সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তিন চাকার টোটো

এই তিন চাকার টোটো নিয়ে আমার দুর্বলতা অনেক দিনের। খোলা মেলা এই যানটি বেশ পরিবেশ বান্ধব। সব দিক থেকেই এই গাড়ি চড়তে বেশ ভালো লাগে আমার। টোটোতে বসে নিজেকে কেমন যেন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজামশাই মনে হয় আমায় নিজেকে।

পকেট গড়ের মাঠ হলেও নিজের ভিতরে যে 
বাবুয়ানি ভাব, সেটা কেমন করে যেন ফুরফুরে মেজাজে ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে বেরিয়ে পড়ে আচমকাই। ফুর ফুর করে তারা উড়ে যায় যেনো ডানা মেলে এদিক ওদিক ঠিক লাল নীল প্রজাপতির মতো। সত্যিই আমি খুব উপভোগ করি টোটো করে ঘুরে বেড়ানোকে। যার অন্য কোনো কারণ আছে কি না জানিনা আমি। যাই হোক ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত রচনা করা আমার উচিৎ নয়।

যে কোন জায়গায় এখন পা টানা রিকশ চালকদের পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে টোটো রাস্তা ঘাটে সর্বত্র। পাড়ার দাদাদের কল্যাণে তারা এখন মিষ্টি বাহন শহরে আর গ্রামে। সত্যিই বলতে কি অনেকে এই যানকে পছন্দ করলেও কেনো যে টোটো চালক এর কাজ কে পছন্দ করে না, নাক সিঁটকোয় কে জানে। অনেককেই আমি বলতে শুনেছি ও বাবা টো টো চালায় ও, এতে নাক সিটকানোর কি আছে কে জানে। কাজ করে তো টাকা রোজগার করে ওরা। খারাপ উপায়ে তো টাকা আয় করছে না ওরা। তাহলে ওদের নিয়ে এত হাসাহাসির কি আছে কে জানে।

 এই তো আমি নিজেই, কিছুদিন আগেও বেশ একটা ভালো সর্বভারতীয় মিডিয়াতে কাজ করতাম। আমার আশপাশে সব দাপুটে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের ভীড় দেখতে পেতাম সব সময়। সব স্বপ্নের মত বিরাজ করতেন তাঁরা আমার চোখের সামনে এদিক ওদিক। যেমন তাঁদের দাপট, তেমন তাঁদের রূপ। সেই রূপের ছটায় মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্হা।

 এদের কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে পাবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। ওদের দেখে আমি তো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি শুধু। যেনো এঁদের কোনো দিন এইভাবে দেখতে পাবো ভাবিনি আমি। একদম গা ছম ছম করা পরিবেশে কাজ করতাম। খালি মনে হতো এই বোধহয় সবার সামনে ভুল ধরে অপদস্থ হতে হবে আমায়। আচমকা একদিন আমার মনে হলো, না এই কাজটা আর করা যাবে না। যেমন ভাবা আর তেমন কাজ। আগু পিছু না ভেবে দুম করে ছেড়ে দিলাম সংবাদ মাধ্যমের চাকরিটা। 

কত কাঠ খড় পুড়িয়ে এই কাজ জোগাড় করতে হয়েছিল আমায় একদিন। যদিও এই কাজটি আমায় ডেকে দেন কলকাতার একজন বিখ্যাত সাংবাদিক সেই অনির্বাণ চৌধুরী। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন। এই সুযোগ করে দেবার জন্য। না হলে কি আর দাপটের এমন হরেক। কিসিমের রূপ দেখতে পেতাম কোনোদিন আমি। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের দাপট দেখার সৌভাগ্য হলো আমার এই জীবনে। 

কত পুরুষের দাপট আর নারীর দাপট, বসের দাপট, প্রোডিউসার এর দাপট, ডেস্ক এর কলম পেশা ছাপোষা সহকর্মীর দাপট, ক্যামেরা চালানো ক্যামেরাম্যান এর দাপট, সেই ইনপুট আর আউটপুট হেড এর দাপট, সেই বিখ্যাত পুরুষ এক অ্যাঙ্কর এর দাপট যে আমায় নিউজরুমে কলার ধরে মাটিতে মেরে ফেলে দিয়ে বলেছিল কত মালকে যে এইভাবে পিটিয়ে সোজা করেছে সে তার বর্ণময় কর্ম জীবনে। কিন্তু সেই চোখে চোখ রাখা বিখ্যাত সেই সাংবাদিক বোধহয় জানেনা এই মালকে মেরে সিধা করা যায়না। না, কোনো অভিযোগ করিনি আমি সেদিন কোথাও না পুলিশ না অফিসে। 

বিখ্যাত সেই সিনেমার ডায়লগ মনে পড়ত আমার বোধহয় রবি ঘোষ বলেছিলেন, বাবা কি দাপট...।
 যা দেখে কিছুটা হলেও থমকে গেল আমার মন। আর কিছুটা তার জেরেই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আমি। সত্যিই বলতে কি কম বেশি ক্ষমতা পেলেই এরা সব বাঘ এর মত হয়ে যায়। হাতে চাবুক ঘুরিয়ে নিজেকে কেউ সম্রাট আকবর, কেউ নিজেকে ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই ভাবেন। আসলে এরা বোধহয় সেটাই হতে চেয়েছিল জীবনে। কিন্তু ভুল করে তা না হতে পেরে এই অন্য এক পেশায় এসে গেছেন।

 কী আর করবেন তাই কিছুটা বাধ্য হয়ে আমরাও যারা কাজ করতে যেতাম এই ভাবেই প্রতিদিন নানা ধরনের হালুম এর পাল্লায় পড়ে রক্তাক্ত হতাম। আবার পরদিন ওষুধ সেবন করে অফিস যেতাম মাথা নিচু করে মুখ বুজে। কিন্তু একদিন মনে হলো এইভাবে প্রতিদিন হালুম এর পাল্লায় পড়লে মরে যাবো আমি। আসলে এরা সত্যিই হালুম না অন্য কিছু সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। পরে সেটা নিয়ে বলা যাবে কোনো এক দিন। শুধু এটুকু বলতে পারি এরা নিজেরা, সত্যিই খুব ভীতু প্রকৃতির জীব। 

যাই হোক একদিন কাজ ছেড়ে চলে এলাম আমি। কাজ ছেড়ে চলে আসার পর অনেকেই বলেন এই ভাবে কাজ ছাড়লে বিপদ হবে তোমার ভবিষ্যতে। কারণ রিলিজ লেটার না নিলে অন্য কোথাও কাজে যোগ দেওয়া যাবে না আর কোনোদিনই। কিন্তু আমার তখন কিছুই মাথায় নেই। শুধু মুখে হাসি নিয়ে বলে ছিলাম টোটো চালাতে কি আর রিলিজ লেটার লাগবে আমার কোনোদিন। আর সেটাই বিপদ বাড়িয়ে দিল আমার জীবনে। সত্যিই তো কি হবে যেখানে নিজের কাজের জায়গায় অপদস্থ হবার আতঙ্কে কেউ কাজ করবো না বলে কাজ ছেড়ে দেয়। সেখানে কাজ ছাড়ার মুক্তির চিঠি,ঘরের আলমারিতে ফাইল বন্দী করে না রাখলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে কে জানে। তাই আমি এই কথাই বলেছি, যে টোটো চালাতে আমার রিলিজ লেটার লাগবে না। আর এটাই আমার গায়ে সেঁটে দেওয়া হলো যে আমি টোটো চালক হয়ে বেঁচে আছি মিডিয়া ছেড়ে।

 সত্যিই বলতে কি খারাপ লাগেনি এসব শুনে বরং আমার ভালো লেগেছে সেই সময় এটা শুনে। যাই হোক চোর পকেটমার তো বলেনি এরা কেউ এটাই ভাগ্য ভালো আমার। আমার আজও মনে আছে সাধারণত মিডিয়ার কাজ ছাড়লে কেউ আর যোগাযোগ রাখে না। কারণ তারা অন্য গ্রহের যাত্রী, আমি আলাদা গ্রহের মানুষ হয়ে গেছি যেনো। যদিও এদের মধ্য হাতে গোনা কয়েকজন আলাদা। যারা আমায় সাহস ও সাহায্য দুটোই একসাথে দিয়েছেন এখনও দিয়ে যাচ্ছেন এতদিন ধরেই। 

যাই হোক কলকাতার এক রিপোর্টার আমায় ফোন করে বলেছিলেন, দাদা আমি শুনলাম তুমি বোলপুরে টোটো চালাও। আমায় তুমি টোটো চালক এই ছবিটা একটু দেবে আমি একটা খবর করবো তোমায় নিয়ে। সেই রিপোর্টার এর কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে তাকে বললাম ভাই নিশ্চয়ই দেবো। সেই ছবি পেলে সে খবর করবে আমায় নিয়ে। সত্যিই কি অদ্ভুত আবদার তার। এমন আর একজন বোলপুরের দাপট ওলা রিপোর্টার বললো, আচ্ছা দাদা বোলপুরের কোন রুটে তুমি টোটো চালাও বলতো। একটু রুটটা আমায় বলো তুমি,দেখতে পাইনা আমি তোমায়। এটা শুনেও একটু হাসি পেলো আমার। যিনি বলছেন বাংলা মিডিয়ার চ্যানেলে তার সুনাম এর থেকে বদনাম বেশি রটেছে। যাক এসব আর বেশী না বলাই ভালো। 

এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলি চোখে চোখ রেখে কথা বলা বাংলার এক দাপুটে সাংবাদিক আমায় শীতের রাত দুটো অবধি বসিয়ে রেখে ইন্টারভিউ না নিয়ে বলেছিল তোমার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে দাদা। সত্যিই কি অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল সেদিন আমার। আবার সেই বিখ্যাত সাংবাদিক আমায় বলেছিল গঙ্গা পেরিয়ে এসে কাজ করতে পারবো কি না। হাঁ বলাতে বলেছিল কম টাকার কাজ। কমতে কমতে সেই টাকার পরিমাণ পাঁচ হাজার এর নিচে নামলেও আমি রাজি হলেও পরে সে জানায় না এত টাকা দেওয়া যাবে না কিছুতেই। আমি বলি কত দু হাজার টাকা সে বলে দেখি ভেবে বলবো। না আর সেই চোখে চোখ রাখা সাংবাদিক ভেবে আর বলতে পারে নি আজও। 

সেই তো একদিন সেক্টর ফাইভ এর রাস্তায় আমায় কিছুদিন আগেই একদিন হাত নেড়ে নাম ধরে ডেকেছিল সেই বিখ্যাত সাংবাদিক। আমি একটা চ্যানেলে কাজ করছি বলে সে জানতে পারে,কিন্তু আমি তাকে না চিনে চলে এলাম পাশ কাটিয়ে। যদি তার চোখের উত্তাপে আমি পুড়ে যাই এই ভয় পেয়ে আর গলে যাই এই ভয়ে। সত্যিই জীবন বড়ই বিচিত্র।

আবার যে চ্যানেল ছেড়ে টোটো চালাবো বলে রাস্তায় নেমে পড়লাম সেই চ্যানেল থেকে আচমকাই একদিন আমায় ডাকা হলো। ভাবলাম হয়তো আবার আমি ফিরে পাবো আগের জীবন, ফিরবো সংবাদ মাধ্যমে। বেশ আনন্দ নিয়ে গেলাম সেখানে আমার ছেড়ে আসা পুরোনো অফিসে। ঝাঁ চকচকে অফিসে এসে কেমন যেনো নিজেকে বেমানান মনে হলো। চুপ করে বসে রইলাম আমি। অনেক পরে অবশেষে আমার ঠাণ্ডা কাঁচের ঘরে ডাক পড়ল। 

একবারে দৌপ্রদীর স্বয়ম্বর সভার মত ডাক পড়লো আমার। আমায় গোল করে ঘিরে আছে সব ডাক সাইটে দুঁদে সাংবাদিক এর দল। একমনে জরিপ করছেন তারা আমায়। অন্য গ্রহের জীব আবার ফিরে আসতে চায় তাদের দলে, তাদের নিজস্ব গ্রহে। তাকে কি ফিরিয়ে নেওয়া উচিত না, তাকে নেওয়া হবে না সেই নিয়েই জরুরী সভা। অবশেষে সেই পুরোনো কথা উঠলো আবার তুমি তো টোটো চালাবো বলে চলে গেলে। দাপুটে সাংবাদিক এর শ্লেষ পূর্ণ উক্তি। আমি চুপ করে শুনলাম সেই কথা।

আসলে আমার জীবনে টোটো শব্দটা একদম যেনো সম্পৃক্ত হয়ে গেছে অজান্তেই। তাকে আমি হাজার চেষ্টা করেও ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। সেই ঠান্ডা হিমশীতল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটু স্বস্তি পেলাম আমি। দম বন্ধ করা পরিবেশ ছেড়ে নিশ্বাস নিলাম প্রাণ ভরে।
 রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, খারাপ কি খুব টোটো চালক হয়ে বেঁচে থাকায়। এর মধ্যে কোনো লজ্জা লুকিয়ে আছে কি কোথাও। কে জানে জানিনা আমি। নিচু হয়ে, ছোটো কাজ করে বেঁচে থাকার মধ্যে কি কোনো। গ্লানি লুকিয়ে থাকে।

খবরের দুনিয়া ছেড়ে অন্য গ্রহ ছেড়ে, হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম আমি এটাই। সত্যিই বলতে কি আমি কোনো দিন এখনও টোটো চালক হইনি। পেটের ক্ষিধে মেটাতে, যদি তাই হতে হয় সেটায় লজ্জার কিছুই নেই। অন্তত সম্মান রক্ষা করে বাঁচবো আমি। কোনো দিন রাজনীতির কারবারির কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে বাঁচবো না আমি। বলবো না আমি তাকে, যে কিছু খবর করেছি আমি তোমায় নিয়ে আমায় খাবারের টাকা দাও। এটা তো আরও‌ লজ্জার আর অপমানের ব্যাপার। যদিও এই অপমান গায়ে মেখেই অনেকে বেঁচে আছেন আজ কাল এই সমাজে বুক ফুলিয়ে। 

যাকগে বাদ দি এই সব নানা হাবিজাবি প্রসঙ্গ। টোটো তে ফিরে আসি আমি। টোটোতে উঠেই আমার পছন্দের আসন হলো ড্রাইভার এর পাশের আসন। সেদিন আমি তাই করলাম বসে পড়লাম ওর পাশে। গল্প জুড়লাম ওর সাথে। জানলাম ও বোলপুরে থাকে না। একটু দূরে থাকে ইলমবাজারের দিক থেকে আসে সে বোলপুরে টোটো চালাতে। নিজের টোটো কিনেছে সে বাবার এক বিঘা জমি বিক্রি করে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে চলে যায় তার কোনো রকমে। কারণ তাকে টোটো ভাড়া দিতে হয় না কাউকে। সারাদিন পাঁচশো টাকা রোজগার না হলে পাঁচটা পেট চলা দায় এই বাজারে ,তবু যা আয় হয় কষ্টে সৃষ্টে দিন চলে যায় তার নিজের টোটো বলে। কথায় কথায় সে আরও জানালো বোলপুর শহরে এমন প্রায় পনেরো হাজার কার্ড ওলা টোটো চলে। আর কার্ড ছাড়া টোটো চলে প্রায় পাঁচ হাজার। আমি শুনে অবাক এই ছোটো শহরে প্রায় কুড়ি হাজার টোটো চলে।

 ফেরার পথে সন্ধ্যা হয়েছে আর একজনের সাথে ফিরতে ফিরতে শুনলাম তার টোটো চালকের গল্প। তার নিজের টোটো নয়। মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া টোটো তার। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে যা আয় হয় তার মধ্যে আড়াইশো টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয় তাকে। ভাড়ার গাড়িটা মালিকের বাড়ীতেই থাকে। সেখানেই চার্জ দেওয়া হয়।তারপর যা আয় হয় সেটা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় তাকে প্রতিদিন। লাভ এটাই বাবা বিশ্বকর্মা কোনো দিন তাকে খালি হাতে ফেরায় না কোনদিন। হয়তো কোনো দিন নিজের পকেট হাতড়ে আড়াইশো টাকা গাড়ি রাখার সময় মালিককে দিয়ে আস্তে হয়। তবু অন্য কোনো দিন ঠিক বাবা বিশ্বকর্মা সেটা পুষিয়ে দেন এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি কি বলেন। আচমকা ওর মুখে এই কথা শুনে আমি হাসতে গিয়েও পারি না। জীবনের পরতে পরতে কি গভীর বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে জানে এরা। কই আমরা তো পারি না, এই বিশ্বাসের জোরে বাঁচতে শুধু বাবা বিশ্বকর্মা কে ভরসা করে।
 
দ্রুত সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে টোটোটা এগিয়ে চলে। আমি বসে থাকি চালকের পাশে চুপটি করে। আকাশের তারাগুলি, পূর্ণিমার চাঁদটা সরে সরে যায় দ্রুত আমার চোখের সামনে থেকে। তবু অদ্ভুত মায়াবী চাঁদের আলোয় আলোকিত হতে হতে ইসমাইল টোটোর হাতলে চাপ দেয়। আরো জোরে দৌড় করে তার ভাড়া নেওয়া স্বপ্নের যানটি। আমি শুধু ওকে দেখি আর ভাবি যারা আমায় এত কিছু বলেছিল তারা কি কোনোদিন এই ইসমাইল কে আমার মত এত কথা বলতে পারবে। ভাঙতে পারবে তার বিশ্বাসকে। যে বিশ্বাস নিয়ে সে প্রতিদিন হালুমদের এড়িয়ে রাস্তায় নামে নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে। 

সে জানে তাকে এই রাস্তায় কেউ ক্ষত বিক্ষত করবে না। সন্ধ্যায় সে আকাশের তারা দেখে। চাঁদ মামাকে দেখে আর মনে মনে ভাবে আড়াইশো টাকার গন্ডি পেরিয়ে গেলেই তো তার নিজের আয় হবে। যে টাকা আয় করে তার ঘরের চাঁদকে একটু ভালো রাখতে পারবে সে খুশী মনে। এই আশা আর ভরসা নিয়েই তো ইসমাইলরা বেঁচে থাকে প্রতিদিন। কোনও লজ্জা শরম নিয়ে নয়, লুকিয়ে নয়, একদম বিন্দাস জীবন নিয়ে ওরা জীবনকে বাজি রেখে ছিনিমিনি খেলে ওরা দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে, নিভৃতে, নির্ভয়ে কারণ ওরা জানে বাবা বিশ্বকর্মা ওকে খালি হাতে ফেরাবেন না। 

আর আমরা ওদের দুর থেকে দেখি বলি, ছি ছি তুমি টোটো চালাও। কিন্তু অস্ফুটে বলি আহারে আমিও যদি ওর মতো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারতাম অমন করে বিন্দাস জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। সন্ধ্যায় চাঁদ মামাকে দেখে দৌড়তে পারতাম আলো আঁধারি রাস্তা দিয়ে। আড়াইশো টাকার গন্ডি ছাড়িয়ে গেলেই উৎফুল্ল হয়ে ভাবতে পারতাম বিশ্বাস করতে পারতাম বাবা বিশ্বকর্মা ঠিক আছেন, তিনি সব সময় রক্ষা করেন। তাহলে বোধহয় আমার জীবনটাও বদলে যেত। কিন্তু পারলাম কই ইসমাইল -এর মত বিশ্বাস নিয়ে জীবনে বাঁচতে। এই জীবনে বোধহয় আর ইসমাইল এর মত বিশ্বাস নিয়ে বাঁচা হলো না আমার।

তিন চাকার টোটো - অভিজিৎ বসু।
উন ত্রিশ নভেম্বর দু হাজার তেইশ।
ছবি নিজের।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...