এই শীতে
বুদ্ধদেব বসু
আমি যদি ম'রে যেতে পারতুম
এই শীতে,
গাছ যেমন ম'রে যায়,
সাপ যেমন ম'রে থাকে
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ'রে।
শীতের শেষে গাছ নতুন হ'য়ে ওঠে
শিকড় থেকে ঊর্ধ্বে বেয়ে ওঠে তরুণ প্রাণরস,
ফুটে ওঠে চিক্কণ সবুজ পাতায়-পাতায়
আর অজস্র উদ্ধত ফুলে।
আর সাপ ঝরিয়ে দেয় তার খোলশ,
তার নতুন চামড়া শঙ্খের মতো কাজ-করা;
তার জিহ্বা ছুটে বেরিয়ে আসে আগুনের শিখার মতো,
যে-আগুন ভয় জানে না।
কেননা তারা ম'রে থাকে
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ'রে
কেননা তারা মরতে জানে।
যদি আমিও ম'রে থাকতে পারতুম----
যদি পারতুম একেবারে শূন্য হ'য়ে যেতে,
ডুবে যেতে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে---
তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে ম'রে যেতে না হ'তো
এই বাঁচার চেষ্টায়,
খুশি হবার, খুশি করার,
ভালো লেখার, ভালোবাসার চেষ্টায়।
এই শীতের কবিতায় কবি কি সুন্দর বর্ণনা করেছেন তিনি। যদি স্মৃতিহীন,স্বপ্নহীন হয়ে ডুবে যেতে পারতাম অতল ঘুমের মধ্যে। তাহলে তো প্রতি মুহূর্তে মরার ভয় নিয়ে বাঁচতে হতো না আমায়। বাঁচার চেষ্টা করতে হতো না আমায় প্রতি মুহূর্তে।
সত্যিই কি অদ্ভুত অনুভূতির কথা লিখেছেন কবি বুদ্ধদেব বসু। ৩০ শে নভেম্বর ছিল কবির জন্ম দিন। তাই তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে মরার মত বেঁচে থাকার কথা ভাবলে কেমন এলো মেলো হয়ে যায় আমার জীবনটা। চোখ পড়ে যায় দেওয়ালে ঝোলা ক্যালেন্ডারের দিকে। স্থির হয়ে আছে সে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাসের শেষ বা শুরু কোনো পরিবর্তন এই তার কোনো মাথাব্যথা নেই। বহুদিন ধরেই সে এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
মাসের শেষ হলে মোবাইল ফোনে এস এম এস আসে না আর আমার। যে এস এম এস জীবনের জিয়ন কাঠি হয়ে সবাই পায়। বহু দিন সে পাট উঠেই গেছে আমার জীবন থেকে। কোনো ভাবেই আর, সে জীবন ফিরে আসবে। এমন স্বপ্ন আর দেখি না আমি। শুধু জানি এই ভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ পাওয়ার থেকে দূরে চলে যাওয়া অনেক ভালো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যালেন্ডার, দেওয়ালে নড়ে ওঠে অস্ফুটে বলে না, না, কোথায় যাবে তুমি।
দেখতে দেখতে বার মাসের বছরে এগারো মাস কেটে গেল। জীবনের পরতে পরতে এই ভাবেই কেটে যায় সময়,কোনো হিসেব না করেই। অনেক হিসেব করে মেপে মেপে যারা মুখোশ পরে আমার কাছে ঘুরে বেড়িয়ে বলেছিল অনেক অনেক কথা। তারাও কি খোলস ছেড়ে দিয়ে চলে এই শীতের রাতে কে জানে। আসলে কবির কথায়, উদ্ধত ফুল হয়ে তারা বেঁচে থাকে,নিজেদের জন্য।শুধু নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঁচে এরা।
আর তাই আমার খুব কষ্ট হয়, করুণা হয় এদের দেখে। মুখোশ খুলে এরা যদি দরদাম না করে হিসাব কম করে,সত্যিই করে সবার সাথে মিশে বাঁচতে পারতো, সবাইকে নিয়ে একটু চলতে পারতো, তাহলে বোধহয় একটু ভালো লাগতো আমাদের সকলের।বদলে যেত সবার জীবন।
কিন্তু আত্মস্বার্থ রক্ষা করা মানুষ সেটা করবে কি করে।যে নিজেকে ছাড়া অন্যকে ভালো বাসার কথা, ভালো রাখার কথা কোনো দিন ভাবতে শেখে নি।দুর থেকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাত হয়ে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডার বুঝতে পারে আমার দুঃখের কথা।
মনে মনে সেও ভাবে, কই তারা তো এমন আত্মস্বার্থ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারলো না বছর বছর। তাহলে কেনো রক্ত মাংসের বুদ্ধিমান দু পেয়ে প্রাণী সেটা পারবে না কে জানে। কবির কথায় বলি , ভালোবাসার চেষ্টায়, ভালো লেখার চেষ্টায় । আমায় বাঁচার স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই স্বপ্নকে আঁকরে ধরেই আগামী দিন বাঁচতে হবে।
কবির জন্ম দিনে শ্রদ্ধা।
ছবি - সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন