ভাই ফোঁটা এলেই আমার মনে পড়ে ছুটু আর বুয়ার কথা। ওরা যমজ দুই বোন। সেই আমাদের সবার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া ছুটু আর বুয়ার দিদি মিষ্টুর কথা। সেই আমার বড়ো মামার নালিকুল এর বাঁশ বাগানের পাশে সেই ছোটো বাড়ির কথা। মামী বা মাইমাকে সেই নামে না ডেকে সেই সুন্দর গ্রামের বৌদি বলে ডাকা কথা। আসলে জীবন তো এমন করেই এক একটা উৎসবের আনন্দের মাঝে আমাদের কাছে ফিরে আসে এইভাবেই। নানা হারিয়ে ফেলা স্মৃতি নিয়ে।
আজ বড়দা মানে আমার বড়ো মামা নেই। কলকাতা পুলিসের কাজ করতেন তিনি। অবসর নেওয়ার আগেই মারা গেছেন তিনি। মামিমা চলে গেছেন বহুদিন হলো। আর মিষ্টু আমাদের বড়ো বোন সেও চলে গেছে অসুস্থ হয়ে বিয়ের পর। তাই আমার ভাই ফোঁটার আনন্দে ভাঁটা পড়েছে বহুকাল আগেই। তবু রাতের বেলায় অনেক খুঁজে পেতে ছুটুর উজ্জ্বল মুখের ছবি দেখে বেশ ভালো লাগলো আমার। সেই ছোটো বেলায় ওই বোধহয় কেরোসিন তেল খেয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে বসেছিল শ্রীরামপুরে বাড়িতে। সেকি অবস্থা হয়েছিল সেইদিন।
বাড়ির এক ছেলে হলেও ভাই ফোঁটা দেবার লোক ছিল না আমার। তাই দিদা আমায় ভাই বলে ডাকতেন তিনি সবার সাথে আমায় ফোঁটা দিতেন। তিন মামাকে আমার মা ফোঁটা দিয়ে শাড়ি আর টাকা পেতো। কত হৈ চৈ হতো সেই পাঁচ নম্বর এঁদোপুকুরের ওই বাড়িতে। সকাল থেকেই হই হুল্লোড়। বাজার কিনে আনা মেজোমামার টিন বাজার থেকে। ছোটো মামা একটু চুপ করে দিন কাটিয়ে দিত। কিন্তু সেই তিন ভাই আর আমার মা তাদের একমাত্র বোন ছাড়াও বোনমাসী আসত ভাই ফোঁটা দিতে। একদম যেনো একটা ভাই বোন আত্মীয়দের মিলন দিবস পালিত হতো এই দিনটা। সব যৌথ পরিবারের বাড়িতেই এই অনুষ্ঠান হতো ধুমধাম করে।
বড়ো মামার মেয়ে হলো মিষ্টু। সেই প্রথম ছোটো কড়ে আঙুল দিয়ে আধা আধা বুলিতে দাদার কপালে দিলাম ফোঁটা বলে,ভাই ফোঁটা দিলো আমায় সেই ওর ছোটো জামা পরে ফোঁটা দেওয়া আজও মনে আছে আমার। এরপর ওর যমজ দুই বোন হলো। একজন বুয়া আর একজন ছুটু। কিছুদিন পর দিদির সাথে তারাও লাইন দিলো মিষ্টির প্লেট হাতে। বেশ মজার ব্যাপার কিন্তু। আমি নিজেকে বেশ মামাদের মতই কেমন যেনো বড়ো বড়ো ভাবতে লাগলাম নিজেকে। মামাদের মত ভালো কিছু দিতে না পারলেও ওদের হাতে তুলে দিতাম কিছু না কিছু জিনিস। এইভাবেই জমে উঠলো আমাদের বাড়ির এই ভাইফোঁটা পর্ব।
তাল কেটে গেল একদিন। বড়ো মামা চলে গেলেন বাড়ী করে নলিকুল। দিদাও চলে গেলেন ওখানে। মেজো মামা ফ্ল্যাট কিনে অন্য জায়গায় বাসা করলেন। সব ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেলো কেমন করে। দিদা মারা গেলেন। তারপর সেই ফোঁটা দেওয়া মার বন্ধ হলেও আমি বেশ বড়ো হয়ে চাকরি করে হাজার ব্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করে বালিকুল ছুটে যেতাম। বউদি আমার জন্য নাড়ু আর মুগ ডালের বরফি করতেন প্রতি বছর। বলতেন বাপি আসবে তাই কষ্ট করেও করেছি আমি। সেই সব দিন মানুষ গুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো। বুয়ার বিয়ে হলো। মিষ্টুর বিয়ে হলো কিন্তু সংসার করা হলো না তার চলে গেলো সে। বুয়া বাবার কাজ পেয়ে এখন সরকারি হাসপতালে কর্মরত। বলতে গেলে আর কোনো যোগাযোগ নেই আমার সাথে কারুর আজ।
সেই মিষ্টুর বিয়ের সময় রাত জাগা, বিয়ের সব আয়োজন করা, বুয়ার বিয়ের সময়েও ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যবস্থা করা। সেই ওদের দুজনের শশুড় বাড়ী যাওয়া। সুজয়, সুভাষ কোথায় যে হারিয়ে গেলো কে জানে। হাজার ফোন ঘেঁটেও আজ আর কারুর ছবি পেলাম না আমি। সেই আমার মেয়ের অসুস্থ হয়ে হাঁটতে না পারা শ্রীরামপুর থেকে গাড়ী করে বুয়ার বাড়ী যাওয়া সেই গ্রামে। সেই বৌদির কাছে গেলেই লুচি আর সাদা আলুর তরকারি করে খেতে দেওয়া হাজার কষ্টের মধ্যে। বেশ ছিল কিন্তু সেই দিন গুলো। কিন্তু সব কি আর সমান দিন যায়।
ছুটুর সেই ওর বাবার কাজ পাওয়া নিয়ে কত সমস্যা। পুলিশের ভেরিফিকেশন হচ্ছে না কিছুতেই। হুগলীর সেই পুলিশ কর্তা তথাগত বসুকে বললাম আমার নাম করে দেখা করতে। পুলিশের ভেরিফিকেশন হলো একদিনেই। ওর চাকরির নিয়োগপত্র এলো ওর হাতে। আমরা ভেবেছিলাম আসবে আমাদের বাড়িতে কাজ পেয়ে দেখা করতে। না আর আসেনি কোনোদিন ও । পরে জানলাম উত্তরপাড়া হাসপাতালে কাজ করে সে। না, আজ তাই ভাইফোঁটার আগের রাতে কত টুকরো ছবি, কত কথা যে মনে পড়ে যাচ্ছে আমার কে জানে।
সত্যিই মনটা মাঝে মাঝেই লুকিয়ে ওদের বড়ো দেখতে ইচ্ছা করে আমার। মনে হয় ছুটে চলে যাই আবার ন্যালিকুল। বলি কি রে এইবার আর ফোঁটা দিবি না তোরা আমায়। আগে তো যখন কাজ করতাম কত জিনিস কিনে দিতাম ওদের। আজ আমি কর্মহীন অবস্থায় অর্থহীন দিন কাটাই আমি। কি বা দেবো ওদের যদি ডেকে ফোঁটা দেয় ওরা আমায়। মনে মনে ভাবি না, এই বেশ ভালই আছি আমি একা একা কারুর সাথে যোগাযোগ না করে। কি দরকার ওদের দাদার খবর নেওয়ার।
একা একাই বেঁচে আছি বেশ ভালো আছি। অন্ধকার ঘরে একা একা বালিশ এর ওপর টপ টপ করে জল ঝরে পড়ে। দেখতে পাই সেই কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে মিষ্টুর সেই নতুন লাল শাড়ী পড়া শুকনো মুখ। সেই লাল পা। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো আমার চোখের সামনে থেকে। বৌদি চলে যাবার খবর শুনে তাই আর দেখতে যেতে পারিনি আমি কিছুতেই। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে আমার।
আজ এতদিন পড়ে মনে পড়লো ছুটুর মুখ। বুয়াকে দেখিনি কতদিন হলো। সেও হারিয়ে গেছে কবেই। বুয়ার সেই ছোটো মেয়ে আর ছেলেটা কত বড় হলো কে জানে। আর মিষ্টু তো বহু দূরেই চলে গেছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে। আর তার সাথে ভেঙে গেছে আমাদের সেই তিন বোনের ভাই ফোঁটার আয়োজন আর আনন্দ। সেই সন্ধ্যা বেলায় শঙ্খ বাজার আওয়াজ। সেই দাদার হাতে মিষ্টি তুলে দিয়ে বলা সব খেতে হবে কিন্তু তোকে।সেই মিষ্টুর বায়না করা আমার কাছে ওর চোখের পাতা কিনে দিতে হবে এইবার সে পুজোয় পড়ে ঘুরবে। সেই নিয়ে কত বকা ওর মার। ছুটু আর বুয়া কোনোদিন দাদার কাছে বায়না করেনি।
সত্যিই জানি সেই অতীত দিনের স্মৃতি আর কোনো দিন ফিরে আসবে না আমার জীবনে। শুধু মনে পড়ে যায় আমার ছুটুর সেই কথা আমি বড়ো হয়েছি, আমার জীবন আমার মতোই কাটাতে দাও আমাকে। সেদিন থেকেই তো আমরা সবাই আলাদা ভিন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেছি। ওরাও আমার মার মৃত্যুর খবর পেয়ে কোনো দিন আমায় জিজ্ঞাসা করেনি পিসিমনি চলে গেলো কি হয়েছিল। হ্যাঁ, জীবন আর জীবনের সম্পর্কের জটিলতা বোধহয় এমনই। আজ তাই সাদা জীবনের কালো কথায় ভাইফোঁটার সকালে আমার হারিয়ে যাওয়া সেই আদরের মিষ্টু, ছুটু আর বুয়ার কথাই লিখে ফেললাম ।
ভাইফোঁটার সকাল - অভিজিৎ বসু।
তিন নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন