কলকাতা থেকে ছবিটা উড়ে এলো। নীল রঙের তিন চাকার সেই পঙ্খিরাজের মত আমার বড়ো প্রিয় তিন চাকার একটি টোটো। তার গায়ে লেখা বিখ্যাত ভয় ধরানো শব্দ প্রেস। যিনি আমায় এই ছবিটা পাঠালেন সেই সন্দীপ সরকার আমায় জিজ্ঞাসা করলেন দাদা, এটা কি তোমার? প্রথমে একটু রাগ হলো আমার ওর কথায়। একটু কষ্ট বা দুঃখ। ওকে উত্তরে লিখলাম কেনো। এটা আমার নয় ভাই। হয়তো বোলপুরের কোনো রিপোর্টার কিনেছে এটিকে। তাই সামনে লিখে দিয়েছে সাধ করে।
যেহেতু টোটো চালক বলে আমার নাম বা বদনাম দুই আছে বাজারে। টোটো চালিয়ে খাবো বলে চাকরি ছেড়ে হুমকি দিয়ে চলে এসেছি আমি বুক ফুলিয়ে, সেই এগারো তলার অফিস থেকে ব্যাগ নিয়ে। আর তাই তো টোটো সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলেই আমায় ধরা হয়। সে কলকাতার রিপোর্টার সন্দীপ সরকার হোক। কিম্বা অন্য যে কেউ। কেউ আবার আমায় ফোন করে বলেন দাদা একটু সস্তায় ঘোরা যাবে। কিন্তু এই প্রেস লেখা টোটোর ভয় ধরানো ছবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো সমাজ মাধ্যমে। চারিদিকে ছি ছি রব উঠলো। গেলো গেলো রব উঠেছে চারিদিকে। কি দিন পড়লো বলে চিল চিৎকার উঠলো। কেউ বলছে পুরস্কার দেওয়া উচিত ওই টোটোওলাকে খুঁজে বের করে। আবার কেউ বলছে এটাও দেখার বাকি ছিল। যা দিন কাল পড়েছে। সত্যিই ভাবা যায়না। ধরণী দ্বিধা হও এই অবস্থা। কলি কাল বলে কথা।
সন্দীপের ছবি দেখে মনে মনে নানা কথা ভাবছি আর ঠিক তারমাঝে দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ছে সেই প্রেস লেখা টোটোর ছবি চারিদিকে। এদিক থেকে ওদিক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেই ছবি। দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে প্রেস লেখা টোটোর ছবি। কেউ বলছে কি দিন পড়লো। কেউ বলছে ঠিক হয়েছে অসুবিধা কোথায়। আবার কেউ বলছেন না না, তাবলে প্রেস লেখার হক কে দিলো ওকে। এত স্পর্ধা, এত সাহস। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে বুকে সাঁটিয়ে ঘুরে বেড়ানো বুক ফুলিয়ে রবি ঠাকুরের দেশে। সাহস তো কম নয়। এত বড় বুকের পাটা। আর আমি চুপ করে সব শুনছি আর শীতের সকালে বিছানায় শুয়ে মজা পাচ্ছি বেশ।
সত্যিই তো তিন চাকার টোটো চালক এর জীবন। দশ, বিশ, ত্রিশ বা খুব বেশি হলে সারাদিন দু তিনশো টাকার রোজগার। সিজন এলে পাঁচশো বড়ো জোর। যদি সেটা ভাড়ার টোটো না হয় নিজের টোটো হলে। ভাড়ার টোটো হলে দু আড়াইশো টাকা বাদ গাড়ির মালিককে দিয়ে দিতে হবে। আর যদি নিজের গ্যারেজ থাকে তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। আর এর মাঝে আছে টোটোতে প্রতিদিন চার্জ দেবার খরচ। এত সব কিছু দায় আর দায়িত্ব নিয়ে, তার মাঝে শুধু একটু প্রেস লেখা হয়েছে। আচ্ছা এমন তো হতে পারে এই টোটোওলা একজন প্রাক্তন সাংবাদিক। যার পকেটে এখনো প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন এর রিনিউ না হওয়া কার্ড তার পকেটে বা ব্যাগে পড়ে আছে এক কোনায়। সেই কার্ডের বয়স প্রায় কুড়ি বছর পার হয়েছে। যে টোটো চালক মাঝে মাঝেই সেই পুরোনো কার্ডকে দেখে ব্যাগ থেকে বের করে।
