রাত হলেই আমার সাদা জীবনের কালো কথা লিখতে ইচ্ছা হয় একান্তভাবেই। হাজারো হারিয়ে যাওয়া মানুষ ভিড় করে রাতের অন্ধকারে আমার কুয়াশা মাখা জানলার আশপাশে। চাঁদের কুয়াশার আলোর স্পর্শ মেখে ছাদের কার্নিশের আড়ালে বসে থাকে ঠিক যেমন করে শীতার্ত পাখি। ঠিক তেমনি করেই সাংবাদিকতার জগতে ভীড় করে বহুদিনের ফেলে আসা নানা মুখ। মনে পড়ে যায় তাঁদের মুখ, হাসি, কাজ আর নানা ঘটনা আরও কত কি।
আর তাই আজ সেই হারিয়ে যাওয়া হুগলীর দেবেশ আর নির্মলের জুটির কথা মনে পড়লো আমার বহুদিন পরে। যে জুটির সাথে জেলায় কতদিন একসাথে ঘুরেছি কাজ করেছি আমরা খবরের সন্ধানে এদিক ওদিক করেছি। দেবেশের সেই ফর্সা চেহারা, মিষ্টি হাসি, অভিজিৎ কি খবর আছে গো বলে জিজ্ঞাসা করা ফোনে, মনে পড়ে যায় আমার এই সব কথা। আর নির্মলের সেই পান খাওয়া মুখ, বড়ো বড়ো চোখ, আর সেই হাসি কি খবর গো দাদা। দেবেশ বহুদিন আগেই আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে খুব কম বয়সে। বহুদিন হলো নির্মলের কোনও খবর নেই। তাই মনে হলো আমার নির্মলের কথা লিখলে কেমন হয়।
এই শীত পড়লেই নির্মল এর ফোন আসতো আমার কাছে। অভিজিৎদা এইবার চাষের ভালো এক নম্বর চন্দ্রমুখী আলু হয়েছে আমার ক্ষেতে। আমি নিয়ে আসছি শ্রীরামপুরে তোমার বাড়ী। তুমি কিন্তু দাদা রেগে যেওনা দুম করে আবার। এই বলে চলেও আসতো সে মাঝে মাঝেই। সেই দেবেশ চলে যাওয়ার পর কেমন একা একাই ভাঙা জুটি নিয়ে আর ভাঙা মোটরসাইকেল নিয়ে খবরের ময়দানে ঘুরে বেড়ায় নির্মল।
একটু কম দৌড়ে বেড়ানো রিপোর্টার। রানার মত খবরের নেশায় পেয়ে বসেনি তাকে কোনোদিনই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই সেই কবে থেকে যে খবরের মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই নির্মল তার ঠিক নেই কোনও। শুভ্রনীল এর এক ফোনে ও চাঙ্গা। এইতো দাদা আমি যাচ্ছি স্পটে। হয়তো নির্মল তখনও বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ওর সেই বিখ্যাত গ্রামের বাড়ীতে। যেখানে অনেকবার যেতে বলেছে আমায়। বলেছে দাদা এসোনা ভালো খাওয়া দাওয়া হবে। কোনো চিন্তা নেই দাদা আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
কিন্তু আজকাল ওর শরীরটা বিগড়ে গেছে যে। আগের সেই মনের জোর নেই তার এখন। একটু যেনো অন্য রিপোর্টারদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে সে ক্রমেই। তবু নির্মলের কথা তো ভোলা যাবে না কিছুতেই। সিঙ্গুরে রানা আর নির্মলের সেই যুগলবন্দী জুটির কথা অবিস্মরণীয়। যা নিয়ে গল্প কম নেই। সেই বিখ্যাত খাস খবরের আমলের গৌতম ধোলে। সেই বিখ্যাত গুরু ওর ভালো নাম জানি না আমি। সেই মহিউদ্দিন এমন কত যে নাম মনে পড়ে যায় আমার তার ঠিক নেই।
সেই দুহাজার ছয় সালে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ। সেই কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা সবুজ মাঠ। সেই একদল পুলিশ আর একদল সাংবাদিকের লুকোচুরি খেলা দিন রাত। সেই রতনপুর এর আলু মোড়, সেই কামারকুন্ডু রেল গেট, সেই বাজেমেলিয়া, খাসেড়ভেড়ী, সেই তাপসী মালিক, সুহৃদ দত্ত, দেবু মালিক, ইচ্ছুক আর অনিচ্ছুক চাষীরা আর
নানা গ্রাম এর খবর। এইসব নিয়েই তো ছিল আমাদের সাংবাদিকতার সেই মেঠো জীবন। যে জীবনে নির্মল পাত্র ঘুরে বেড়াতো, দৌড়ে সামিল হতো ধীর পায়ে হলেও। মাঝ মাঝেই খইনি খেতো ও মনে হয়। ওকে খবরের দৌড়ে বিট করে অনেকেই অফিসে খবর দিয়ে দিত। ও হেরে যেতো তবু কেমন করে যেন ঘুরে দাঁড়াতে চাইত ও একা একাই। রাতের অন্ধকারে ফোনে বলতো ওর মনের দুঃখের সুখের নানা কথা।
আজ সেই নির্মল বোধহয় একদম একা একাই বেঁচে আছে ওর সেই প্রিয় গ্রামের বাড়িতে। নীরবে, নির্জনে, নিভৃতে। কেউ ওর খবর নেয় আবার কেউ ওর খবর নেয়না আর। আমার এতদিন পর হঠাৎ মনে হলো সেই নির্মলের কথা। সেই যে কালী পূজোর সময় বাজি নিয়ে সিঙ্গুর থেকে ও আর রানা চলে আসতো আমার মেয়েকে দেবে বলে মোটর সাইকেল করে প্রতি বছর। আমি টাকা দিতে গেলে নিতে চাইতো না কিছুতেই।চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে কাজ করেও কেমন যেনো নির্লিপ্ত হয়ে জীবন কাটিয়ে দিলো ও একা একাই।
সেই আলফা বাংলা মিডিয়াতে কাজ করা সেই দিন থেকে এই পালা বদলের জি চব্বিশ ঘন্টায় কাজ করা নির্মল। আলফা বাংলা চ্যানেলে কাজ করত আমাদের সেই পান্ডুয়ার কিট্টু বা বিশ্বজিৎ সিংহ রায়। যার কথা পড়ে একদিন লেখা যাবে হয়তো। আসলে এই সব পুরোনো দিনের মানুষ গুলো ধীরে ধীরে মাঠ থেকে কেমন করে হারিয়ে যাচ্ছে ঠিক আমার মতোই। আর আমার সাদা জীবনের কালো কথাকে যে যাই বলুক সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খোঁজ করে এই রাতের অন্ধকারে। নির্মলকেও তাই একটু খুঁজে বেড়ালাম আমি এই শীতের রাতে ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে। লেপের নিচে শুয়ে শুয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলাম সেই নির্মলের। ওর নিশ্চয়ই ভালো লাগবে এই সব ফেলে আসা দিনের কথা শুনে।
সিঙ্গুরের নির্মল পাত্র - অভিজিৎ বসু।
তেরো ডিসেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন