সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হায়দ্রাবাদ এর বড়া বোলপুরে

রবিবার সন্ধ্যায় বোলপুরের রাস্তায় শ্রী নিকেতন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে গেল আমার একটা দোকানে। রাস্তার পাশের একটি দোকানে কম বেশি ভীড় রয়েছে। হালকা ঠাণ্ডায়  রবিবারের সন্ধ্যায় লোকজন বেশ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। আমার চোখে পড়লো এক ফার্স্ট ফুডের দোকানে রাখা সেই বিখ্যাত হায়দ্রাবাদের বড়া। সত্যিই বলতে কি আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। ঢুকে পড়লাম দোকানে। ছিমছাম দোকান। হালকা হিন্দি গান বাজছে। অর্ডার দিলাম দু প্লেট বড়ার। পকেটে টাকা আছে কি না, সেটা না দেখেই বসে পড়লাম টেবিলে।

অপেক্ষায় রইলাম বড়ার,কখন আসবে সে। কবিগুরুর দেশে হায়দরাবাদি সেই বড়া দর্শন করে, আমি সত্যিই তখন রীতিমত উত্তেজিত। অবশেষে দুটি প্লেট সাজিয়ে বড়া এলো আমার কাছে। এক মনে তাকে নিরীক্ষণ করলাম আমি অনেক সময় ধরে। কত কথা মনে পড়ছে আমার। এক লহমায় পিছিয়ে গেলাম প্রায় দশ বছর আগের জীবনে। এক সময় এই বড়া খেয়েই দিন কেটেছে হায়দ্রাবাদে।গরম বড়া আর চা খেয়ে সকালের টিফিন পর্ব সারতাম আমি রোজ সকাল বেলায় তখন। তারপর ঘরে ফিরে কোনো রকমে একটু রান্না করে খেয়ে অফিসের বাস ধরতাম আমি। প্রতিদিন এই এক রুটিনের কোনো পরিবর্তন হয় নি আমার, হায়দ্রাবাদের কিছুদিনের কর্ম জীবনে। যদিও সেই জীবনের নাম দিয়েছিলাম আমি নিজেই, পানিশমেন্ট লাইফ। কিন্তু কেনো পানিশমেন্ট হলো সেটা আজও বুঝতে পারলাম না আমি। কী জন্য আমার পানিশমেন্ট সেটাই অধরা, অজানা থেকে গেলো আজও আমার কাছে।

জেলার সাংবাদিকতার গন্ডি পেরিয়ে আমার ইচ্ছা হয়েছিলো, একটু কলকাতা শহরে গিয়ে কাজ করার। আর সেটাই যে আমার কাছে পানিশমেন্ট ডেকে আনবে বুঝিনি তখন। জেলার গাঁয়ের গন্ধ গায়ে মেখে গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়ে ছিলাম শহর কলকাতায়। জেলা থেকে বড়ো চেহারার শহরে এসে কিছুটা থই হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রথমে আমি। ঠিক যেমন উয়াড়ি দল থেকে মোহনবাগান মাঠে খেলতে নামলে যেমন হয় আর কি। আমারও সেই অবস্থাই হয়েছিল। কিন্তু আমি সাহস হারাইনি কোনো দিন। কলকাতার মাঠে খেলতে গিয়ে প্রথমে একটু জড়তা ছিল, সেটাকে কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলাম। অচেনা মাঠ হলেও নিজের মধ্যে সাহস এনে নতুন দৌড় শুরু করলাম। জেলার লোক এর গায় তখন জেলার গন্ধ বিদ্যমান। কলকাতার বাবুদের হাল হকিকত বোল চাল, না বুঝলেও খবর বুঝতে অসুবিধা হতো না আমার কোনো দিন। মুখ চোরা হলেও বেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছিলাম আমি নতুন কলকাতার মাঠে। ভেবে ছিলাম জেলা থেকে কলকাতায় এসে ভালই হলো।

কিন্তু না ছন্দপতন হলো একদিন। দুপুরে মহাকরনের প্রেস কর্নার এর কাছে চেয়ারে বসে আছি আমি একা। আচমকা অফিসের একটা ফোন এলো। ওপর প্রান্ত থেকে শুধু আমার কানে এলো সাত দিনের মধ্য আমায় হায়দ্রাবাদ চলে যেতে হবে,বিকেলে অফিস ফিরে যেনো ট্রান্সফার অর্ডারটা নিয়ে যাই আমি। চোখের সামনে অচেনা মাঠটাকে বড়ো কঠিন আর কঠোর মনে হলো আমার। এবড়ো খেবড়ো মাঠ এর মাঝখানে একা বসে রইলাম আমি স্থবির হয়ে কিছু সময় একা। শুধু বাড়িতে ফোন করে জানালাম আমার পানিশমেন্ট ট্রান্সফার হলো। কী জন্য, কার জন্য আমি আজও জানি না। জানতে চাই না সে কথা। শুধু এটুকু জানি শিরদাঁড়া না ঝুঁকিয়ে কাজ করলে, কলকাতার মাঠে বাবুদের সাথে খেলাতে পেরে ওঠা খুব কঠিন। সত্যিই বড়ো যন্ত্রণা নিয়ে, আমি কলকাতা ছাড়লাম। 

চোখের সামনে মহাকরণের বারান্দায় মন্ত্রীর আনা গোনা সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে আমার। ক্ষমতার মসনদের কাছে পৌঁছতে চেয়ে খবর এর সন্ধানে কলকাতা এসেছিলাম। দীর্ঘ কুড়ি বছর জেলায় কাজ করে কলকাতার সাংবাদিক হবো বলে এসেছিলাম। কিন্তু পারলাম না আমি কলকাতায় কাজ করতে। বাড়ী ফিরলাম হাতে ট্রান্সফারের চিঠি নিয়ে। প্রাণপাত করা চাকরিতে, জীবনকে বাজি রেখে যে চাকরি করেছি আমি। সেই চাকরিতে এক লহমায় আমার রিপোর্টার এর জীবনের ইতি টেনে দেওয়া হলো শুধু একটা কলমের খোঁচায়, কিছু লোকের ক্ষমতার জোরে। চুপ করে নিঃশব্দে ঘর ছাড়লাম আমি।

কলকাতা ছাড়ার দিনটা আমার আজও মনে পড়ে, সকাল সাতটা পঁচিশের ট্রেন ছাড়লো হাওড়া স্টেশন থেকে। আমার ছোটো মেয়ের অবয়ব ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে দ্রুত আমার চোখের সামনে থেকে। ট্রেনের দরজা ধরে আমি হাত নাড়ছি,আমার বুটাও হাত নাড়ছে।আস্তে আস্তে দুজন দুজনকে ছেড়ে চলে গেলাম। দূরে অনেক দূরে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে। চোখের জলে ভিজে গেল আমার গোটা যাত্রাপথ। সেই পিছল যাত্রাপথকে সঙ্গী করে আমরা বেঁচে রইলাম। আপনজনকে ছেড়ে চলে যাবার সময় এত যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, সেটা বোধ হয় জীবনের এই ট্রান্সফার না হলে বুঝতে পারতাম না আমি। জীবনের পরতে পরতে এত ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে আমাদের সকলকে ঘিরে। একটু ঘসা মাজা করলেই সেই ভালোবাসার প্রদীপ দপ করে কেমন জ্বলে ওঠে। আর আমরা সবাই সেই ভালোবাসার উত্তাপে ,গলে জল হয়ে যাই সবাই এক নিমেষে।

 তাহলে কে বলে, মানুষ স্বার্থপর, কে বলে মানুষ অন্যর কথা ভাবে না। এসব একদম ভুল কথা।তাহলে কি আর এত কান্না ভেজা শিশিরের বিন্দু বিন্দু জল ঝরতে পারতো আমার চোখে, আমার মেয়ের চোখে। এই জল আমাদের সকলকে ঘিরে রাখে, জড়িয়ে রাখে সারাটা জীবন। শেখায় কি করে দূরে চলে গিয়েও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে হয়, ঘরে ফেরার দিন গুনতে হয় একটা একটা করে। তারপর সেই দিন এলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার আনন্দ ভাগাভাগি করে একান্তভাবেই উপভোগ করতে হয়। আর এটাই জীবনের আসল স্বর্গ প্রাপ্তি।

সত্যিই আমি আজও জানি না কেনো আমার বদলি হলো। পূজোর ঠিক এক মাস আগে আমি চলে এলাম হায়দ্রাবাদ। একদম অজানা অচেনা শহরে একা। বাংলায় কাজ করা রিপোর্টারকে আরো শাস্তি দিতে তাকে বসানো হল ন্যাশনাল ডেস্ক- এ। বাংলা চ্যানেলে কাজের কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না আমায়। যাতে আমার লড়াই আরো কঠিন হয়।কোনো দিন আর বাংলায় ফিরতে না পারি আমি। লড়াই করে বাঁচতে পারব এই আশা নিয়ে আমি লড়তে নামলাম আরো অচেনা এক মাঠে। যে মাঠ আরও অচেনা। এসব ভাবতে ভাবতে প্লেটের বড়া গুলো আমায় চুপ করে দেখছিল এক মনে। কী লোকরে বাবা দু প্লেট বড়া নিয়ে বসেই আছে সেই কখন থেকে। আর একমনে জরিপ করছে আমাদের।

সত্যিই এমন আজব পাবলিক দেখিনি আমরা কোনো দিন। এক প্লেট অন্য প্লেটকে ইশারায় বলে ফিস ফিস করে। আমি কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে প্লেট দুটোকে কাছে নিয়ে যাই। এক প্লেটের সাথে অন্য প্লেটের গায় গায় ঠেকিয়ে রাখি।আর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে।মনে পড়ে যায় ভাগ্যলতার সেই চা -এর দোকানটার কথা।সকালে উঠে যেখানে বসে এই ভাবে টিফিন সারতাম আর বাড়িতে ফোন করে বলতাম আমি ভালই আছি তোমরা চিন্তা করো না। সকালে প্রতিদিন যে মেয়েকে স্কুলের গাড়িতে তোলা আমার কাজ ছিল ,সেই ছোটো মেয়ে বাবাকে ছেড়ে প্রতিদিন মার হাত ধরে টাটা করে গাড়িতে বসে স্কুল যেত চুপ করে। সে জানতো মাঝ রাতে অফিস থেকে ফিরে তার বাবা তাকে বুটা বলে সকালে ডাকতে পারবে না আর। সে জানতো তার বাবাকে পানিশমেন্ট দেওয়া হয়েছে। আর কোনো দিন তার বাবা ফিরতে পারবে না কলকাতা। আমি জানতাম না আমার ছোট্ট বুটা,আমার বালিশের নিচে পেন্সিল দিয়ে বু লিখে সেটা আঁকড়ে ধরে প্রতি রাতে নাকি ঘুমোতে যেত। মুখ লুকিয়ে সে প্রতি রাতে তার বু কে ফিরে আসবে ভেবে স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ত।অনেক পরে এসব আমি জানতে পারি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসে। 

আজও মনে পড়ে আমার, মহালয়ার ভোরে বাবা মেয়ে দুজনে একসাথে মোবাইলে পূজোর আগমনী গান শুনেছিলাম সেই বছর। দুজনেই একসাথে ভোর রাতে বালিশ ভিজিয়েছি কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চাইনি আমরা বাবা আর মেয়ে। যাতে কেউ না কষ্ট পাই। আজও মনে পড়ে দূর্গাপূজার সময় সেই বছর ঘরে ফিরতে পারিনি আমি। দেওয়ালিতে বাড়ী এসেছিলাম আমি। আসার পর আমার বুটা সারা দুপুর আমার কাছে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল, ছোট্ট বাচ্চার মত একমিনিট কাছ থেকে নড়েনি সে। আমি ভুলবো কি করে এই জীবনের এসব অভিজ্ঞতার কালো কথা গুলো। সাদা জীবনে এই কালো কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। 

একে একে ভেসে আসছে নানা স্মৃতি। ছুটি কাটিয়ে আবার আমি ফিরে গেলাম কাজ এর জায়গায়, মাঝে চেষ্টা করলাম যদি আর ফিরতে না হয় হায়দ্রাবাদ। কিন্তু না হাজার চেষ্টা করেও লাভ হলো না কোনও। আবার কলকাতা ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, সাংবাদিক জীবন ছেড়ে চলে গেলাম আমার কঠিন পানিশমেন্ট জীবনে। ফিরে যাবার সময় বুটার দরজার আড়াল থেকে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। বারান্দা থেকে হাত নাড়িয়ে বলা, সাবধানে যাও তুমি। আমি আজও ভুলতে পারি না সেই দৃশ্য, সেই সব কালো দগ দগে স্মৃতিকে কি ভোলা যায়। কেনো যে আমার জীবন থেকে খবর কে কেড়ে নেওয়া হলো আজও জানি না আমি। শুধু এটুকু জানি, বুঝি আমার শিরদাঁড়া সোজা রাখার ফল আমি পাচ্ছি সারা জীবন ধরে।

 চুপ করে এসব কথা শুনছিল ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া প্লেটের বড়াগুলো একমনে। এত সময় যারা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করছিল তারাও যেনো কিছুটা চুপ করে গেছে সব শুনে। ভাবছে সত্যিই পাগল আছে লোকটা। ওদের বোধহয় শেষটা শোনার ইচ্ছা হচ্ছিল তাই আমিও অস্ফুটে বলে ফেললাম ওদের দুজনের কাছে বাকিটুকু উজাড় করে। এক সময় খবর পেলাম আমার বুটা খুব অসুস্থ। আর কোনো উপায় না দেখে আমি নিজেই স্বেচ্ছায় আমার পানিশমেন্ট - জীবনের ষোল বছরের চাকরিকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম হায়দ্রাবাদ ছেড়ে ,আমার ঘরে ,আমার বুটার কাছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালাম আমি সেদিন থেকেই।


 কিন্তু ফিরে পেলাম আমি আমার প্রাণের ভালো বাসাকে। আর প্রতি রাতে আমায়, আমার মেয়েকে আজ চোখের জলে ভিজে ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে হয় না। হাজার কষ্টের, যন্ত্রণার, আঁধার রাতের অন্ধকারে আচমকা জানলার পাশে কেউ বসে থাকে না। বলে না আমাদের সময় হয়ে গেছে এই বার দূরে চলে যেতে হবে তোমাদের একে অপরকে ছেড়ে। আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত। আমরা একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করি। অভিমান করি একে অপরের সাথে।আবার এক থালায় ভাত মেখে খাই। সাইকেল করে দুর আকাশের নিচে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আমরা। বুনো ফুল তুলে বেড়াই। ধুপ করে গাছ থেকে তাল পড়লে দৌড়ে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাল তুলে বেড়াই দুজনে। এই জীবনের আস্বাদ কখনো কি ভুলতে পারি। 

আমার পানিশমেন্ট যারা দিয়েছিলেন আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে এই ঘটনা না হলে বোধহয় জীবনের পরতে পরতে এত ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে সেটা বুঝতে পারতাম না আমি।  টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ি আমি। দু প্লেট বড়ার দাম দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই একা একা আপন মনে। পাগল হলেও নিজের কলজের জোরে, শিরদাঁড়ার জোরে যেনো আমার বাকি জীবনটা এই ভাবে কেটে যায়। শুধু ফাঁকা নিঃস্ব জীবনের পরতে পরতে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে এই ভাবে। সে যেনো আমায় ছেড়ে না চলে যায় কোনোদিন। 

সোনাঝুরির রাস্তায় দেখি সন্ধ্যার অন্ধকারে একা বসে আছেন বিশাল আকৃতির বুদ্ধ মূর্তি। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তিনি আলোকিত। স্মিত হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন তিনি। সারা বিশ্বকে যিনি নিজেই ভালবাসার বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন। সেই ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছি আমিও।একা একা হিমেল বাতাস গায়ে মেখে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাই আমি একা একদম একা। জানি দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে আমায়, না হলে যে এক্ষুনি আমার বুটার ফোন আসবে কোথায় তুমি।দ্রুত ঘরে ফেরার রাস্তা ধরি আমি। ফিরে যাই আমার ভালবাসার কাছে।

বোলপুরের রাস্তায় হায়দরাবাদ এর বড়া - অভিজিৎ বসু।
সাতাশ নভেম্বর, দু হাজার তেইশ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...