সে হয়তো পঁয়ত্রিশ বছর সাংবাদিকতা করার পর টোটো চালিয়ে দুটো সৎ ভাবে রোজগার করছে। কারুর কাছে হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে তার বশ্যতা স্বীকার না করে চাকরি করছে না। কোনো নেতা ,মন্ত্রী, পুলিশ অফিসারদের কাছে খবর করার ভয় দেখিয়ে টাকা চাইতে হয়না তাকে। নেতাদের কাছে গিয়ে মাসের প্রথমে তার অফিসে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হয়না। নিজের নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা ইনকাম করতে হয়না নেতা, মন্ত্রী বা থানা থেকে প্রতি মাসে। দশ, বিশ হাজার বা খুব জোর ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার করে কোটি টাকার বাড়ী গাড়ি করে ঘুরে বেড়াতে হয়না তাকে। হয়তো তাকে সিবিআই এর নোটিশ পেতে হয়না তিন মাস অন্তর। ইডি এসে সমন দিয়ে বলে না তাকে কলকাতা অফিসে দেখা করতে হবে।
তাহলে আর ক্ষতি কি এই প্রেস লেখায়। ক্ষতি তো আছেই গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর গায়ে যে কেউ কি আর এই বড়ো গর্বের, বড়ো সাধের প্রেস লেখা বুকে জড়িয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে পারে, ঘুরে বেড়াতে পারে এমন বিন্দাস হয়ে। ভারতীয় সংবিধান তো সেই হক দেয়নি সেই টোটো চালককে। তাহলে আর এত প্রেস লেখার সাধ জাগে কি করে তার।
আমি মনে মনে ভাবি ঘরে শুয়ে ভাগ্যিস আমি টোটো চালক হয়ে যাইনি এখনো মুখে বললেও। ভাগ্যিস এখনও আমার সাধ জাগে নি আমার টোটোর গায়ে প্রেস লিখে ঘোরার। তাহলে যে সত্যিই কি হতো কে জানে। হয়তো আমার পুরোনো দিনের এক সময়ের সহকর্মী, মিডিয়ার বন্ধুরা আমাকে প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়েই মেরে ফেলতো তারা। আর উল্লাসে বলতো এত বড় সাহস হয় কি করে তোর প্রেস এর লোক না হয়েও আমাদের সাইন বোর্ডকে বুকে জড়িয়ে ঘুরে বেড়ানোর। শীতের সকালে আমি কুলকুল করে ঘামতে থাকি সেই কথা হবে। সত্যিই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের কি মহিমা।
প্রেস লেখা টোটো ও আমি - অভিজিৎ বসু।
বাইশে নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
একটা টোটোয় প্রেস লেখা থাকায় যাঁরা সংবাদমাধ্যমের কৌলিন্য গেল বলে হা-হুতাশ করছেন তাঁদের দেখে করুণাই হচ্ছে। আসল সাংবাদিকতার শপথ থেকে নিজেকে ১০০ মাইল দূরে রেখে কোনও এক রাজনৈতিক ধামাধরা চ্যানেল বা কাগজের ( যার গালভরা নাম হাউজ পলিসি) মাস মাইনের চাকরি করছেন তিনি আর যাই হোন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক নন। গালভরা চ্যানেলের বুম নিয়ে নানা রঙের চারচাকা থেকে নামলেই সাংবাদিক গরিমা তৈরি হয় না।সে জায়গায় নিজের উদ্যোগে কাজ করা স্বাধীনচেতা ইউটিউবার বা ব্লগার অনেক বেশি সম্মানীয়, স্বাধীন ও গণতন্ত্রের প্রহরী। এই রকম এক সাংবাদিক যদি কাজের সুবিধের জন্য টোটো বা টেম্পো নিয়ে ঘোরেন তাতে ছেঁদো সাংবাদিককুলের এত গায়ে লাগছে কেন? তাঁরা কী সংবাদজগতের ব্রাম্ভণকুল মনে করেন নিজেদের?
উত্তরমুছুন