ফেসবুকের দেওয়ালে এই চমক লাগা বিজ্ঞাপনটি দেখে বেশ ভালো লাগলো আমার। আর তাই তো লিখতে বসা। বেশ মজার বিষয় কিন্তু আপনি ভাবুন, আপনার ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা পুরোনো দম দেওয়া ঘড়ি সারাবার লোক এর সন্ধান করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কেমন যেনো সেই দেওয়ালে আটকে রাখা , সেই ঝুলে থাকা ক্রুশ বিদ্ধ থমকে যাওয়া একটি মানুষ। সে যীশু বা যে কেউ হতে পারে যাকে একটু দম দিলেই সে আবার হাত পা ছুড়তে শুরু করবে। আবার হাসবে, খেলবে, নাচবে, ঘুটিবাজি করবে, নিজের মাতব্বরি দেখাবে, কেরামতি দেখাবে, সব করবে খুব সহজেই। শুধু একটু দম দিয়ে দেবার আর সারিয়ে দেবার লোক চাই।
বেশ ভালই কিন্তু কি বলেন আপনারা। সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া থেমে যাওয়া ঘড়ির মিস্ত্রিকে যদি সত্যিই পাওয়া যায় আর সেই বন্ধ ঘড়ির মতো দম আটকে ঘরের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে থাকা মানুষ যদি হঠাৎ উঠে বসেন। মরা কান্নার শোরগোল পড়ে যাওয়া বাড়িতে আচমকা যেনো অন্য এক ছবি দেখা যাবে। এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা ভয়, অবিশ্বাস আর জড়তা নিয়ে। আর ভাবছে এ আবার কি হলো রে বাবা সব আজগুবি ব্যাপার স্যাপার। এসব আবার ভূত প্রেতের বাপ্যার নয় তো। এই বিজ্ঞাপন দেখে আমার ঠিক এমন কথাই মনে হলো যেন আজ।
এই ধরা যাক আমিই সব জায়গায় বাতিল হয়ে যাওয়া একটি মাল, যার কোনো দাম নেই সমাজে, সংসারে, পরিবারে, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে, অফিস কাছারিতে, সেই মানুষটা হঠাৎ ওই দেওয়ালে টাঙানো বন্ধ ঘড়ির মতই স্থির হয়ে গেল টুক করে। ওই চুপ করে তিন আর নয় সংখ্যার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো স্থির কাঁটার মতো স্থবির হয়ে গেলো আমার এই জীবনটা হঠাৎ। আমি চোখ বুজে অনুভব করলাম। কেমন একটা বেশ খুশি ও দুঃখ মেশানো আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে ঘরের ভেতর। ঠিক যেমন হেমন্তের সময় টিকটিক করে ধীরে খুব ধীরে মাথার ওপর পাখা ঘোরার মত মৃদু হাওয়া বইছে ঘরের ভেতর।
বাড়ির ভেতর সেই সময় একরাশ দুশ্চিন্তা দাহ করার খরচ কোথায়। কে দেবে টাকা। লোকটা যে সব শেষ করে দিয়ে তারপর চোখ বুজলো ওই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির মতই। যে মানুষটা এতো বকবক করতো, এত জোরে কথা বলত বলে সবাই বিরক্ত হতো ঘরে আর বাইরে। এত বেশি কথা বলত বলে অনেকেই তার ফোন পেলে আর ধরত না শেষের দিকে। আর যদিও সেটা কেউ ভুলক্রমে ধরে ফেলত হেসে বলতো ব্যস্ত আছি। একটু পরে করছি, বলে আর কোনোদিন ফোন করতো না। সে দিল্লী, বোম্বে, কলকাতা আর যেখানকার বাসিন্দাই হোক। আর সেই মানুষটা ফোন কেটে দিয়ে, কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো ওই বন্ধ ঘরবন্দী থেমে যাওয়া দেওয়াল ঘড়ির দিকে আনমনে নির্নিমেষ নয়নে।
যে একদিন সগর্বে ঢং ঢং করে জানান দিত তার উপস্থিতি ঘরে ,বাইরে,অফিসে, রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, ট্রামে সর্বত্র। আর কেমন করে সে বুঝিয়ে দিত সে বেঁচে আছে সংসারের মাঝে একা একাই দিব্যি পুরোনো হলেও। সেও কি জানতো নাকি যে একদিন এমন দুম করে থেমে যাবে তার কাঁটা, ঘন্টা, টিকটিক আওয়াজ আর সময় মেপে ঘন্টা বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করার ক্ষমতা। যার জন্য আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে।
আমার নেতিয়ে পড়ে থাকা শরীরের ওপর খবর পেয়ে হাজির হয়েছে ভেনো মাছির দল। বোধহয় খবর পেয়েছে সেই ভোরবেলায় নিমগাছের ডালে বসে ডেকে ওঠা সেই ঘুঘু পাখিও। যার সাথে আমার প্রথম ভোরের আলাপ হয় চুপ চাপ। যে ভীড় করেছে জানলার লোহার তারজালের ওপারে। কেমন ঘোলাটে চোখে কড়া নজরে দেখছে আমায়। যেনো ঠিক সেই ঘড়ির মিস্ত্রির মতই।
আনমনে উড়ে যাওয়া কাক এর দল ভীড় করেছে জানলার কার্নিশে, বারান্দায় চুপ করে। যেনো ওরাও বুঝে গেছে অবশেষে অনেক কষ্টে স্থির হয়েছে এই অস্থির মানুষটা। বহুদিন পর যাকে অনেক বার একটু স্থির হয়ে ভেবে চিন্তে, সংসারে, অফিসে, কর্মক্ষেত্রে পা ফেলতে বলেছে তার ঘরের লোক আর বাইরের লোক। কিন্তু না, সেই কথা কোনোদিন কোনোভাবেই শুনে চলতে পারে নি যে মানুষটা। সেই দুদ্দাড় করে ছুটে চলা মানুষটা কেমন ওই ঘড়ির পেন্ডুলামের মতই নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে গেলো আজ এই ভোরবেলায়। ঠিক ওই ঘড়ির পেন্ডুলামের মতই।
অনেক কষ্টে মিস্ত্রি এলো আমার জন্য। মেয়ের চোখের জল শুকিয়ে তখন সরু দাগ পড়েছে ওর দু গাল বেয়ে। আর এসবের মাঝে আমি হঠাৎ করেই উঠে বসলাম ঘুম ভেঙে। আপন মনে ওই স্থির ঘড়ির মতই আবার চলতে শুরু করলাম। আর বদলে গেলো ঘরের হাওয়া। বাইরে তখন কাকেদের চিল চিৎকার। যেনো মহোৎসব শুরু হয়েছে। টিক টিক করে দুলছে পেন্ডুলাম। তিন আর নয়ের ঘরে আটকে যাওয়া কাঁটা কেমন এগোতে শুরু করেছে আবার।
বন্ধ দেওয়াল ঘড়ির মিস্ত্রি চাই - অভিজিৎ বসু।
চৌঠা নভেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক ও গুগল।
ঘড়ির সঙ্গে রূপক অর্থে মানুষের জীবন / নিজের বেচে বর্তে থাকার এই তুলনা অসাধারণ। সমাজ সংসারে টিকে থাকার যে শর্ত, সচল হয়ে হাম কিসিসে কম নেহি বলে দেখিয়ে দেওয়ার যে দম তার একটু কমতি হলেই হয়ে যেতে হয় ব্রাত্য। মানুষের জীবনঘড়িও একটা বড় দেওয়াল ঘড়ি সম,দম শেষ হলেই যেন দাম হীন। লেখককে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন