আজ রাতে হঠাৎ করেই ফেসবুকের পর্দায় ভেসে এলো ওর ছবি। সেই পোদ্দার কোর্টের চেনা অফিস। সেই অ্যাসাইনমেন্টের চেনা টেবিল। সেই জি হেল্প লাইন এর ফোন। যে ফোন সারাদিন ধরে ক্রিং ক্রিং করে বেজে যেত একনাগাড়ে। সেই কলেজ পাশ করে সাংবাদিক হতে আসা উজ্জ্বল একঝাঁক তরুণ আর তরুণীর ইন্টার্নশিপের ইন্টারভিউয়ের আগেই উদগ্রীব মুখে বসে থাকা। সেই পোদ্দার কোর্টের অফিসের রিসেপসনের সামনের সোফায় হাতে সিভি নিয়ে সেজেগুজে। হ্যাঁ, ইন্টারভিউয়ের বোর্ডে একবারেই কোনো গোত্তা না খেয়েই পাশ করেছিল ও।
ওর ঝকঝকে সুন্দর মুখশ্রী আর চেহারা ওকে অন্যদের থেকে টিভি মিডিয়াতে খবরের চ্যানেলের অফিসে ওকে বেশ কিছুটা এগিয়েই রেখেছিল আর কি। তাই যখন ওর সাথে আমার বাজি হয়েছিল যে তুমি এই মিডিয়াতে কাজ জোগাড় করতে পারবে না এই ইন্টার্নশিপ শেষ করে, অন্য কিছু ভাবো তুমি। ও আমায় চ্যালেঞ্জ করেছিল আমি কাজ পাবই তুমি দেখে নিও অভিজিৎ দা। ওর কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম আমি সেদিন। ওর এই আত্মবিশ্বাস এর কথা শুনে। কিন্তু আমি ওর কাছে বাজিতে হার মানলাম। সেটা ও ওর কথা রেখে আমায় দেখিয়ে দিলো বাংলা চ্যানেলে কাজ জোগাড় করে ওর ইন্টার্নশিপ শেষ করেই হাসি মুখে।
হ্যাঁ, সেই বাবা মার হাত ধরে গাড়িতে করে যে অফিস আসতো কড়া পুলিশি পাহারায়। আবার রাতে ফেরার সময় সে ফিরে যেতো বাসে বা ট্রামে নয় বাবা মার সাথেই গাড়ি করে। যাকে নিয়ে সাংবাদিকতা শেখাতে রিপোর্টিং ফিল্ডে নিয়ে যাবার জন্য অনেক রিপোর্টার উৎসাহী থাকতো। কি করে ভালো করে ওকে সাংবাদিকতা শিখিয়ে দেওয়া যায় একবারে তালিম দিয়ে হাতে কলমে। সে পুলিশ বিট হোক, জেনারেল বিট হোক কিংবা পলিটিক্স এর বিট। কোনো কিছুই যেনো শিখতে ওর বাকি না থাকে।
ওর হাসি মুখের জাদুতে অনেককেই ও ম্যানেজ করে কাজ শিখে নিলো দ্রুত গতিতে। তারপর নিজের অধ্যবসায় এর জোরে কাজ পেয়ে গেলো ও বাংলা চ্যানেলেই। টিভির পর্দায় ওকে দেখে আমার বেশ ভালই লাগত। সেই শেষ দিন ও পোদ্দার কোর্টের অফিস এর বাইরে আমার সাথে ছবি তুলবে বলেছিল। যদিও সেই ছবি আর তোলা হয়নি আর আমার। কিছুটা ইচ্ছা করেই যদি হেরে যাই ওর কাছে সেই ভয়ে ছবিটা তুলিনি আমি সেদিন। ট্রাম লাইন পেরিয়ে দুজনেই চা খেয়ে অফিস ফিরে এসেছিলাম আমরা। আজ রাতে ওর হাসি মাখা উজ্জ্বল একটা ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো অনেক অনেক পুরোনো গভীর গোপন কথা। সেসব না হয় অব্যক্ত থাক।
সেই রিপোর্টার হলেন আমাদের শালিনী দত্ত। টিভি চ্যানেলের জন্য আদর্শ লুক এর রিপোর্টার। আমার একটু ভুল হয়েছিল ওর সাথে এই বাজি লড়ে। ওর কাছে বাজিতে হারার পর আমি সেটা বুঝতে পারলাম। হ্যাঁ, ও সত্যিই ঠিক কথাই বলেছিল আমায় ও দেখিয়ে দেবে এই মিডিয়া সেক্টরেই ও কাজ করবে। সেটা করলো ও নিজে। সেই নিউজ এইটিন বাংলা থেকে কাজ শুরু করে রাজ্য ছেড়ে সেই টাইমস নাউ এর দিল্লী অফিস পৌঁছে গেলো শালিনী দত্ত হাসতে হাসতে। সবাইকে তুড়ি মেরে দেখিয়ে দিলো ও।
কিছু কিছু মানুষ বোধহয় এইভাবেই উল্কার গতিতে এগিয়ে চলতে জানে নিজের ক্যারিশমায় আর কেরামতিতে। শালিনী বোধহয় এই মিডিয়ায় টিকে থাকার সেই কঠিন অংকের ফর্মুলাটা জানতো কি করে টিকে থাকতে হয় যেটা ওর অন্য অনেক বন্ধুই টিকে থাকতে পারেনি। কেউ হারিয়ে গেছে,কেউ আবার বিদেশে চলে গিয়ে সুখে ঘর সংসার করছে। আর তাই সেদিন আমায় বাজিতে জোর দিয়ে বলেছিল সে পারবেই। আমি খুশি হয়েছি ওর কাছে হেরে গিয়ে। আমি জানিনা ও কোথায় আর কোন চ্যানেলে কাজ করে এখন। হয়তো দিল্লিতেই থাকে বা মুম্বাই বা অন্য কোথাও। এই কঠিন মিডিয়া সেক্টরেই লড়াই করে বেঁচে আছে সে হয়তো। আমি তো এখন টোটো চালক ওর খবরে আর কি দরকার। তবু ওর সেই পুরোনো ছবি দেখে মনে হলো নানা কথা।
সেই দেবারতি দা ওর প্রিয় বন্ধু, যার সাথে ছবি দেখলাম আমি। সেই ওর প্রিয় দেবশ্রীদি যার সাথে ওর ভালো বন্ধুত্ব ছিল। সেই কালাম এর দোকানে চা খেতে যাওয়া ওদের সাথে দল বেঁধে। সেই সকাল বেলায় পোদ্দার কোর্টের গোল কাঁচের ঘরে বসে ছবি কাটার শিক্ষালাভ করা ভিডিও এডিটরদের কাছ থেকে। সেই সব সেই সময়ের চব্বিশ ঘণ্টার বিখ্যাত নানা দাপুটে সাংবাদিকদের সাথে কাজে বেরিয়ে কেমন হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণ করা। যে শিক্ষা নেওয়া ওকে অনেকটাই হয়তো এগিয়ে দিয়েছে এই মিডিয়ায়।
সেই ইন্টার্ন হতে আসা শালিনী দত্ত আজ সত্যিই আমায় হারিয়ে দিয়ে গেলো হাসিমুখে। যে হারায় আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। এই রাতের বেলায় আমায় হারিয়ে দেওয়া এক জুনিয়র সাংবাদিক এর কথা লিখতে বসে সত্যিই আমি খুশি হলাম। বহুদিন কথা হয়নি ওর সাথে। যদি কোনোদিন মিডিয়াতে ফিরতে পারি ওকে সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, তুমি জিতে গেছো আর আমি হেরে গেছি সেদিনের বাজিতে।
লড়াই এর ময়দানে আমি টিকে থাকতে না পারলেও ও কিন্তু দিব্যি টিকে আছে হাসি মুখে। ভালো থেকো তুমি শালিনী। টোটো চালকের লেখা এই সাদা জীবনের কালো কথায় আমার ব্লগে এটাও লেখা থাক এক হারা রিপোর্টার আর এই এক জেতা জুনিয়র সাংবাদিকের গল্প। সেই পোদ্দার কোর্টের নানা গভীর গোপন গল্প কথা। যে গল্প আমাদের আজও মুগ্ধ করে, দুঃখ দেয়, সুখ দেয়। যে স্মৃতির জারক রসে আমি তুমি জারিত হই আজও।
হারা ও জেতার গল্প - অভিজিৎ বসু।
তেইশ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন