এই নিস্তব্ধ শুনশান নীরবতা মাখা ভোর এর প্রেমে পড়তে বেশ ভালো লাগে আমার আজকাল। কেনো জানিনা রাত শেষ হতে হতেই বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করি আমি। বয়স হচ্ছে তাই বোধহয় ঘুম কমতে শুরু করেছে জীবন থেকে। আর বাড়ছে চিন্তা, সুগার, কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, বুকের ধুকপুকনি, আর কমে আসা জীবনের প্রতি ভালোবাসা আরও কত কি। মাথার পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই অন্ধকার এর ছায়া মাখা ঘড়িটা টিক টিক করে জানান দেয় সে এসে গেছে প্রায় ঘড়ির কাঁটা ধরেই প্রতিদিনের মত নিয়ম করেই।
ঘস ঘস করে ফ্যান এর ঘুরে বেড়ানো টালমাটাল হয়ে আমার মাথার ওপর। এই কুয়াশা মাখা শান্ত নির্জন ভোরবেলাকে খুব কাছে টেনে নিতে ইচ্ছা করে আমার। ঠিক যেভাবে ঘুমের মাঝে অজান্তে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় নবোঢ়া সুন্দরী বৌ নরম বিছানায় বুকের মাঝে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো হারিয়ে যাওয়া রাতের পাহারাদারের ডিউটি শেষ প্রায়। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। হেমন্তের কুয়াশা মাখা ভোরের জন্য অপেক্ষা।
দূরের ফাঁকা মাঠ ঘাট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে কুয়াশার চাদরে মোড়া সকাল ধীর পায়ে। যে সকাল একদম অন্য ধরনের। যে সকালের এমন ভেজা রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হই বার বার। যে সকালে ন্যাড়া খেজুরের গাছে উঠে রসভাণ্ডের কলসী বাঁধার তাড়া। ওই যে মাথায় গামছা বেঁধে কেমন দুখু মিঞা রসভাণ্ডার বেঁধে মিষ্টি হাসি হেসে পরের গাছে উঠে পড়ে আপনমনে জিরেন দিতে। সাইকেল চালিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে ছুটে চলে রসের খোঁজে আর জীবনের খোঁজে। ওর জীবনের রং রস তো বছরের এই কটা দিন বেশ ভালই উপচে ওঠে কলসী বেয়ে। সাদা ফ্যানার মতই। যা দেখে দুখুর চোখে মুখে উপচে পরে শিউলির হাসি।
যে কলসীর মুখের কাছে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দুখু নিজের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে আপনমনে। আর দুর থেকে ওকে দেখে আপনমনে তাকিয়ে থাকে ঘুম ভাঙা ওই কাঠি দাগওলা বসন্তবৌরী। আর সে মনে মনে ভাবে সত্যিই কি বোকা এই দুখু। কদিনের উপচে পড়া আনন্দ দেখে কি খুশি ও। তরপর যখন এই কুয়াশায় ঘেরা ভোর, রসভাণ্ড উপচে পরা সকাল চলে যাবে। তখন কি করবে দুখু আবার যে এক জীবনেই ফিরে যাওয়া তার। এই দুঃখ আর এই সুখ। এই আনন্দ আর এই নিরানন্দ। এই প্রাপ্তি আর এই অপ্রাপ্তি।
বাইরের চুপটি করে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধতা কেমন দরজার বাইরে অপেক্ষা করে গোপনে সরীসৃপের মত।আর আমি ঘুম জড়ানো চোখে শুয়ে শুয়ে প্রহর গুনি। অন্ধকার কেটে কুয়াশা মাখা ভোরের জন্য অপেক্ষা করি। মৃদু আলো ফোটে। কাক এর দল আলো ফোটার আগেই চিৎকার করে জানান দেয় ভোর হলো দোর খোলো।
মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাসের লেখা সেই তাঁর ভোর হয় নিয়ে জনপ্রিয় বাংলা কবিতার লাইন-
ভোর হয়,
কি যেন আমাকে দিতে চায় শেষরাত—
কোন আভা, পূর্বাভাস?
হয়তোবা শেষরাত আমাকে দিতে চায় তার ভোর হয়ে ওঠা।
নিদ্রা থেকে জেগে ওঠা পাখি,
দু’ একবার ডাক দিয়ে, চুপ ক’রে থেকে
নিজ অনুক্রমিক ডাকের মধ্যকার
নীরবতা মন দিয়ে শোনে;
তারপর পুনরায় ডাকে।
তুমি দেখো শব্দ অনুক্রমিক, অস্থায়ী, কিন্তু
দু’টি শব্দের মধ্যকার নীরবতা স্থায়ী, স্থায়ী।
শেষরাতে কোনো ধ্বনি একটানা নয়
সব ধ্বনি প্রতিধ্বনিহীন— থেমে-থেমে ডাকে
ডাকের মাঝখানের কসমিক স্থির নীরবতা
সব ধ্বনি থেমে-থেমে, কান পেতে, শোনে।
গাছে গাছে পল্লবের মধ্যখানে শূন্য…শূন্যস্থান,
রাত্রিভর জেগে থাকা মানুষের চোখ ভেদ ক’রে,
গভীর আত্মার মধ্যে, বেদনার মধ্যে, ঢুকে যায়।
কোনও বাস্তবতা থেকে ছিটকে এসে জল
স্বপ্ন-মধ্যে ঢোকে শেষরাতে।
সকাল নদীতে আগে হয়।
গড়িয়ে গড়িয়ে নদী থেকে উঠে আসা কুয়াশার
ভেপু— দশদিকে শোনা গেলে,
মাটিতে, ভূমিতে, ভোর হয়…
এ শহর কসমিক শেষরাত পার হয়ে
কসমপলিটন হয়ে ওঠে।
তখন তোমাকে ভোর,
অন্ধকার কেটে যাওয়া গভীর সুস্থতা,
মানুষের জ্ঞানের চেয়ে ভিন্ন জ্ঞান, আলো,
অন্য এক সুস্থিরতা, পরম আনন্দ দিতে চায়।
তোমার ভিতরে শূন্যস্থান—
আরো বহু ভিতরের শূন্যস্থান থেকে এসে
শেষরাতে— ভোরবেলা, যেন, পূর্ণ হয়…
যেন, সত্যি পূর্ণ হয়।
— (অগ্রন্থিত কবিতা)
কুয়াশা মাখা ভোরের অপেক্ষা - অভিজিৎ বসু।
পাঁচ নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন