজার সামনে। একদম ঝকঝকে সুন্দর একটা মেয়ে। যার সাথে কথা বলতে গেলে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। একে বাংলা বিভাগ এর নবীন বোদ্ধা সুন্দরী মহিলা সাংবাদিক বলে কথা।
অন্যদিকে আমি হলাম কলকাতার নয় গ্রামের মেঠো পথের ধারে অপেক্ষা করা স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের ঠিকে কর্মী বলে কথা। যদিও সেই সময় সবাই আমরা আকাশবাণীতে সেই ঠিকে পর্যায়ভুক্ত ছিলাম। কেউ কেউ সেটা বুঝতে দিত কেউ সেটা দিত না। যাকগে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়ার কি দরকার বলুন।
যাঁর কথা লিখবো বলে আমি কলম ধরলাম সেই বিদিশা রায়। হ্যাঁ, আমাদের সেই সময়ে ডাকসাইটে সুন্দরী বলা যায় তাকে। নামটাও বেশ আরও সুন্দর। যাই হোক আকাশবাণীর আলাপ পরে সেটা ইটিভির চাকরি সূত্রে যোগাযোগ আরও বেড়ে গেলো আমাদের। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে আমার তার আগের একটা অধ্যায় রচনা হয় সেই আমাদের খবর এর ক্যাসেট করে সিটিভিএন অফিসে জমা দিতাম আমি আর রূপম চট্টোপাধ্যায় দা। কোন্নগরের নবগ্রামে তাঁর বাড়ি। সেই সৌরভ বন্দোপাধ্যায় সেই সময় ক্যামেরাম্যান।
আর সেই সময় আমাদের খবর পড়তে যেতো বিদিশা শাড়ি পরে। হালকা মেকআপ নিয়ে। খবর পড়ানো হতো বাগুইআটির সেই সৌমেন এর বাড়ী বোধহয়। আসলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি বলে স্মৃতি জড়িয়ে যাচ্ছে আমার। সেই দিব্যেন্দু চক্রবর্তী বেহালায় বাড়ী সেও আসতো আমাদের এই আধ ঘণ্টার খবরের অনুষ্ঠানে। বর্তমানে যে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করে।
আর সেই আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানের প্রধান ভূমিকা যাঁর ছিল সেই অ্যাঙ্কর এর। যিনি গাঢ় রং এর শাড়ি পরে ঝলমল হয়ে সেজে আসতো। যাঁর নাম বিদিশা রায়। খুব সম্ভবত ওকে সেই সময় ট্যাক্সি করে আনতে হতো মানিকতলা থেকে তার ভাড়া দিতাম আমি। আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হতো। কিন্তু আকাশবাণীতে বিদিশা নানা অনুষ্ঠান করার সুবাদে ওর খবর পড়া বেশ ঝরঝরে। আর ক্যামেরায় ওকে দেখতেও মন্দ নয়। সংবাদ পাঠিকা হয়ে যেতে পারতো দিব্যি স্বচ্ছন্দে যে কোনো চ্যানেলে ও। ওর দিদিকেও দেখেছি বাংলা বিভাগে সেই সমরেশ দা আন্ডার এ কাজ করতে। হাসি মুখে কাজ করতেন তিনি। দিদি আর বোনের এই জুটি আকাশবাণীতে বেশ ভালই লাগতো আমাদের।
সেই থেকেই বিদিশার সাথে আলাপ পর্ব শুরু আমার। তারপর একদিন সেই তিন নম্বর চৌরঙ্গী স্কোয়ার এর বিখ্যাত বারান্দায় দেখলাম ওকে। কি রে ভালো আছিস বলে জিজ্ঞাসা করলো আমায়। আমি তখন হুগলীর দাপুটে রিপোর্টার হলেও কেমন মিনমিন করে একটু দ্বিধা নিয়ে বললাম, হ্যাঁ ভালো। কলকাতার অফিসের লোক বলে কথা। তার ওপর আবার অফিসের সব বাবুদের সাথেই কেমন মিষ্টি হেসে কথা বলে বেড়াচ্ছে আপনমনে ও।
আর আমি তো এসব দেখে আগের সেই পুরোনো স্মৃতি পুরোনো দিনের কথা সম্পর্ক সব ভুলে মেরে দিলাম আর কি। একটু চেনা মুখ এর হলেও কেমন একটা আড়ষ্ঠ ভাব নিয়েই কাটিয়ে দিলাম আমি। হ্যাঁ, বোলপুরে বসে সেই ফ্লোরিডায় থাকা সুন্দরী আমাদের সেই চেনা বিদিশার কথা লেখার ইচ্ছা হলো আমার তাই এতদিন পরে এই ভোরবেলায়। জানিনা আমি সেখানে এখন দিন না রাত।
এরপর তো ও বোধহয় কাজ ছেড়ে দিল ইটিভির। বেশি আর যোগাযোগ নেই আমাদের বহুদিন হলো। তার ওপর আবার বিদেশে থাকে বর্তমানে সে। বহুদিন আগে দেখলাম চব্বিশ ঘণ্টার অফিস পোদ্দার কোর্টে আমিও তখন সেখানে কাজ করি এসে হাজির হলো একদিন দুপুরে। অনির্বাণ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে। বহুদিন পর দেখা হলেও একবারেই চিনতে পারলো আমায়। আর সেটা দেখে আমারও বেশ ভালই লাগলো কে আর চিনতে পারে এই দুনিয়ায়। যাঁরা আবার ভারত ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে, কলকাতা ছেড়ে, মানিকতলার গলি ছেড়ে সোজা বিদেশের মাটিতে বসে আছে বসবাস করছে বেশ সুন্দর জীবন যাপন করছে।
আর এর মাঝেও একবার সেই মদন মিত্র পরিবহন মন্ত্রী থাকার সময় মহাকরণে দেখা হলো আমার সাথে। ওর পুরোনো দিনের গাড়ির কোনো সমস্যা নিয়ে মন্ত্রীর দ্বারস্থ হলেন। যা আমি নিয়ে গেছিলাম ওকে সেই বিখ্যাত মন্ত্রীর ঘরে। আর ওকে দেখে বিগলিত মন্ত্রী মদন মিত্রর হাসি মুখে আশ্বাস সব কাজ হয়ে যাবে কোনো চিন্তা নেই বলে আশ্বাস দেওয়া। মন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে ওর ঝকঝকে সাদা মুক্তোর মত দাঁত এর হাসি ছড়িয়ে পড়ল মহাকরণের লম্বা বারান্দায়।
এই আমাদের সেই বিদিশা। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য।মাঝে মাঝেই ফেসবুকে দেখতে পেয়ে রাত দুপুরে ওকে জিজ্ঞাসা করা কি খবর। ও হয়তো কোন সময় উত্তর না দিয়ে চলে গেছে ওর নিজের জগতে মাঝ সমুদ্রে ভেসে ভেসে। আবার কোনো সময় উত্তর দিয়েছে স্বেচ্ছায়। কি রে কি করছিস। যেখানে আর কেউ তাকে কি খবর বলে হয়ত কোনোদিন কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না। আবার কোনো সময় তাকে বিরক্ত করতে জিজ্ঞাসা করবে।
আসলে বুড়ো হলে বোধ হয় এমনিই হয়। স্মৃতি মেদুরতা জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে এই ভাবেই। সেই আকাশবাণীর লম্বা বারান্দা, সেই ইডেন এর মাঠের ওপর শীতের রোদ এর লুটোপুটি, সেই আকাশবাণীর ক্যান্টিনের সেই বিখ্যাত বাটার টোস্ট এর পোড়া গন্ধ, সেই ডিউটি রুমের ভিতরে নানা সেন্টার এর কথা গান হৈ চৈ হুল্লোড় ভেসে আসছে যেনো। সেই আকাশবাণীর স্টুডিওর ঠাণ্ডা হিমশীতল পরিবেশ সেই সব দিন গুলোর কথা মনে পড়ে গেলো আজ আমার এই এতদিন পরে। শুধু ওই চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশার কথা লিখতে গিয়ে। যার মুখটা ঠিক কবির ভাষায় অনূদিত শ্রাবস্তীর কারুকার্য খচিত।
জানিনা হয়তো আর কোনোদিন দেখাই হবে না আমাদের দুজনের। তবু সেই আধঘণ্টার খবর পড়া। সেই অস্থায়ী স্টুডিওতে লাইট জ্বেলে ওর মুখে ধরা। খবর পড়া হলে ওকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসা। আর সেই ক্যাসেট নিয়ে দৌড়ে সিটিভিএন এর অফিসে পৌঁছে দেওয়া। সেই থেকেই যে দৌড় শুরু হয়েছিল আজ সেই খবরের জন্য দৌড় আর নেই আমার। তবু মাঝে মাঝেই সবাইকে লুকিয়ে আবার আমার সেই পুরোনো দিনের মতো দৌড়তে বড়ই ইচ্ছা হয়। আর কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা হয় এই বুড়ো বয়সে, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য।
আমাদের আকাশবাণীর বিদিশা - অভিজিৎ বসু।
পনেরো নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন